Bhoot FM Aug 31, 2012

ভুত এফ.এম এর রেকর্ডিং। প্রকাশ এর তারিখ – ৩১ আগস্ট, ২০১২
ভালো লাগলে লাইক দিন। এটার সাউন্ড কয়ালিটি খারাপ না। শুনতে থাকুন ভুত এফ.এম, Powered by RadioTarchira.com
Bhoot FM Aug 31, 2012
READ MORE - Bhoot FM Aug 31, 2012

চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার

চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার-মাঝে মাঝে খানিকটা কৃত্রিম আলোক। ঝিঁঝিঁ পোকার কৃত্রিম ডাক। আর কোন সাড়াশব্দ নেই- এমন একটা পরিবেশে অনেক দূর থেকে শোনা গেল -”লাইট -ক্যামেরা- অ্যাকশন”। আমি যেখানে শুয়ে আছি সেখানে শোয়ানো আছে আমার মত আরো তিনজন অভিনেতা। আমি সহ মোট অভিনেতা চারজন। এই হরর ফিল্মটার শুটিং হচ্ছে এফডিসিতে- চার নম্বর ফ্লোরে। আমি নতুন অভিনেতা। এর আগে মাত্র একটা হরর ফিল্মে অভিনয় করেছি মাত্র- তাও একটা লাশের ভুমিকায় মিনিট খানেক এর অভিনয়। আমি কোন কাজ ও পাচ্ছিলাম না মনের মত। আমি এর আগের অভিনয়ের জন্য বেশ ভাল একটা রোল পেয়েছিলাম। কিন্তু গোলমাল বাঁধে একদম শেষ এ গিয়ে। আমি ভুল করে লম্বা একটা শর্টের একদম শেষ তিন সেকেন্ড এর আগে শ্বাস নিয়ে ফেলি। কেঁপে ওঠার জন্য আমার এই শর্টটাই বাদ দিয়েছিলেন আগের ছবির পরিচালক- কারন এর আগে প্রায় ১০ মিনিটের শর্ট নেইয়া হয়ে গিয়েছিল এবং তাতে খরচ হয়ে গিয়েছিল প্রায় দুই লাখ টাকার কাছাকাছি। তাই আমাকে একদম একটা বাজে মরা র পার্ট করতে দেন করুনা করে। এই একটা পার্টের জন্য আমাকে বর্তমান ছবির পরিচালক এর কাছে ধরনা দিতে হয়েছে অনেক বার। হাতে পায়ে ধরে টাকা না নেবার শর্তে আমি রাজি হই এই মরার ভুমিকায় অভিনয় করতে। কোন কারনে আমার ভুল হলে টাকা দেবেন না আমাকে এই শর্তে আমি এখন শুয়ে আছি এই ফ্লোরের নকল স্টেজ এর একপাশে একটা কফিনের সাথে হেলান দিয়ে।

অনেক বার অনুরোধের পর এই রোল আমি পেলেও এতে অনেক রিস্ক ছিল। কারন আমার শরীরে একটা ইঞ্জেকশন নিতে হয়েছে আমার সকল পেশিকে ঘণ্টা খানেক এর জন্য অলস করে দেবার জন্য। এই ইঞ্জেকশন নেবার পর প্রায় মিনিট বিশেক কেটে গেছে। এর মাঝে আমার হার্ট বিট কমে দাড়িয়েছে মোটে ৩০ এর ঘরে। খুব ধীরে ধীরে শ্বাস নিচ্ছি আমি। নিচ্ছি না- নিতে বাধ্য হচ্ছি। কারন আমি মরার মত পড়ে আছি চারটা ক্যামেরার সামনে। শর্ট টেক শেষ হলে ই আমাকে আরেকটা ইনজেক্ট করে ঠিক করে দেয়া হবে- এমনটাই বলেছেন ছবির পরিচালক ইসহাক সাহেব।আমি প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম-কিন্তু শেষে চিন্তা করলাম- অনাথ পরিবারের সন্তান আমি – কিছু টাকা পেলে এই মাসটা কিছুটা শান্তিতে কেটে যাবে। কাজটা না পেলে আমার আগের খারাপ রেকর্ডের কারনে আমাকে না খেয়ে থাকতে হবে প্রায় সারা মাস। এর চেয়ে কয়েক ঘণ্টায় হাজার দশেক টাকা পাওয়া যাবে ভেবে এই লাশের ভুমিকায় আমি পড়ে আছি। দেখতে হয়তবা সত্যিকারের লাশের মতই লাগছে আমাকে।

শর্ট টা ছিল এরকম যে কিছু লাশ পড়ে থাকবে এদিক সেদিক। একটা টেবিলে অনেক গুলো অস্ত্র থাকবে- যেমন চাপাতি ছুড়ি ইত্যাদি। এর মাঝে একজন কসাই এসে লাশ গুলো কাটতে শুরু করবে। আমাকে ইসহাক সাহেব অভয় দিয়েছিলেন এই বলে যে এই কসাইয়ের ভুমিকায় তিনি নিজে অভিনয় করবেন। উনি আমাকে কথাটা বলে উপরে বেশ গর্ভবোধ করলেও ভেতরের খবর হল -ডামি হলেও কোন লাশের হাত পা কাটতে কোন কেউ রাজি হয়নি। উনার বাজেট ও এমন নেই যে কেউ সাধে এসে রাজি হবে। আমার মতই তিনি ও খরচ বাঁচাতে নিজেই অভিনয় করতে যাচ্ছেন। উপরে উপরে খুশি হলে ও ভেতর ভেতর কেমন যেন ভয় পাচ্ছিলাম-কারন শক্তিমান অভিনেতা শাকিল খান পর্যন্ত এই ছবিতে অভিনয়ের অফার ফিরিয়ে দিয়েছেন এতে বাজেট খুব কম বলে।আর শাকিল খানের মত অভিনেতার কি দায় পড়েছে যে উনি একটা কসাইয়ের ভুমিকা করবেন- তাও সব অখ্যাত মানুষের ভিড়ে? তাই কাউকে রাজি করাতে না পেরে শেষে নিজেই শুরু করলেন অভিনয় পরিচালক ইসহাক সাহেব।

অ্যাকশন শব্দ শোনার কিছুক্ষন পর অভিনয়ের এলাকায় প্রবেশ করল কসাই।কিন্তু ইহসান খান কে ছাপিয়ে গেছে কসাইয়ের অভিনয়। আর মেকআপ এত ভাল হয়েছে যে আমি ই চিনতে পারছিনা। বয়স এক লাফে ৪৫ থেকে নেমে এসেছে ২৫ এর কোঠায়। আমি আগেই বলে রেখেছিলাম ইহসান খান কে যে আমি লাশের ভুমিকায় অভিনয় করলে ও চোখ খোলা রাখবো। প্রথমে গাইগুই করলেও পরে রাজি হন তিনি দুই ডোজ ঔষধ ইঞ্জেকশন দেবেন এই শর্তে। মেকআপ রুম থেকে লাশের মেকআপ আর কস্টিউম পড়ে যখন উনার রুমে গেলাম তখন উনি মাত্র মেকআপ নিচ্ছেন। আমি যাওয়ার পর তিনি নিজেই আমার হাতে ইনজেকশন দিলেন। এটা পুশ করা মাত্রই মনে হয়েছে আমার শরীরের একটা পেশী ও কোন কাজের না। সব যেন একটা একটা করে ঘুমিয়ে পড়েছে। সেই থেকে আমি শুয়ে আছি এই কাঠের বাক্সের উপর। কোনরকমে চোখ মেলে তাকাতে পারছি। মস্তিষ্ক কাজ করছে-কিন্তু অনেক কিছু বুঝতে সমস্যা হচ্ছে। কানে ভালই শুনতে পারছি। বস্তুতই একটা লাশের মত অবস্থা আমার।তিনজন লোক আমাকে ধরে এই খানে শুইয়ে দিয়েছে। এরপর শুরু হয়েছে ক্লান্তিকর অপেক্ষা।

ভৌতিক পরিবেশ বেশ ভালভাবেই জমিয়েছে ইহসান খানের স্টেজ শিল্পীরা। চারপাশে ধোয়া ধোয়া অন্ধকার। একটা হালকা আলো ছড়িয়ে পড়েছে আমি সহ তিন লাশের ডামির উপর। আর কোন আলো ছিলনা। আর এখন আরেকটা লালচে আলো এখন ইহসান খানের উপর। ইহসান খানের পোশাকটা ও সেই রকম ভয়ঙ্কর। মনে হচ্ছে কোন এক ইংরেজি মুভি থেকে ঊঠে এসেছেন মৃত্যুপুরীর কসাই।বেশ পরিণত মেকআপ। আমি ও চিনতে পারছিনা ভাল মত। সেটে এসেই ইপুন অভিনয় শুরু করে দিয়েছেন। একটা টেবিলের উপর সাজানো ছিল নানা রকম অস্ত্র ও সরঞ্জাম। সেখান থেকে একটা চাপাতি তুলে নিয়ে নিখাদ কসাই এর মত ধার পরীক্ষা করলেন চোখ দিয়ে। তারপর টেবিলে রাখা একটা ডামি র পায়ের নিচ দিক থেকে কাটতে শুরু করলেন। বাহ কি নিপুন অভিনয়। যেন ইহসান খানের জন্মই হয়েছে কসাই এর ভুমিকায় অভিনয় করার জন্য।

সেটে সুনসান নিরবতা। শুধু কসাই এর একটানা থপথপ মাংস কাটার শব্দ শোনা যাচ্ছে। টেবিলের উপর রাখা একটা কাটা পা কে কেটে পাঁচ টুকরা করলেন কসাই সাহেব।যে এই হাড় বানিয়েছে তার জুড়ি মেলা ভার।আমি দশ হাত দূর থেকে হাড়ের সাদা অংশ আর চুইয়ে পড়া রক্তের মাঝে লালচে মাংস দেখতে পাচ্ছি। আজ থেকে ইহসান সাহেব কে এই নামেই ডাকবো আমি। অন্তত আমি এই অভিনয় করতে পারতাম না। একবার ও কাট না বলে এভাবে একটানা অভিনয় করা সহজ কথা না।

উফ আর পারলাম না। চোখের পাতা নবম বারের মত বন্ধ করে আবার খুললাম আমি। এবং সাথে সাথে ভয়ঙ্কর ভাবে কসাই আমার দিকে তাকাল। এই প্রথম মনে হল এই চোখ ইহসান খানের চোখ নয়। আমি ইহসান সাহেব কে ভালভাবেই চিনি। ইনি ইহসান খান হতেই পারেন না। হয়ত অভিনয়ের আগে উনি আরেকজন অভিনেতা পেয়ে গেছেন। কিনবা অন্য কোন মানুষ চলে এসেছে সেট এ। আমার দিকে খানিক টা তাকিয়ে থপ থপ করে আমার সামনে এসে আমাকে পাজকোলা করে নিয়ে গেল ফেলল বড় টেবিলটার উপর। তারপর একটা ছুড়ি দিয়ে আমার গায়ে পড়া টিশার্ট ছিড়ে ফেলল দুই ভাগ করে। কথা ছিল এরপর একটা ধামা নিয়ে কোপ দেবার আগেই ইহসান সাহেব কাট বলে শর্ট শেষ করবেন। কিন্তু কসাই বাবাজি বোধহয় ভুলে গেছে আমার টিশার্ট কাটার সময় আস্তে করে ছুড়িতে চাপ দেবার কথা। এত জোরে চাপ দিয়েছে ছুড়িতে যে আমি নিজেই বুঝতে পারছি ছুড়ির একটা কোনা লেগে আমার বুকের কাছটায় সৃষ্টি হয়েছে একটা লাল দাগ। আমি বেশ ব্যাথা পেলাম। কিন্তু এই সময় কোনভাবেই শ্বাস নেয়া যাবেনা। তাই মরার মত পড়ে রইলাম আমি। টিশার্ট ছিড়েই হিংস্র একটা হাসি দিল কসাই। শুনেই বুকের ভেতরটা দুপদুপ করে উঠল। তারপর একটা ধামা হাতে নিয়ে ভালমত ধার পরীক্ষা করে একটা হাসি দিল সে। এবং মাথার উপর ধামাটা ধরে কোপদিতে যাবে এমন ভঙ্গিতে দাঁড়াল কসাই- এবং শর্ট শেষ।

কিন্তু না-কাট শব্দটা কেউ চিৎকার করে আগের মত বল্লনা। কেউ কাট শব্দটা এখন ও বলছেনা। পরিচালক যদি আমার সামনে কসাই এর ভুমিকায় হয় তাহলে সে কেন কাট বলছে না? সে কেন আস্তে আস্তে ধামা নামিয়ে আনছে আমার ডান পায়ের গোড়ালির দিকে? কেউ কাট বলেনি –তাই ক্যামেরা রোলিং করে চলেছে। এবং আস্তে আস্তে ধামাটা নেমে আসছে আমার পায়ের দিকে। আমি বুঝতে পারছি কোন একটা দারুন ভুল হতে চলেছে।কিন্তু আমি মুখ নাড়াতে পারছিনা। আমি কিছু বলে ঊঠার আগেই ধামাটা এসে কোপ বসাল আমার ডান পায়ে। এবং এক কোপে আমার পায়ের একটা অংশ কেটে ফেলল কসাই। উফ তীব্র যন্ত্রনায় আমার মাথা থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত কেঁপে উঠল। আমার হার্ট বিট বেড়ে গেল প্রচন্ড গতিতে। রক্তের ধারায় ভিজে গেল আমার আরেকটা পা। আমি টের পাচ্ছি গরম তরলের অবিরাম ধারা-বের হয়ে যাচ্ছে আমার শরীর থেকে। কিন্তু আমি আমি কাউকে জানাতে পারছিনা। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে আমার দেহ। আমার দিকে আরেকবার তাকিয়ে আবার ধামা তুলে ধরল কসাই। এবার ধামাটা এগিয়ে আসছে আমার গলার দিকে। আমি শেষ বার নিঃশ্বাস নিলাম প্রাণ ভরে। ঠান্ডা বাতাসে শেষ ছোয়া এসে ভরিয়ে দিল আমার ছটফটে ফুসফুস …

পরদিন আবার শ্যুটিং এর সেট ফেলা হয়েছে এফডিসির পাঁচ নম্বর ফ্লোরে।চার নম্বর ফ্লোরে “তুমি আমার প্রেম” সিনেমার গানের শ্যুটিং হবে। তাই পাঁচ নম্বর ফ্লোরে সেট সাজানোর জন্য টিম প্রস্তুত।“কসাই” ছবির পরিচালক ইহসান খান নিজে এসে বুঝিয়ে দিলেন ডিজাইনার দের কিভাবে সাজাতে হবে।ওদের দেয়া হয়েছে চাপাতি, ধামা সহ অনেক গুলো অস্ত্র। সাথে নকল হাত ,পা, রক্ত ইত্যাদি। একটা কম বয়সী ছেলে আজ এসেছে এখানে সেট সাজাবার জন্য। সে এক মনে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছে একটা কাটা মাথার দিকে। প্রথমে চিনতে পারেনি। কিন্তু পরে চিনেছে এটা নতুন অভিনেতা নিয়াজ মোরশেদ এর মত। যেই বানিয়েছে অবিকল বানিয়েছে। গতমাসে নিয়াজ মোরশেদের সাথে প্রথম দেখা। একটা পার্ট দেবার জন্য অনেক ধরেছিল। তাই ইহসান খানের কাছে নিয়ে গিয়েছিল সে। এই কথা গুলো ভাবতে ভাবতে তন্ময় হয়ে গিয়েছিল সে- হটাত ইহসান সাহেবের ধমক খেয়ে মাথাটা টেবিলের উপর রেখে আবার কাজে মন দিল সে। এরপর কাটা হাত পা গুলো আংটা দিয়ে দেওয়ালের সাথে ঝুলাতে ব্যাস্ত হয়ে গেল সে …
READ MORE - চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার

বর্ষণ মুখর একটা সন্ধ্যা।

বর্ষণ মুখর একটা সন্ধ্যা।
৭ টা বেজে ৩১ মিনিট।
সেই সকাল থেকে ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে। ইউনুস মিয়া তার বাগান বাড়ির পাশে যে শান বাঁধানো পুকুর ঘাট
আছে সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন। জমাট অন্ধকারে একা, মাথার উপর শরিফ মার্কা ছাতা ধরা। গায়ে সাদা পাঞ্জাবি। ভয়ে বেচারার মুখ পাংশু হয়ে আছে।
গ্রামে বিদ্যুৎ থাকলেও ইউনুস মিয়া তার এই বাগান বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ লাগান নাই। কারন এতে তার বড় ভাই ইউসুফের কড়া নিষেধ আছে। ইউসুফ আলো সহ্য করতে পারেন না, তার অন্ধকার খুব প্রিয়।
পুকুর ঘাটে দুই পা তুলে ইউসুফ বসে আছে, দুই হাত বুকের সামনে কাঙ্গালের মত ভাঁজ করে ধরা। একটা মাত্র আধ ছেঁড়া লুঙ্গি পরা সে। বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে গেছে। কপাল বেয়ে পানি নামছে সরু ধারায় সে দিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই, ইউসুফের মেজাজ অনেক বেশি কড়া। এই যেমন এখন খুব কড়া হয়ে আছে ছোট ভাই ইউনুসের উপর।
ইউনুস একটু কেশে আবার বলল “ভাইজান, মিসির আলি নামের এক ভয়ানক বুদ্ধিমান মানুষ আমার বাড়িতে এসেছেন, আমি ভাবতেছি আপনার সমস্যার কথা উনাকে বলব”।
ছোট ভাইয়ের ঔদ্ধত্তে ইউসুফ একটু বিরক্ত হলেন। চোখ তুলে চাইলেন ছোট ভাইয়ের দিকে। বড় ভাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা ভয়ে হিম হয়ে গেল ইউনুসের। এই অন্ধকারেও বিড়ির আগুনের মত জ্বলছে ইউসুফের চোখ।
ইউসুফ শ্লেষ মেশানো কণ্ঠে বললেন, আমার কোন সমস্যা নাই। তুমি ওকে বলতে পার, তবে লাভ নাই। গতবার তো ঐ স্কুল মাস্টারকে বলচিলা। মনে নাই ঐ স্কুলের মাস্টারকে কিভাবে মারছিলাম? বলেই কেনা কেনা কণ্ঠে উচ্চস্বরে হেসে উঠল ইউসুফ। সেই হাসি যেন ইউনুসের বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল।
ইউনুস অতিদ্রুত বলে উঠল, “মিসির আলি সাহেব ভয়ানক বুদ্ধিমান, সে ঐ স্কুল মাস্টারের মত বোকা না, আপনি তার বুদ্ধির সাথে পারবেন না”।
ইউসুফ একদলা থু থু ফেলল ঘাটের পাকা ফ্লোরে। তারপর বলল “ও আচ্ছা, তাই নাকি? ঠিক আছে তাকে যেভাবেই হোক এখানে নিয়া আস। দেখা যাক”।
বলেই ইউসুফ আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে পুকুরের পানিতে নেমে গেল। হাঁটু পানি থেকে কোমর পানি, কোমর থেকে গলা- একসময় পুরো শরীর ডুবে গেল পুকুরের কাল জলে।
ইউনুস কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল পুকুরের দিকে তারপর অন্ধকার বাগান বাড়ি থেকে ধিরে ধিরে পা বাড়াল মূল বাড়ির দিকে।
মিসির আলি সাহেব টিনের তৈরি আধাপাকা ঘরের বারান্দায় বসে আছেন। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে টিপটিপ করে। মিসির আলী সাহেবের টিপটিপ বৃষ্টিই খুব পছন্দ। টিপটিপ বৃষ্টির দিয়েছেন অলস বৃষ্টি! বয়সের কারনে তার নিজের গতিও একটু মন্থর হয়ে গেছে- আর সেই কারনেই অলস জিনিস ইদানিং কালে ভাল লাগছে তার। লক্ষন ভাল না।
গ্রামে গ্রামে এখন বিদ্যুতের ছড়াছড়ি, এই বাড়িতেও বিদ্যুৎ আছে। তবে মিসির আলি সাহেব বারান্দার লাইট অফ করে দিলেন। কারন বিদ্যুতের আলোয় বৃষ্টি দেখতে ভাল লাগেনা। কই যেন পড়েছেন চাঁদের জ্যোৎস্না দেখতে হয় খোলা মাঠে আর রাতের বৃষ্টি দেখতে হয় অন্ধকারে বসে! মিসির আলী অনেক চেষ্টা করলেন কথাটা কার মনে করতে কিন্তু পারলেন না। স্মৃতি বেঈমানি কারা শুরু করে দিয়েছে। লক্ষন ভাল না।
বেতের চেয়ারে দুই পা তুলে বসলেন মিসির আলি। হাতে ধোঁয়া উঠা এক কাপ লাল চা। চায়ে একটু লবন দেওয়া, তবে খেতে ভালই লাগছে তার।
মিসির আলি একটা সিগারেট ধরালেন। বাইরে হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। তিনি বৃষ্টি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তারপর হঠাৎ একটা কবিতার দুই লাইন আবৃতি শুরু করলেন “আয় বৃষ্টি ঝেপে, ধান দিব মেপে” এই দুই লাইনই উনি আবৃতি করতে থাকলেন।
মিসির আলী এই পুরা কবিতাটা মুখস্থ পারেন, তার স্মৃতি শক্তি ভাল। তবুও কেন তিনি শুধু এই দুই লাইন আবৃতি করছেন তা বুঝতে পারলেন না।
এই অজপাঁড়া গাঁয়ে এসেছেন একটা বিয়ের দাওয়াতে, কিন্তু শহরে ফেরার আগেই বৃষ্টি শুরু। রাস্তায় পানি উঠে যাওয়ায় বাস চলাচল বন্ধ, তাই শহরে ফিরতে পারেন নি। বিয়ে বাড়িতে অনেক লোকজন। তাদের থাকার বেবস্থা হল প্রতিবেশিদের বাড়িতে। মিসির আলীর দায়িত্ব পড়ল ইউনুস সাহেবের ঘাড়ে।
ইউনুস সাহেব একজন অবস্থা সম্পন্ন মানুষ। গঞ্জে বিরাট দোকান পাট আর গ্রামে তো জমিজমার অভাব নাই। সব অবস্থা সম্পন্ন মানুষের মধ্যে যেমন একটু অস্বাভাবিকতা লক্ষ করা যায় ইউনুস সাহেবও তার বেতিক্রম নন। পঞ্চান্ন বছরের এই লোকটি কখনই মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারেন না!
এটা নিজে মিসির আলী একটা লজিক দাঁড় করেছেন। হতে পারে এই লোকটির পুরানো পাপ আছে মনে, তার ভয় হয় তার চোখের দিকে তাকালে সবাই বুঝে ফেলবে যে পাপটা উনিই করেছেন!
ইউনুস সাহেবকে নিয়ে এইধরনের চিন্তা করেছেন বলে মিসির আলী একটু লজ্জিত হলেন। ইউনুস লোকটা যথেষ্ট অমায়িক এবং মিশুক।
মিসির আলির সিগারেট শেষ হয়ে গেল, তিনি আবার একটা সিগারেট ধরালেন। চায়ের খালি কাপটা মেঝেতে রাখলেন। তারপর ঘড়ি দেখেলেন, রাত ৯ টা। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। টিনের চালে শব্দ হচ্ছে অবিরত। ইউনুস সাহেব মিসির সাহেবের ফরমাশ খাটার জন্য পাশের বাড়ির একটা ছেলেকে ডেকে এনেছেন। ছেলের নাম মতিন। তবে মতিন এই মুহূর্তে বারান্দার মাটিতে বিছানা পেতে শোয়ার সাথে সাথেই গভীর ঘুমে চলে গেল। গ্রামের মানুষ খুব দ্রুত ঘুমাতে পারে। মতিন ঘুমে বিছানায় কাত হয়ে ফোঁস ফোঁস করে ঘুমাচ্ছে। ঘুমন্ত মানুষের দিকে তাকাতে ভাল লাগে মিসির আলির। কারন সেই সময় মানুষের মুখ থেকে সকল দুশ্চিন্তা সরে গিয়ে স্বর্গীয় আবেশ চলে আসে। মিসির আলি পরম মমতায় তাকালেন মতিনের দিকে। পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে ছেলেটা।
মিসির আলি ঠিক করলেন ইউনুস সাহেবকে বলে একে মিসির আলি ঢাকায় নিজের কাছে নিয়ে যাবে। তিনি ছেলেটিকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিবেন। তবে ছেলেটির পড়াশোনায় আগ্রহ একেবারে কম। গ্রামের স্কুলে যায় মাসে দুই তিন দিন, এখনো সে ক্লাস টু পাশ দিতে পারে নাই। সে গত ৪ বছর ক্লাস টু তে, এটা নিয়ে সে গর্বিত। তাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়-“কিরে মতিন কোন ক্লাসে পড় তুমি??”
মতিন অনেক গর্ব করে উত্তর দেয় “ কেলাশ টু তে পড়ি”!!
সে ফেল করবে তবু স্কুল ছাড়বে না, আবার স্কুলে নিয়মিত যাবেও না।
এমন সময় ইউনুস সাহেব বারান্দায় ঢুকলেন। লোকটা পুরোপুরি ভিজে গেছেন। মিসির আলী একটু অবাক হলেন কারন ইউনুস সাহবের হাতে একটা প্রায় নতুন ছাতা আছে! তবে মিসির আলি কিছু বললেন না। শুধু চেয়ার থেকে পা নামিয়ে বসলেন।
“স্যার, আপনে বসেন, পা নামানোর দরকার নাই”,বললেন ইউনুস সাহেব।
মিসির আলি একটু বিব্রত বোধ করলেন, এই বয়সের একজন মানুষ তাকে স্যার বলে ডাকে এটা শুনতেও একটু অন্যরকম লাগে।
মিসির আলি মৃদু হেসে বললেন- সমস্যা নেই। আপনি যান, কাপড় চেঞ্জ করেন, ঠাণ্ডা লেগে যাবে।
ইউনুস সাহেব ভিতরে চলে গেলেন, মিসির আলি আবার পা উঠিয়ে আরাম করে বসলেন।
একটা মজার ব্যাপার হল ইউনুস সাহবের এত বড় বাড়িতে শুধু ইউনুস সাহেব একা থাকেন। বিয়ে করেছিলেন তবে বউ বিয়ের দুই মাসের মাথায় চলে যায় আর ফেরত আসেনি, ইউনুস সাহবও বিয়ে করেন নি। পাশের বাড়ি থেকে মতিনের মা এসে রান্না করে দিয়ে যায়। এত বড় বাড়িতে ইউনুস সাহব কিভাবে থাকেন তা ভাবতেই একটু অবাক হলেন মিসির সাহেব। কোথায় যেন একটু অস্বাভাবিকতা আছে একটু। মন বলছে “ সাবধান, মিসির আলি সাবধান”!!
রাত ১০ টা।
সামনা সামনি দুইটা বেতের চেয়ারে বসে আছেন মিসির আলি আর ইউনুস সাহেব। যথারীতি ইউনুস সাহবের চোখ নিচের দিকে। পাশে এখনো মতিন ঘুমাচ্ছে বেঘোরে। বারান্দায় দুটা পাঁচ টাকা দামের মোম বাতি জ্বলছে। বাইরে বৃষ্টির বেগ বাড়ছে ধিরে ধিরে। বাতাসে মোমের শিখা তিরতির করে কাঁপছে। বারান্দায় গভির নিস্তব্ধতা ভর করেছে।
মিসির আলি একটু অস্বস্থি বোধ করলেন। শেষে তিনি নিজেই নিরবতা ভংগ করলেন- আপনাদের গ্রামটা অনেক সুন্দর। আমার ভাল লেগেছে।
ইউনুস সাহেব চোখ তুলে একটু মিসির সাহেবের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে ফেললেন। বললেন- জ্বী, ঠিক বলেছেন স্যার।
আবার নিস্তব্ধতা নেমে এল, মিসির আলি সাহেব এবার সত্যি সত্যি অস্বস্থিতে পড়ে গেলেন। তবে এইবার নিরবতা ভংগ করলেন ইউনুস সাহেব- “স্যার, আমি আপনার কথা অনেক শুনেছি, আপনি অনেক বিজ্ঞলোক এটা আমি জানি। আমার একটা সমস্যা আছে।
মিসির আলি এবার নড়ে চড়ে বসলেন, একটা বেনসন ধরালেন তিনি। তারপর বললেন- হ্যাঁ, অবশ্যই বলুন। আমি শুনছি।
ইউনুস সাহেব একটা পুরাতন ছবি দিলেন মিসির আলিকে। তিনি ছবিটা নিয়ে মোমের আলোতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন। একজন যুবকের সাদাকাল ছবি। চেহারায় কিছুটা কাঠিন্য আছে যা ইউনুস সাহেবের চেহারায় অনুপস্থিত।
ইউনুস সাহেব মাটির দিকে তাকিয়ে শুরু করলেন- এটা আমার বড় ভাইয়ের ছবি। আজ থেকে ঠিক বত্রিশ বছর আগের, তার নাম ইউসুফ। আমার থেকে তিন বছরের বড়। আমাদের দুই ভাইয়ের মদ্ধে অসম্ভব মিল ছিল। আমি বয়স তখন বিশ কি একুশ বছর। আমরা দুই ভাই বাপের ব্যবসা দেখাশোনা করি। বাপের বিরাট কারবার ছিল গঞ্জে। রাতের বেলা আমরা দুই ভাই পালা করে দোকানে থাকি। আমার মা অনেক আগেই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। বাবা অনেক সখ করে ঐ পাশের বাগান বাড়িটা করেছিলেন।
আমাদের বাড়িতে আমি, আমার ভাই ইউসুফ, বাবা ছাড়াও একজন অন্য মানুষ থাকতো। তার নাম ছিল মনি, আমার এক খালাত বোন। বাপ মা মরা মেয়ে ছিল সে। তাই আমার বাবা ওকে আমাদের বাড়িতে এনে রাখেন। ইচ্ছা মনি বড় হলে তাকে বিয়ে দিবেন। মনির তখন প্রায় সতের আঠার বছর। দেখতে অনেক রুপবতি ছিল মনি। মনি সেই ছোট বেলা থেকে আমাদের বাড়িতে মানুষ, আমরা এক সাথে বড় হয়েছে।
বাবা অনেক দেখে একটা ভাল সমন্ধ ঠিক করলেন মনির জন্য। ছেলেও গঞ্জে ব্যাবসা করে। বিয়ে প্রায় ঠিক তখন।
সে দিন এমন এক বৃষ্টির রাত। আমি গঞ্জের দোকানে। রাতে ঐখানে থাকব। বাইরে অনেক ঝড়। দোকানে আমি একা থাকি। রাতের বেলা সব কর্মচারীর ছুটি থাকে। গঞ্জ থেকে আমাদের বাড়ি প্রায় ৩ কিলো দূরে।
সেই রাতেই মনি আমার বড় ভাই ইউসুফের সাথে পালিয়ে গেল। বুঝলাম ভাইয়ের সাথে মনির মন দেওয়া নেওয়া ছিল অনেক আগ থেকেই।
মিসির সাহেব, আপনি কি আমার কথা শুনছেন?
মিসির আলি তন্ময় হয়ে শুনছিলেন। কিছু প্রশ্ন এসেছে মনে- এই যেমন, ইউনুস সাহেব বললেন যে তাদের দুই ভাইয়ের মদ্ধে অনেক মিল ছিল তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই বড় ভাইয়ের প্রনয়ের কথা তার আগে থেকেই জানার কথা! যাই হোক, মিসির আলি আর প্রশ্ন করলেন না। তিনি একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন- হু, বলেন আমি শুনছি।
মিসির আলির সাড়া পেয়ে ইউনুস সাহেব আবার শুরু করলেন- “আমার বাবা তখন ছেলের জন্য পাগল প্রায় হয়ে গেলেন, আমার বাবা অতি ভাল মানুষ ছিলেন। ভাই যদি বলত যে ও মনিকে বিয়ে করতে চায় তাহলে বাবা নির্দিধায় রাজি হয়ে যেতেন কোন ভুল নাই। বাবা তখন ব্যাবসা বাণিজ্য পুরা ছেড়ে দিলেন। সারাদিন বাগান বাড়িতে থাকেন একা একা। আমি তখন ব্যবসা চালাই। আমরা অনেক জায়গায় লোক পাঠিয়েছি তাদের খোঁজে কিন্তু ওদের পাইনি কোথাও। এভাবে প্রায় বছর খানেক চলে গেল।
একদিন সন্ধ্যায় বাবা আমাকে বাগান বাড়িতে ডেকে বললেন, “আমি সপ্নে দেখেছি তোর ভাই আর মনি আর এই দুনিয়াতে নাই। ওরা দুজন আমাকে ডাকছে। আমার সময় বুঝি শেষ হয়ে গেলরে বাপ”, বলে কান্নাকাটি শুরু করলেন।
আমি তেমন গুরুত্ব না দিয়ে দোকানে চলে গেলাম। পরদিন সকালে বাবার মৃত দেহ পাওয়া গেল বাগান বাড়ীর পুকুরে! রাতের বেলা যে কোন কারনে হোক বাবা পুকুরে নেমেছিলেন তারপর আর উঠে আসতে পারেন নি।
মিসির আলি এইবার একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারলেন না- “কোন থানা পুলিশ হয়েছিল?
ইউনুস সাহেব একবার চোখ উঠিয়ে আবার নামিয়ে ফেললেন। বললেন- আসলে তখন তো থানা এত কাছে ছিল না, পুলিশে খবর দিতে অনেক সময় লাগত, তা প্রায় আট দশ ঘণ্টার পথ ছিল সেটা। তাই গ্রামের ইমাম সাহেব সহ আমরা লাশ দাফন করে দেই। জানেন তো মৃত দেহ বেশি সময় মাটির উপরে রাখা ঠিক না, এটা মৃতের আত্মা কষ্ট পায়।
মিসির আলি সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ফেলে দিলেন, বললেন- হুম সেটা জানি। আচ্ছা ঐ ইমাম সাহেব কই আছেন এখন যিনি আপানার বাবাকে দাফন করেছিলেন?
ইউনুস সাহেব বললেন- ঐ ইমাম ভিনদেশি মানুষ ছিলেন, ওনার বাড়ি ছিল রংপুর, তিনি একদিন রাতে কাউকে কিছু না বলে চলে যান, ওনার বাড়ির ঠিকানা আমাদের কারো জানা ছিল না। উনিও আর কোনদিন ফিরত আসেন নি।
মিসির আলি বললেন- আচ্ছা খুব ভাল, তারপর?
ইউনুস সাহেব বললেন- পরপর আমার তিনজন পরিবারের মানুষকে হারিয়ে আমি একটু বিবাগি হয়ে যাই। ব্যাবসা বাণিজ্য ছেড়ে দেই কর্মচারীদের উপর, আমিও বাবার মত ঐ বাগান বাড়িতে আশ্রয় নেই। সারাদিন সারারাত ওখানেই থাকতাম। আমার খুব মন খারাপ হতো, আমি বাবা বাবা করে কাঁদতাম। এভাবে কত দিন গিয়েছিল জানি না হটাৎ এক গভির রাতে আমি বাগান বাড়ির বারান্দায় বসে ছিলাম। তখন শীত কাল। বাইরে তখন ঘন কুয়াশা, কুয়াশার কারনে আকাশের চাঁদ দেখা যায় না ঠিক মত। আমি কাঁদছি। হঠাৎ দেখি সেই কুয়াশা ভেদ করে একজন মানুষ এসে দাঁড়াল আমার সামনে। অন্ধকার আর চাঁদের আলোর লুকচুরির কারনে লোকটাকে বুঝা যাচ্ছে না, তবে এটুকু বুঝতেসি লোকটির সারা শরীর পানিতে ভেজা!
আমি অবাক হয়ে গেলাম, কারন এ দিকে শীত অনেক বেশি পড়ে আর এই শীতের রাতে কেউ একজন খালি গাঁয়ে মাত্র একটা লুঙ্গি পরে থাকতে পারে না দেখলে বিশ্বাস করার মত না।
আমি বললাম- কে? কে ওখানে?
লোকটা জবাব দিল- আমি তোর বড় ভাই ইউসুফ, তুই আমার সাথে আয়। বলে লোকটা উল্টো হাঁটা দিল। আমার মনে তখন অনেক আনন্দ! আজ এত বছর পরে আমার ভাই এসেছে!! ভাইকে পাবার আনন্দে তখনকার অস্বাভাবিক ব্যাপার গুলো চোখে পড়ল না। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত হাঁটা ধরলাম ভাইয়ের পিছে পিছে।
দেখি আমার ভাইটি বাগান বাড়ির গাছের ফাক দিয়ে আস্তে আস্তে পুকুরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমিও গেলাম। দেখি ভাই আস্তে আস্তে হিম শীতল পানিতে গলা পর্যন্ত নেমে গেল। আমি পুকুর পাড়ে এসে দাঁড়ালাম।
আমার ভাই তখন আমাকে বলল- “ইউনুস, আমি ফিরা আসছি।
আমি বললাম- ভাই এদ্দিন তুমি কই ছিলা?
ভাই আমার কথার জবাব না দিয়ে বলল- “ইউনুস, আমি আর মনি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার পরে একটা রাস্তায় আমাদের ডাকাত ধরল। তারপর ওরা আমাকে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দিল আর মনিকে কোথায় যেন নিয়ে গেল। সেই থেকে আমি পানি ছাড়া থাকতে পারি না। আমি এখন থেকে এই পুকুরেই থাকব।
আমার তখন ভয়ে হাত পা বরফ হয়ে গেছে। আমি একটা ঢোক গিলে বললাম- মরে গেছ মানে কি?
ভাই একটু খন খনে গলায় বলল- মরে গেছি মানে মারা গেছি। ইন্তেকাল করছি। এইবার বুঝচস?
আমার তখন অবস্থা খারাপ। আমি কোনমতে বললাম- আচ্ছা ঠিক আছে। তোমার যতদিন ইচ্ছে থাকবা। সমস্যা নেই।
ভাই হেসে বলল- তুই ভয় পাইস না, আমি তোর কোন ক্ষতি করব না, তুই শুধু আমি যা যা বলি তাই করবি। এই পুরো বাগান বাড়ির পাশে দেওয়াল তুলে দিবি যেন কেউ না আসতে পারে, আর এই পুকুরের পশ্চিম পাশে একটা পাকা ঘাটলা তুলে দিবি। আমি রাতের বেলা ওখানে বসে আরাম করব। আর শোন আমার কথা কাউকে বলবি না যেন, নাহলে তোর ক্ষতি হবে আর যাকে বলবি তাকে আমি মেরে ফেলব আমার নিজের জন্য। মনে থাকে যেন।
আমি বললাম ঠিক আছে ভাই। তারপর আমি পুরো বাগান বাড়ির চারপাশে দেওয়াল তুলে উপরে কাচের টুকরা দিয়ে দেই। আর একটা সুন্দর শান বাঁধানো পাকা ঘাটলা তৈরি করে দেই।
মিসির আলি এবার একটু নড়ে বসলেন। হুম। খারাপ না। ভাল একটা গল্প। যদিও অনেক ফাক ফোঁকর আছে। তবুও গ্রামের একজন সামান্য ব্যাবসায়ি এত সুনিপুনভাবে গল্প ফাঁদতে পারেন তবে বলতে হবে লোকটির মেধা অনেক!
মিসির আলি বললেন- আপনি এই ঘটনা কাউকে বলেছিলেন?
ইউনুস সাহেব বললেন- হু, একজনকে বলেছিলাম, আমাদের গ্রামের স্কুলের অঙ্কের মাস্টার, উনি বললেন ঠিক আছে আমি একরাত পুকুর পাড়ে থাকব, পরদিন সকালে অনাকে মৃত অবস্থায় পুকুরের পানিতে ভাসতে দেখা যায়।
মিসির আলি বললেন- তো আপনি আমার কাছে আসলে কি চাচ্ছেন?
ইউনুস সাহেব একটু কেশে নিলেন। তারপর বললেন- দেখেন মিসির সাহেব, আমি গ্রামে থাকতে পারি কিন্তু আমি বি এ পাশ করেছিলাম সেই সময়ে। আমি দেশি বিদেশি লেখকের অনেক বই পড়ি, সেই সুবাদে আপনারও কয়েকটা বই পড়েছি। আমি জানি আমার ধারনা আমি ঐ পুকুর পাড়ে এক ধরনের হেলুসিনেশান হয়।
হঠাৎ যেন ইউনুস সাহবের গলা কেঁপে উঠল- আমি চাই আপনি আমার এই রোগের চিকিৎসা করে দিবেন, আমি সুস্থ হতে চাই!
মিসির সাহেব কিছু বললেন না। তার মাথায় অনেক কিছু চিন্তা চলছে।
তারপর মিসির সাহেব বললেন- ঠিক আছে, আপনি ঘুমান। আমি কাল ঐ বাগান বাড়িটা দেখব আর কাল রাতে আমি ওখানে থাকব।
পরের দিন মিসির আলির অনেক ব্যস্ত একটা দিন গেল। সারাদিন বৃষ্টি ছিল। তবুও উনি সেদিন গ্রামে মসজিদে গেলেন। মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথে কথা বললেন। গ্রামের কয়েকজন বৃদ্ধ মানুষের সাথে কথা বললেন। দুপুরে গেলেন থানায়। চেষ্টা করলেন কিছু তথ্য জোগাড় করার। একটা অদ্ভুত তথ্য পেলেন তিনি- বাগান বাড়ির ঘাটলা বানানোর জন্য মাত্র একজন লোক রেখেছিলেন ইউনুস সাহেব! আর ঐ লোকটিও ঘাটলার কাজ পুরোপুরি শেষ হবার আগে মারা পড়ে, তার লাশও পাওয়া যায় ঐ পুকুরের পানিতে! এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কেন ইউনুস সাহেব গোপন করলেন বুঝতে পারলেন না মিসির আলি।
বিকেলে যখন ইউনুস সাহেবের বাড়ি ফিরলেন তখন মিসির সাহেব পুরা কাক ভেজা হয়ে গেছেন। শরীর গরম হয়ে আসছে। জ্বর জ্বর ভাব।
ইউনুস সাহেবও জ্বরে পড়েছেন। প্রায় একশ দুই ডিগ্রির মত।
মিসির আলি একটা ফ্লাক্সে কিছু চা আর এক প্যাকেট বেনসন নিয়ে ইউনুস সাহেবকে বললেন “আমাকে আপনার বাগান বাড়িতে রেখে আসুন, আমি আজ রাতে ওখানে থাকব”।
ইউনুস সাহেব মিসির আলিকে বাগান বাড়িতে নিয়ে গেলেন। মূল ফটকে বিশাল লোহার গেট। গেটে এত বড় এক তালা। সেই তালা খুললেন ইউনুস সাহেব। মিসির আলি অবাক হয়ে দেখলেন গেটের চাবি ইউনুস সাহেবের কোমরে একটা কাল সুতা দিয়ে আটকানো, এবং সেখানে মাত্র একটাই চাবি! বুঝতে পারলেন এই চাবি তিনি এক মিনিটের জন্যও হাত ছাড়া করেন না।
মিসির আলিকে বাগান বাড়িতে রেখে ইউনুস সাহেব চলে গেলেন বাড়িতে। যাওয়ার সময় মিসির আলি খেয়াল করলেন ইউনুস সাহেব জ্বরে কাঁপছেন।
রাত আটটা।
মিসির আলি পুরা বাগান বাড়ি দেখা শেষ করলেন মাত্র। এত বড় বাগান বাড়িকে পুরা মৃত নগরির মত মনে হচ্ছে। অনেক আগাছা আর শুকনো পাতায় ভরে আছে জায়গাটা। কতগুলো দিন এখানে মানুষের আনাগোনা নেই ভাবতেই একটু বিস্ময় অনুভব করলেন তিনি।
আকাশে এখন কাল মেঘের খেলা। এই আসছে এই যাচ্ছে। মাঝে মাঝে আকাশের মেঘ ফুঁড়ে পূর্ণিমার চাঁদ উকি মেরেই আবার লুকিয়ে যাচ্ছে।
মিসির আলি আগে থেকেই একটা ছাতা আর একটা চেয়ার নিয়ে রেখে আসেছিলেন পুকুর পাড়ে, শান বাঁধানো ঘাটলার ঠিক অপরপাশে।
মিসির আলি পুকুর পাড়ে গিয়ে চেয়ারে বসলেন। কাঁধের উপর ছাতাটা ফেলে এক কাপ চা নিলেন। চা শেষ করে একটা সিগারেট ধরালেন।
বর্ষাকালে চারপাশে বেঙের ডাকে মুখরিত থাকে, তবে এই পুকুরে কোন বেঙ-এর ডাক শুনতে পাচ্ছেন না তিনি। অবাক করা বিষয়! ব্যাপারটা কেমন ভৌতিক মনে হল।
মৃদু হেসে দিলেন মিসির আলি। তিনি ভূতে ভয় পান না, তবে সাপ খোপে ভয় পান। তাই তিনি মাটি থেকে চেয়ারে পা তুলে নিলেন। শুরু হল অপেক্ষার পালা। তিনি কোন আলো জ্বালাননি। শুধু পকেটে একটা ছোট টর্চ রেখেছেন।
ইউনুস সাহেবের ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছেন মিসির আলি। তিনি একটা সাধারন মানসিক রোগে ভুগছেন। এই রোগের রোগিরা নিজেদের চারপাশে এক ধরনের আলাদা জগত তৈরি করে নেয়। সে জগতে দ্বিতীয় কোন সত্ত্বার প্রবেশ নিষিদ্ধ।
যে খুন গুলো হয়েছে এই পুকুরে সেগুলো একদিক থেকে দেখলে খুবই সাধারন খুব হতে পারে, এতে কোন রহস্য নাই।
যেমন স্কুল মাস্টার খুব সাধারন একজন মানুষ ছিলেন, পরকালে ভয়ানক বিশ্বাস করেন তিনি। এই তথ্যগুলো মাস্টার সাহেবের বাড়ির লোকজন থেকে জেনেছেন মিসির আলি। হয়ত ইউনুস সাহেবের গল্প তার মনে দাগ কাটে, রাতে এই নির্জন বাগান বাড়িতে বেড়াতে এসে তিনি হেলুসিনেশানের জন্য কিছু একটা দেখেন। তারপর পুকুরে লাফিয়ে পড়েন। মাস্টার সাহেব সাঁতার জানতেন না, তাই সহজেই মারা যান।
ইউনুস সাহেবের বাবার ক্ষেত্রেও একই ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। বৃদ্ধ মানুষ ছিলেন উনি তার উপরে পুত্র শোক। তাছাড়া অনেকদিন একা একা এই নির্জন বাগান বাড়িতে থাকার কারনে উনিও একধরনের মানসিক সমস্যায় পড়েন।
মসজিদের হুজুর হয়ত সত্যি সত্যি দেশের বাড়ি চলে গেছেন।
ইউনুস সাহেবের এই রোগ সারাতে হলে প্রথমে প্রমান করতে হবে যে তার ধারনা ভুল, তিনি কোন মৃত ভাইকে দেখেননি। কাল সকালে যখন মিসির আলি অক্ষত অবস্থায় বাড়ি ফিরবেন তখনই একমাত্র তাকে বিশ্বাস করান যাবে।
মিসির আলির এই একটা গুন খুব ভাল, সব সমস্যা আগে সবচাইতে সহজ সমাধান ধরে উনি শুরু করেন। সহজ সমাধান থেকে আস্তে আস্তে জটিলের দিকে যান, এভাবে শুরু করলে কোন পয়েন্ট মিস করবার সম্ভাবনা কম থাকে।
রাত অনেক হল। প্রায় একটা বাজে। মিসির আলি বসে থেকে থেকে কোমর ব্যাথা করে ফেলেছেন। তিনি একটু নড়ে বসলেন। বৃষ্টি অবিরাম ঝরছে, টিপ টিপ শব্দে। পুকুরের পানিতে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে এক চমৎকার শব্দ করছে। মিসির আলি মুগ্ধ হয়ে শুনছেন সেই শব্দ।
এমন সময় পুকুরের পানিতে কিছু একটা আলোড়নের শব্দ শোনা গেল, মিসির আলি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন পুকুরের দিকে। কই? নাতো কিছু না, হয়ত কোন বড় মাছ শব্দ করেছে। মিসির আলি ভাল করে খেয়াল করলেন। এই তো এই তো কিছু একটা নড়ছে পুকুরের ঠিক মধ্যখানে! অন্ধকারে ভাল বুঝা যাচ্ছে না।
জিনিসটা আস্তে আস্তে শান বাঁধানো পুকুরের ঘাটলার দিকে এগিয়ে আসছে! মিসির আলি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না!
কেউ একজন মিসির আলির মাথার ভিতর থেকে আর্তনাদ করে চিৎকার করে বলে উঠল- পালাও, মিসির আলি পালাও!!
READ MORE - বর্ষণ মুখর একটা সন্ধ্যা।

“রাতের অ্যাম্বুলেন্স”

আজ কাজে আসতে কামালের একটু দেরী হয়ে যায় . এখন বাজে সকাল প্রায় ৯ টা ৪৫ মিনিট .
হাজিরা খাতায় সই করতে করতে কামাল একবার আশে পাশে চোখ বুলায় তারপর ঝট করে হাজিরের
ঘরে লিখে ফেলে ৯টা ৩০ মিনটি . তার পর পাশের টেবিলে বসা এক বুড়োকে লক্ষ্য করে বলে-
বুঝলেন কলিম চাচা বউডার শরীর বেশি ভালা না . আট মাস চলতাছে . অনেক চিন্তায় আছি.
বাসায় কেউ নাই যে দেখভাল করবো . কি যে করি ? একটু থেমে আবার বলে -আমারই সব
করতে হয় . তার উপর টাকা পয়সার সম্যায় আছি .
-একটা কামের লোক রাখতে পারো না মিঞা ? পাশের টেবিলে বসে থাকা ৬০ বছর বয়সের বৃদ্ব
কলিম মিয়া কথাটা বলে কিছুটা থামে , তারপর আবার বলে – জানো তো পরপর তিনদিন লেট
হইলে এক দিনের বেতন পানিতে যাইবো . তোমার এ মাসে ওলরেডি ৭ দিন লেট . মানে ২
দিনের বেতন নাই. ব্যাপারটা মাথায় রাইখো .

কামাল কিছু বলে না মাথা নাড়ায় . সে ব্যাপারটা জানে .
সরওয়াদি হাসপাতালের এ্যম্বুলেন্স ড্রইবার হিসাবে গত মাস দু’য়েক আগে যোগ দিয়েছে কামাল . ওর কাজ হলো সারাদিন এ্যম্বুলেস চালান . যেদিন কাজের চাপ থাকে সেদিন এতো বেশি থাকে যে খাওয়া দাওয়ার সময় থাকে না . আর যেদিন কাজের চাপ কম থাকে সেদিন দেখা দু’একটা ট্রিপ মারার পরই বসে বসে ঝিমোতে হয় . তবে কাজের মধ্যেই থাকতে বেশি ভাল লাগে কামালের . তার উপর কখন ও সখন ও দু’পয়সা উপরি পাওয়া যায় . শুরুতে রুগি ,লাশ পরিবহন করতে একটু খারাপই লাগত . কিন্তু এখন তা সয়ে গেছে . ও চিন্তা করে দেখেছে যাত্রী পরিবহন করার চেয়ে রুগি আর লাশ পরিবহন করাই নিরাপদ হাউকাউ চেচামেচি কম করে . সই করে এ্যম্বুলেন্সের চাবির জন্য দোতালায় উঠতেই শান্তি দিদির সঙ্গে দেখা হয়ে যায় . তিনি প্রায় দৈড়ে ৭ নম্বর ওয়ার্ডের
দিকে যাচ্ছিলেন . শান্তি দিদি হাসপাতালের সিনিয়র নার্স . কামালকে বেশ স্নেহ্ করে . ঠিক কামালের মতো দেখতে নাকি তার এক ভাই ছিল .
- কি দিদি কি খবর ?
- ২১ নম্বর রুগির অবস্হা বেশি ভাল না রে . স্যারদের খবর দিতে গেছিলাম . তোর বউ কেমন আছে ? কোন চিন্তা করবি না আমরা আছি . শান্তি দিদি দাঁড়ায় না .
কামাল কিছু বলার সুযোগ না পেয়ে হেসে অফিস রুমে ঢুকে যায় . সেখান থেকে চাবি নিয়ে সোজা বাহার ভাইয়ের চায়ের দোকানে . চাবি নেয়ার মানে কামাল গাড়ি সহ রেডি . কল আসলেই চলে যাবে . বাহার ভাই এর দোকানে কামাল এলাহি ভাইকে দেখতে পায় . আরো কয়েকজনকে নিয়ে বসে চা খাচ্ছে আর হাত নেড়ে নেড়ে কি যেন বলছে . এলাহি ভাই এই হাসপাতালের ড্রাইভার ইউনিয়নের নেতা . তার হুকুম ছাড়া হাসপাতালের একটা গাড়িও চলে না . তার কথাই আইন . কামাল কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে বলে ভাই কেমন আছেন ?
সালামের সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে এলাহি মিয়া বলে – কি ব্যাপার কামাল আজকাল থাকো কৈই ? ইউনিয়িন অফিসে আসো টাস না . শুধু কি রুগিগো সেবা করলে চলবো ? নিজের ভবিষ্যতের দিকে ও তো তাকাইতে হইবো, না কি ? সর্মথনের আশায় এলাহি মিয়া পাশে বসে থাকা অন্য সবার দিকে তাকায় . সবাই মাথা নেড়ে তাকে সর্মথন দেয় .
- লিডার কামাল মিয়ার তো বাচ্চা হইবো . পাশে বসে লম্বা মতো তেল চোরা জহির বলে .
-আবে কামালের বাচ্চা হইবো নাকি ? ক’ওর বউ এর বাচ্চা হইবো . আরেকজন কথাটা বলার সাথে সাথে সবাই হো হো করে হেসে উঠে . কামাল কিচ্ছু বলে না . মুখে হাসি হাসি একটা ভাব করে রাখে . যেন খুব মজা পাচ্ছে .
-বস . চাটা খাও . তয় ভাই বাচ্চা হওনের পর কিন্তু ইউনিয়নের জন্য সময় দিবা . আমি তো শালায় তোমগো লাইগা খাটতে খাটতে শেষ . আর যে কোন দরকারে আমার ফোন দিবা . তোমগো লাইগা আমার জান কোরবান . বলে এরাহি মিয়া দল বল নিয়া চলে যায় .
কামাল বুঝতে পারে আজকের দিনটা ওর বসে বসেই কাটবে . চায়ের দোকানে দীর্ঘ সময় বসে থাকার পর ও কোন কল আসেনা . কামাল উঠে ওর এ্যম্বলেন্সের কাছে চলে আসে . ১৭ নম্বর এ্যম্বুলেন্স . দরাজা খুলে ও এ্যম্বুলেন্সে উঠে রেডিও চালিয় কতোক্ষন খবর শুনে .
এমন সময় সোলেমান এসে একটা ঠিকানা দিয়ে যায় . গুলশান যেতে হবে . রুগী নিয়ে আসতে হবে . কামাল বেড় হয়ে যায় . যাবার সময় একটা কলা আর বন রুটি নিয়ে নেয় বাহার এর দোকান থেকে দুপুরের খাবার হিসাবে খাবে বলে . খাতায় লিখে রাখতে বলে ও টান দিয়ে গাড়ী নিয়ে বেড় হয়ে যায় . হাসপাতালের গাড়ি চালালে আরেকটা সুবিধা হলো রাস্তায় সাজেন্টের সঙ্গে ঝামেলায় পরতে হয় না . কথায় আছে এ্যম্বুলেন্সের সাইরেন শুনলে প্রধান মন্ত্রীর গাড়ীও নাকি সাইট দেয় . কথাটা অনেকটা সত্য .
দেশের অবস্থা খুব একটা ভাল না . হাসিনা-খালেদা দুজনই বন্ধি . কখন কি হয় বলা যায় না . তারাতারি গুলশান থেকে ফিরতে পারলেই দ্বায়িত্ব শেষ করে বাসায় ফেরা যায় . মায়া বাসায় একলা . দুবার এর মধ্যে ওর সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে . মায়া বলেছে ও ভাল আছে . কোন সমস্যা নাই . তাই ও এখন অনেকটা নিশ্চিন্তে আছে . গুলশান থেকে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায় . দোতালায় চাবি জমা দেবার জন্য আসতেই কামাল খবর পায় শান্তি দিদি ওকে কয়েকবার খুঁজেছে . অফিস রুমে খবর দিয়ে রেখেছে যেন ও আসলেই যেন ৭ নম্বর ওয়ার্ডে চলে আসে .

(২)
৭ নম্বর ওয়ার্ডটা খুব বড় . ঢুকতেই হাতের ডান পাশে নাসদের বসার জায়গা . শান্তি দিদি সেখানেই বসে আছেন . ওকে দেখে বলেন- কামাল এদিকে আয় . তোর সঙ্গে কথা আছে .
-দিদি বাসায় যেতে হবে . তারাতারি কও কি কইবা . কামাল একটা খালি চেয়ার টেনে বসে পরে .
-তোর বউ কেমন আছে ?
-আছে কোনরকম . দিদি রাইত হইছে . কাজের কথা কও . বউডা একলা ঘরে . কামাল তারা দেয় .
-আরে বছ না ছেমরা . কাজ ছাড়া কি তোরে ডাকছি ? কামাল মাথা নাড়ে দিদি ঠিক বলেছ কাজ ছাড়া ডাকেনি . শুন ২১ নম্বর বেডের রুগীডা মারা গেছে . লাশ মর্গে আছে . তোরে একটু দিয়া আইতে হইবো .
-কি কও ? এ্যই রাইতের বেলা ? জাকিরার তো নাইট ,ও’রে কও ? কামাল চলে যাবার জন্য দাঁড়িয়ে যায় .
-আরে শুন ; শুন; তোর তো টাকা দরকার . মালদার পাটি ; পাথের খরচ বাদ দিয়াও মনে হয় হাজার পাঁচেক দিবো . জাকির গেছে সাভারে আসলে কমু . ও মনে হয় রাজি হইয়া যাইবো . সামনে তোর পোলা পাইন হইবো হাতে টাকা পয়সা দরকার তাই আমি তোরে কইলাম . এখন যাওয়া না যাওয়া তোর মর্জি .
পাঁচ হাজার ! কামাল একটু দ্বিধায় পরে যায় . আসলেই তো ওর হাতে তেমন টাকা পয়সা নাই . প্রতি মাসে মাটির ব্যাংটাতে এতোদিন যা জমিয়েছে সব মিলিয়ে হয়তো হাজার পাঁচেকই হবে . এ সময় পাঁচ হাজার টাকা হলে বাচ্চা হওনের সময় অনেক নিশ্চিত হওয়া যায় .
-কিন্তু দিদি মায়া তো বাসায় একলা . দেরী করলে ভয় পাইতে পারে .
-আরে ছেমরা কয় কি ? ভয় পাইবো কেন ? লাগলে আমি যাওনের সময় একবার দেইখা যামু . শান্তি দিদি খাতায় কিছু লিখতে লিখতে বলে .
- কৈই যাইতে হইবো ? মাথা চুলকাতে চুলকাতে কামল জিজ্ঞাসা করে .
-কুমিল্লা . শান্তি দিদি লেখা বন্ধ না করেই বলে .
-ও মা কও কি দিদি ? কুমিল্লা ! কামাল আতকে উঠে . তাইলে তো ফিরতে ফিরতে ভোর হইয়া যাইবো .
-আরে না . ভোর হইবো না . এ্যই ধর তিনটা চারইটা বাজতে পারে .
-হেইডা তো ভোরই . কাইল আবার ডিইটি আছে না ? কখন ঘুমামু কখন কামে আমু .
-কাইল ১২ দিকে আবি .সুপার স্যাররে আমি কইয়া রাখুম . কোন অসুবিধা হইবো না . শান্তি দিদি ফাইলটা আলমিরাতে রাখতে রাখতে বলে .
-একটা কথা কও তো দিদি তোমার এতো গর্জকে ? ভালাই পাইছো মনে হয় .
-আরে ছেমরা মর . আমার আবার গর্জ কি ? তুই যখন মরবি তখন তোর লাইগাও আমি মাইষের হাতে পায়ে ধরমু .
-আহা দিদি রাগ করো কেন ?
-শুন . দিদি কামালের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে . যে মরছে সে অনেক বড় লোক আছিল . বড়লোকগো যেমন খাসলত ভালা হয় না . এই ব্যাডারও তাই আছিল . শেষ বয়সে তিনডা বিয়া করছে . কচি কচি মাইয়া গুলি এই এক সপ্তাহ বুইড়াডার লাগি যা করলো . এখন মরার পরও লাশ নিয়া বইয়া আছে . তুই যাইয়া পৌছে দিয়ে আয় . তোর কাম শেষ . শান্তি দিদি ওর হাতে একটা সাদা খাম দেয় .
-কি এইডা ? কামাল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে .
-কি আবার টাকা আর ঠিকানা যেহানে যাবি . যা গাড়িতে গিয়া ব.
-কিন্তু দিদি এতোটা পথ এই রাইতের বেলায় লাশ নিয়া একলা যাইতে পারুম না .
-আরে ছেমড়া একলা যাবি কেন . বুইড়ার তিন বউ যাইবো তোর লগে . দেখিস আবার না তুই বুইড়া হইয়া যাছ .নিজের রসিকতায় নিজেই শান্তি দিদি হেসে উঠে .
-কি যে কওনা দিদি ? আমি তাইলে গাড়িতে যাই .
-যা . আর শুন বউরে নিয়া চিন্তা করবি না . আমি তোর দিদি আছি . যা ভাগ .
কামাল বেড় হয়ে যায় . হঠাৎ করে টাকাটা পেয়ে মেজাজ ভাল হয়ে যায় . যেতে যেতে মায়ার সঙ্গে ফোনে কথা বলে . মায়াকে জানায় – ওকে এখন কুমিল্লা যেতে হচ্ছে , ফিরতে রাত হবে . মায়া যেন কোন চিন্তা না করে . যতো তারাতারি সম্ভব ও ফিরে আসবে .
কামাল নীচে নেমে দেখে লাশ ওর গাড়িতে তোলা হয়ে গেছে . মনির মিয়া গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে .
এতো ভারী কারো শরীর হয় ? চাইর জন মিল্লাও তুলতে যে কষ্ঠটা হইলো . কামালের দিকে তাকিয়ে হাত ঢোলতে ঢোলতে কথা গুলো এক নি:শ্বাসে বলে মনির মিঞা .
-অনেক ভারী নাকি ? পাল্টা জিজ্ঞাসা করে কামাল তাকায় এ্যম্বুলেন্সের ভেতরে . বাম পাশের বেডের উপর লাশটা রেখে সাদা একটা চাদর দিয়ে লাশটা ডেকে দেওয়া হয়েছে . মিনির মিঞা বাম দিকের দরজা বন্ধ করে দেয় . কালো বোরকা পরা লম্বা মতোন দু’জন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির পাশে . একবার কামালের দিকে তাকিয়ে দু’জন নীচু স্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকে . কামালের কান পর্যন্ত সে কথার আওয়াজ পৌছায় না . কাগজ নিয়ে আরেক জন বোরকা পড়া মহিলা কামাল এর কাছে এসে বলে – আপনিই কি যাবেন ভাই ?
-কামাল উপরে নীচে হা সূর্চক মাথা নাড়ে .
-তা হলে চুলুন রওনা হই . মহিলা মিনির মিয়ার হাতে কয়েকটা একশ টাকার নোট দিয়ে অন্য দুজন মহিলার দিকে তাকিয়ে বলে – কৈই তোমরা আস .
সবাই উঠে বসতেই কামাল এ্যম্বুলেন্স ছেড়ে দেয় . ঘড়িতে তখন বাজে কাটায় কাটায় রাত ১২ টা বাজে .

(৩)
রাস্তায় খুব একটা গাড়ি নেই . সোডিয়াম বাতির আলোয় পথ ঘাট কেমন ভৌতিক মনে হচ্ছে . কামাল এমনিতে ভুত প্রেত বিশ্বাস করে না . তবু এ নির্জন রাতে কেন যেন ওর শরীরে কাটা দিয়ে যায় . গাড়ির গতি ঘন্টায় ৬০ রাখে কামাল . মনে মনে ঠিক করে কোন অবস্থাতেই গাড়ির গতি ৬০কি.মি: এর উপড় নেবে না . কামালের শশুরই ছিল ওর ওস্তাদ . সে শিখিয়েছে রাতের বেলা রাস্তা ঘাট যতোই ফাঁকা হোক না কেন একটা নিদিষ্ট গতিতে গাড়ী চালালে কোন এক্সিডেন্ট হয় না . কামাল কথাটা বিশ্বাস করে . তাই আগে বাগে মনে মনে গাড়ির গতি ঠিক করে নেয় ঘন্টায় ৬০ কিলোমিটার .সংসদ ভবন এর সামনে আসতেই বৃষ্টি শুরু হলো . কামাল মনে মনে বলে- বৃষ্টি হবার আর সময় পেল না . কামাল গাড়ীর গতি আরো কমিয়ে আনে . আসাদ গেটে আড়ং এর সামনে আসতেই সিগনাল পরে গেল . কামাল একবার ভাবলো টান দিয়ে চলে যাবে কিনা ? কিন্তু পরক্ষনেই ভাবলো; না . অস্থির হবার কিছু নাই .
ও গাড়ী থামিয়ে গ্রীন বাতির জন্য অপেক্ষা করে . রাস্তা প্রায় ফাঁকা . কোন জন মানব নেই . ডানে বামে তাকালে ওর কেমন একটা গা ছমছম করে উঠে . দুর ! যতোসব ফালতু চিন্তা ভাবনা . এক কিলোও আসতে পারলাম না আর ভুতের চিন্তা পেয়ে বসেছে . নিজেক নিজেই সান্তনা দেয় কামাল . হঠা. বাম পাশের জানলা দিয়ে একটা মুখ উকি দিতে চমকে উঠে চিৎকার করে কামাল কে ? কে ?
জানালায় দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে আছে এক বুড়া . মাথায় এলোমেলে সাদা চুল . দু’হাত দিয়ে জানালার কাঁচ চেপে আছে . দাঁত গুলোও কেমন ফাঁক ফাঁক . লোকটা বলে উঠে- দে ; দে; টাকা দে . ভাত খামু টাকা দে .
মেজাজ খারাপ হয়ে যায় কামালের . মনে হয় নাইমা দুইটা চড় মারে . হারমজাদা ভিক্ষা চাওনের আর কোন সময় পায় না . মর যাইয়া . ও সাট ফাঁক করে বুকে থুতু দেয় .
মনে মনে গজগজ করলেও বুক পকেট হাতরে পাঁচ টাকার একটা নোট বেড় করে লোকটার দিকে বাড়িয়ে ধরে . লোকটা টাকা না নিয়ে বলে -ভাগ . ভাগ . তারাতারি ভাগ .
কথার আগা মাথা বুঝতে পারে না ও . কামালের কাছে লোকটাকে করে হয়তো পাগল- টাগল হইবো . ঠিক এই সময় ওর পেছনের ছোট জানলায় টোকা দেবার শব্দ হয় . কামাল ওর ঠিক পিঠ লাগোয়া যে জানালাটা সেটা একটু ফাঁক করে ও ০পেছনে না তাকিয়েই বলে- জ্বি বলেন ?
-কি হয়েছে ? পেছন থেকে তিন জনের একজন জিজ্ঞাসা করে .
-না কিছুনা .
সিগনাল ছেড়ে দেওয়ায় কামাল গাড়ী টানদেয় . কামাল বাম পাশের মিররে তাকিয়ে বুড়োটাকে আর দেখতে পায় না . মনে মনে ভাবে আরে গেলো কোথায় ? ও একটু সামনে ঝুকে ফুটপাতটা দেখতে চেষ্টা করে ;কিন্তু বুড়োকে আর দেখতে না পেয়ে বেশ অবাক হয় ও ; তারপর ফামগেটের দিকে টার্ন্ নেয় .
পেছন থেকে ফিস ফিস করে কথা বলার শব্দ কানে আসে কামালের . এই নিরবতায় তাতে ও কিছুটা সাহস পায় কামাল . মাঝে মাঝে দু’একটা গাড়ি শো শো করে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে . রাতে রাস্তায় বেশির ভাগ ট্রাকই চলে . দানবের মতো ট্রাকগুলি ঘোত ঘোত শব্দ করে চলে যায় . সায়দাবাদ ; যাত্রাবাড়ি হয়ে কামাল গাড়ি চালাতে থাকে শনির আকড়া দিয়ে কুমিল্লার দিকে . এ রাস্তাটা ওর বেশ পরিচিত . একটানা বৃষ্টি হচ্ছে . মনে হয়ে আজ সারা রাতই হবে . মাঝে মাঝে বিকট , শব্দে বিদ্যুত চমকাচ্ছে . শীত; শীত একটা ভাব চলে এসেছে . কামাল পানির বোতল খুলে পানি খায় . আশে পাশের দোকান পাট সব বন্ধ . আজ মনে হচ্ছে রাস্তায় গাড়ির সংখ্যাও কম . পেছন থেকে আবারও টুক টুক করে শব্দ হয় .
- জ্বি বলেন ? কামাল মাথাটা একটু পেছনে নিয়ে বলে .
-আমরা একটু নামবো ? এক জন বলে . কামাল অবাক হয় .
-এখানে ?
-জ্বি . আপনি কি একটু থামেন .
-মনে হয় দাউদকান্দি এসে পরেছি . সেখানে থামলে হতো না ?
-না . সামনের বড় গাছটার কাছে থামুন . পেছন থেকে অন্য একটি কন্ঠ বলে উঠে . কথাটা আদেশেয মতো শুনার ওর কাছে . কামাল এ্যম্বুলেন্সটা রাস্তার পাশে একটা বড় গাছের গা ঘেষে দাঁড় করিয়ে দেয় . পেছনের দরজা খোলার শব্দ পেয়ে ও জানালাটা দিয়ে পেছনে তাকায় . আধো আলোয় যা দেখতে পায় তাতে কামাল এর মাথা ঘুরে উঠে . সিটের উপর মৃত ব্যক্তি বসে আছে . শুধু বসেই নেই ; হাত নেড়ে নেড়ে কি যেনো বলছে . ও প্রচন্ড রকমের ভয় পেয়ে যায় . কামল পেছন থেকে চোখ সরিয়ে নিজেকে আড়াল করে রাখতে চেষ্টা করে . সামনে তাকালে দু’ছায়া দেখতে পায় ও . কোন শরীর নেই . শুধু বোঝা যাচ্ছে দেহের অস্তিত্ব . বাতাসে ভেসে ভেসে ছায়া দু’কামালের দিকেই আসছে . ভয়ে ওর জান বের হয়ে যাবার জোগার . মনে হচ্ছে মরে যাবে . নিজেকে সিটের সঙ্গে চেপে রাখে ও. মনে হচ্ছে নিজেকে সিটের ভেতর ডুকিয়ে ফেলতে পারলে ভয় কিছুটা কমে যেতো . মনে মনে আল্লাহ্ ; আল্লাহ্ করতে থাকে . ছায়া দু’টো ওর পাশ দিয়ে পেছনে চলে যায় . পেছন থেকে হঠাৎ হাসির শব্দ ভেসে আসে . কামাল সাহস সঞ্চয় করে আবার পেছনে তাকায় .
লাশটা গাড়ি থেকে নেমে মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে . শরীরে জড়ানো মুদ্দারের কাপড় এলোমেলো ঝুলে আছে . লোকটার হাতে সাদা কাপরের একটা পুটলির মতো কিছু . দু’জন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে লোকটার ঠিক সামনে . একজন পুটুলিটি একটু ফাঁক করেতেই কামাল একটি শিশুর মাথা দেখতে পায় .
লোকটা পুটুলিটা গাড়ির ভেতরে ছুরে মারে . প্রায় সাথে সাথে হুরমুর করে সবাই গাড়িতে উঠে পরে গাড়িতে. কামালের শরীর শক্ত হয়ে গেছে . একবার ভাবলো গাড়ি থেকে নেমে দৌড় দেবে কিনা . কিন্তু কোথায় যাবে ? তার চেয়ে ভাল কিছু না দেখার ভান করে থাকলে হয়তো জানে বেচে যাওয়া যাবে . ও মনে মনে প্রার্থনা করে আল্লাহ্ বাঁচাও . পেছন থেকে টোকা দেবার শব্দ আসতেই কামাল চমকে উঠে – গাড়ি চালাল . ভারী এটা কন্ঠ বলে . কামাল চাবিতে হাত দিতেই গাড়ি স্টাট হয়ে যায় . কামালের মাথা কাজ করছে না . গাড়ি রাস্তায় উঠার সময় সাইড মিররে দেখতে পায় ছায়া দু’টো এখনও দাঁড়িয়ে আছে . হাতে ধরে আছে সাদা মতো দু’টো পুটুলি . এখন আর বৃষ্টি পড়ছে না ; তবে মাঝে মাঝে বিদ্যূত চমকাচ্ছে . মেইন রাস্তা ধরে গাড়ি চালাচ্ছে কামাল . ও চালাচ্ছে না বলে গাড়ি নিজে নিজে চলছে বললেই ভাল শুনায় . কেননা এই মুর্হুতে গাড়ির উপর ওর কোন কন্টোল নেই . ও শুধু চুপচাপ বসে আছে . গাড়ি নিজে নিজে চলছে . পেছন থেকে চুক চুক শব্দ ভেসে আসছে . কামাল নিজেকে সামলে সাহস সঞ্চয় করে আবার পেছনে তাকায় . দেখতে পায় দু’জন করে দুপাশে বসে সবাই সামনের দিকে ঝুকে বাচ্চাটাকে খাচ্ছে।
READ MORE - “রাতের অ্যাম্বুলেন্স”

বটতলায় যখন নামলাম তখন রাত বারটা।

বটতলায় যখন নামলাম তখন রাত বারটা। বাসটা চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমি অন্ধকারের সাগরে নিমজ্জিত হলাম। মিনিট দুয়েকের মত চোখ বন্ধ রাখলাম অন্ধকার মানিয়ে নেয়ার জন্য, তবুও আশেপাশের কিছু চোখে পড়ল না। কি ভয়াবহ অন্ধকার।

বেশ অনেকদিন পরে গ্রামের বাড়িতে আসছি। এখান থেকে দেড় দুই কিলোমিটার দক্ষিনে আমাদের গ্রাম। রিক্সাই একমাত্র বাহন। কিন্তু এত রাতে রিক্সা পাব কিনা সন্দেহ হল। বাড়ি যেতে আবার দুটি বিশেষ যায়গা পার হতে হয় যেগুলো গ্রামের কিছু লোকের ভাষায় ’দেও দানব’ এর আবাসস্থল। যদিও এসব কথা এ যাবৎকালে ফালতু বলে উড়িয়ে দিয়েছি। বিংশ শতাব্দীর এই দিনে এসব কথা হাস্যকর মনে হয়। কিন্তু আজ এই পরিবেশে কথাগুলো বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে। দুরে কোথায় যেন ঝি ঝি পোকা ডাকছে। সুনশান নিরবতার মধ্যে থেমে থেমে ডেকে ওঠা ঐ শব্দকে ভৌতিক ভয়ংকর শোনাচ্ছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীতে আর কিছুর অস্তিত্ব নেই। আমি আর ঝি ঝি পোকা। সাথে অন্ধকার।

এতক্ষনে আবছাভাবে সবকিছু চোখে পড়তে শুরু করল। পাকা রাস্তা থেকে দক্ষিন দিকে নেমে গেছে আমাদের প্রামের রাস্তা। আমি রাস্তায় নেমে পড়লাম। ছোট দোকানটি চোখে পড়ল; বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। পাশে যেখানে রিক্সা থাকার কথা সে যায়গাটা ফাঁকা। ভয়ে আমার গা গা ছমছম করছে। এখন কি করি? একটু ইতস্ততঃ করে ধীরে ধীরে সামনে সামনে এগুতে থাকলাম। হঠাৎ এক ঝলক আলোর স্ফুলিঙ্গ চোখে পড়ল। সর্বনাশ! ভুতের আগুন নয়তো? মৃদু গুনগুন শব্দ কানে যেতেই ভয়টা কিছুটা কেটে গেল। ভুত আর যাই করুক গুনগুন করে গান করে না; কোনদিন করেছে বলেও শুনিনি। আমি সাহস সাহস করে এগিয়ে যাই। একটা রিক্সা! সিটে বসে বিড়ি ফুকছে রিক্সাওলা। বিড়ির টানে যে আলো সৃস্টি হল তাতেই তার চেহারা পরিষ্কার দেখতে পেলাম। রোগা পাতলা শরীর – শুকনো মুখ। আশ্চর্য! বিড়ির আলো যে এতটুকু তা কখনো কল্পনাও করিনি। দিনের আলোয় কখনো বোঝা যায়না অন্ধকারে এই একটু বিড়ির আলো কত উজ্জল হয়ে জ্বলে!

আমাকে দেখে লাফ দিয়ে নেমে দাড়াল সে রিক্সা থেকে। বিড়িটা ছুড়ে ফেলে দিল। ’বাইত যাইবেন? উঠেন’ – আমি একটু অবাকই হলাম। চেনে নামি আমাকে? হতে পারে, গ্রামের অনেকের কাছেই আমি পরিচিত।

’আপনি হ্যারিকেন জালাননি কেন?’ – আমি জিজ্ঞেস করলাম।

’কমাইতে গিয়া সইলত্যা ভিতরে পইরা গেছে’ – রিক্সাওলা কৈফিয়াৎ দিল।

আমি রিক্সায় উঠে বসলাম। – ’অন্ধকারে রিক্সা চালাবেন কিভাবে? রাস্তা দেখবেন কিকরে?’

’অসুবিধা নাই। বিলাইএর চোখ আমার; অন্ধকারেও সব দেখবার পারি। আপনে শক্ত হইয়া বইসা থাকেন’

রিক্সা ঘুরিয়ে অদ্ভুত কায়দায় লাফিয়ে তার আসনে উঠে বসল রিক্সাওলা। কয়েক মুহুর্তেই দ্রুত চলতে শুরু করল রিক্সা। ঐ রোগা পটকা টিনটিনে শরীরে যে এত শক্তি তা ওকে দেখে বুঝতে পারিনি।

কিছু সামনেই ‘দেও দানবের’ আবাস্থল; বিশেষ যায়গা দুটির প্রথমটি। উত্তর পাড়া আর দক্ষিন পাড়ার ঠিক মাঝখানের কালভার্টটি। কালভার্টের দুই পাশে দুটো শিমুল গাছ – দুই পাড়ার লোকজন বুনেছিল। বিশাল আকৃতি নিয়ে দাড়িয়ে আছে গাছদুটি। দেখতেও হুবহু এক। আর চারিদিক বিস্তির্ন মাঠ, খেত খামার। সবাই বলে নিচ দিয়ে যাবার সময় শিমুল গাছ থেকে ঝাঁপ দিয়ে ঘাড়ের উপর আছড়ে পড়ে ’দেও’।

কিছুক্ষনের মধ্যেই উত্তর পাড়া পার হয়ে গেল রিক্সা। অন্ধকার থেকে আবছা আলোয় আসতেই বুঝলাম উত্তর পাড়ার শেষ বাড়িটি পার হলাম। কিছুদুরেই কালভার্ট।

আমি চোখ বন্ধ করে বসে রইলাম। সত্যিই ভয় পাচ্ছি। মৃদু ঝাঁকি অনুভুত হতেই বুঝলাম কালভার্ট পার হচ্ছি। একটু করে চোখ মেলে তাকাতেই দেখলাম ওপাশের শিমুল গাছটা পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছি আমরা। মনে একটু সাহস ফিরে এল। একটা ঝামেলা তো পার হল!

পরবর্তী স্পট একটু সামনেই। ওখানটা অবশ্য একটু অন্য রকম। বাংলা ’দ’ অক্ষরের মত দুটো বাঁক নিয়েছে রাস্তা – চারপাশে বাঁশের ঝাড়। দিনের বেলায়ই বেশ অন্ধকার হয়ে থাকে। আর রাতে হলে তো কথাই নেই। বাশ ঝাড়ের মুখে ওখানেও বড় একটা শিমুল গাছ দাড়িয়ে। কাকতালীয় ভাবে এটিও একই রকম দেখতে।

রাতের অন্ধকারে গাছটিকে আরও ভয়াবহ দেখায়। মনে হয় বিশাল এক দৈত্য দাড়িয়ে আছে। এর সম্পর্কে নানা রকমের গল্প শুনেছি ছোটবেলায়। দিনের বেলায়ই যেতে গা ছমছম করে। রাতের বেলা ওখান দিয়ে গেলে নাকি ’বোবা’য় ধরে। বোবা বিষয়টা কি তা আমি এখনো কারো কাছে সঠিকভঅবে জানতে পারিনি। অনেককেই নাকি বোবায় ধরেছে এ পযন্ত। কিন্ত এখনো এমন কাউকে পাইনি যাকে বোবায় ধরেছে। সবাই শুধু শুনেই এসেছে।

ভয় কাটানোর জন্য অন্য কিছু ভাবতে বসলাম। বিকেলে রওনা হয়ে রাত বারটায এসে পৌছেছি। মাত্র ১০০ কিলোমিটার পথ। আশ্চর্য, ঢাকা থেকেই যদি তিন ঘন্টা সময় লাগে বের হতে তাহলে কেমন লাগে? ভীষন মেজাজ খারাপ হচ্ছে দেশের ট্রাফিক ব্যাবস্থার উপর।

অন্ধকারে রিক্সাওলা সাই সাই করে প্যাডেল মেরে চলছে। হঠাৎ মনে হল এতক্ষনে তো বাশঝাড় মানে দ্বিতীয় স্পটটা পার হয়ে যাবার কথা। বিষয় কি? আমি চারদিকে একটু খেয়াল করার চেষ্টা করলাম।

ঐতো সামনে আবছা ভাবে শিমুল গাছ দেখা যাচ্ছে; তার মানে আমরা দ্বিতীয় স্পটে ঢুকতে যাচ্ছি। আমি দাঁতমুখ চেপে জবুথবু হয়ে বসে রইলাম।

শিমুল গাছটা পার হবার পরেই আবার মৃদু ঝাকি খেল রিক্স্রা। মনে হল রিক্সাটা আবারো কালভার্ট পার হল। আশ্চর্য। কালভার্ট তো পার হয়েই এলাম। ঘটনাটা কি? আরে! এইতো এপারের শিমুল গাছটি; আবছা আলোয় দেখা গেল; পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম। কি ব্যাপার? এমন হল কেন? নাকি ভুতের ভয়ে মাথার ভেতর ওলট পালট হয়ে গেল?

আমি সচেতন ভাবে তাকালাম। ছুটে চলেছে রিক্স্রা। একমনে চালিয়ে যাচ্ছে রিক্সাওয়ালা। কিছু জিজ্ঞেস করব? ইচ্ছে করছেনা। বেকুবি হয়ে যায়। আমি শহরের ছেলে। ভয় পেয়েছি শুনলে একথা রটে যাবে।

ঐতো সামনে আবছা অন্ধকারে আবারো শিমুল গাছে অবয়ব চোখে পড়ছে। পৌছে গেছি এবার বাশঝাড়ের কাছে। আমি সজাগ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছি আমার বাম দিকে, শিমুল গাছটা পারহয়ে গেল। তারপর আবারও মুদু একটা ঝাকি! আমারা তৃতীয়বারের মত কার্লভার্ট পার হচ্ছি! আমার সাড়া শরীরের রোমকূপে শীতল একটা স্রোত বয়ে গেল। ভয়ংকর কিছু একটা ঘটে গেছে বা যাচ্ছে।

আমি রিক্স্রায় বসেই প্যাডেলরত রিক্সাওলার গায়ে হাত রাখলাম। বরফের মত ঠান্ডা হয়ে আছে রিক্স্রাওলার শরীর। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আমি চিৎকার করে তার পিঠে ধাক্কাতে লাগলাম – ’এই এই’

রিক্সাওয়ালা কেমন যেন গোঙানীর মত আওয়াজ করতে থাকল। মনে হল কে যেন তার মুখ চেপে ধরে রেখেছে। মনে হচ্ছে প্রানপণে রিক্সার হাতল ধরে রেখেছে সে।

হঠাৎ আমিও শরীরে কিছু একটা চাপ অনুভব করি। তবে কি আমাকেও? – আমার শরীরের রক্ত হঠাৎই গরম হয়ে যায়। ভয়ংকর বিপদের মধ্যে আমি হঠাং রেগে উঠি; আগেও কয়েকবার প্রমান পেয়েছি। আমি স্থান কাল পাত্র ভুলে চেচিয়ে উঠি। ’এই শুওরের বাচ্ছা ওকে ধরেছিস কেন ছাড়। ছেড়ে দে।’ চেচিয়ে উঠার সাথে সাথে আমার সাড়া শরিরে মনে হয়ে রাগের বিদ্যৃত ঝিলিক দিয়ে যায়। হঠাৎ ভয়ঙকর সাহসী মনে হয় নিজেকে। আজ ভুতের একদিন কি আমার একদিন!

’খাইয়া ফালামু শালা। ওকে ছাড় – ছেড়ে দে।’ – জানিনা কাকে উদ্দেশ্য করে আমার এই গালগাল!

হঠাৎ তীব্র আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় কি এক বিরাট বোঝা যেন নেমে গেল আমার উপর থেকে। ’ঐ কি হইছে?’ – কারো গলা শোনা যায়। আবার সেই তীব্র চোখ ধাধানো আলো। একজন পথচারী! বোধহয় আমার চিৎকার শুনেছে দুর থেকে। হাতে ছোট্ট একটি টর্চ! এর আলোকেই এত তীব্র মনে হচ্ছিল!

সঙ্গে সঙ্গে রিক্সাওয়ালা যেন সংবিত ফিরে পায়। ব্রেক কষে অল্পক্ষনেই থামিয়ে ফেলে রিক্সা। আর একটু হলেই চলে গিয়েছিল খাদে! বেশ জোরে জোরেই দোয়া দরুদ পড়ছে। বেশ ভয় পেয়েছে বলে মনে হল।

আমি বলে উঠি ’না তেমন কিছু না’ ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মানতে পারছিনা। আবার বলতেও ইচ্ছে করছে না কাউকে এই মুহুর্তে। ’ভাই একটু টর্চটা ধরবেন?’ আমি পেছনে তাকিয়ে লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকি।

পেছন থেকে লোকটি টর্চের আলো ফেলে। অল্প সময়ের জন্য চারিদিক আলোকিত হয়। সহসাই বুঝতে পারি আমরা একটু পেছনেই বাশঝাড় ফেলে এসেছি।

’এই চলেন, চলেন।’ – আমি আবার রিক্সাওলাকে তাড়া দেই। রিক্সাওয়ালা দ্রুত রিক্সা টানতে শুরু করে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে সরে পরা ভাল।

’বড় বাচা বাইচা গেছি গো।’ – রিক্সাওলা শব্দ করে বলতে থাকে। – ’আইজক্যা আমাবষ্যার রাত আমার মনেই আছিল না।’

’কেন আমাবষ্যা হলে কি হয়। ’ – আমি জিজ্ঞেস করি।

’আমাবষ্যায় দেও দানোরা শিকার করতে বাইর হয়। একলা পাইলে কথা নাই। ’

’ধুর এগুলো ফালতু কথা।’ – আমি অভয় দেবার চেষ্টা করি। ’বাড়ি গিয়ে ঘুম’দেন। দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে।’ – মুখে বললেও মনে ভাবি – সত্যিই বোধহয় বড় বাচা বেচে গেছি।

’আইজকার পর থেকে আর রাইতে রিক্সা চালামু না।’ – নিজে নিজেই বলতে থাকে সে।

****************************

পরদিন একটু বেলা করে ঘুম ভাংল। গত রাতের কথা মনে পড়ল। দিনের আলোয় সবকিছু মনে হল মিথ্যা। ধেৎ খামোখাই ভয় পেয়েছিলাম নিশ্চয়ই। সত্যিই কি কালভার্টটা তিনবার পার হয়েছি? এও কি সম্ভব। দিনের আলোয় অবাস্তব মনে হচ্ছে সব। ভাবতে ভাবতে বাড়ি ছেড়ে রাস্তার কাছে দাড়ালাম। রাতে কাউকে কিছু জানাইনি। খামোখা ভয় দেখিয়ে লাভ আছে?

রাস্তায় পান্জাবী পড়ে টুপি মাথায় চাচাকে দেখে অবাক হলাম। কি হয়েছে? কোথায় যাচ্ছেন?

’আর বলো না। গতকাল রাতে ওই পাড়ার মোতালেব মারা গেছে। ওর বাড়িতে যাচ্ছি।’

কথাটা শোনার সাথে সাথে প্রচন্ড একটা ভয় ঘিরে ধরল আমাকে। ’মোতালেব কি রিক্সা চালাত?’ – আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

’আরে না ও রিক্স্রা চালাবে ক্যান। জুয়া খেইলা কুল পাইত না। আবার রিক্সা।’

তাই নাকি? – একটা পাষান ভার যেন নেমে গেল আমার মাঝ থেকে।

’হ, বিদেশে আছিল কয়েক বছর। কিছু কাচা ট্যাকা পয়সা নিয়া আসছে। তাই জুয়া খেইলা উড়ায় এখন। ’

’তা হঠাৎ মরে গেল যে?’ – আমি জিজ্ঞেস করি।

’আর বলিস না। গতকাল নাকি রাত বারটার দিকে জুয়া খেইলা বাড়ি যাইতেছিল বাশছোপ তলা দিয়া। ভুতে ধরছিল কিনা কে জানে। বাড়ি গিয়া জ্ঞান হারাইয়া পইড়া যায়। তারপর আর উঠে নাই।’

কথাটা কানে যেতেই আমার পৃথিবী দুলে উঠল। সেই লোক নয়তো? টর্চের তীব্র আলোয় যে চক্র থেকে আমরা উদ্ধার পেয়েছিলাম গত রাতে; ওকি সেই চক্রে পড়ে মরে গেল? দিনের আলোতেই আমি আবার চারিদিকে অন্ধকার দেখতে শুরু করলাম। চাচাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হলনা।
READ MORE - বটতলায় যখন নামলাম তখন রাত বারটা।

একটি ভূতের গল্প l

প্রায় একমাস ছুটি কাটিয়ে কলেজে পৌঁছাবার পর রাতেরবেলা আমাদের গল্প যেন আর ফুরাতেই চাইতোনা! একেজনের পেটে কত কথা! কার চুল কতো সে.মি বড় হলো এই ব্যপারে নিরীক্ষামূলক প্রতিবেদন উপস্থাপন থেকে শুরু করে ছুটিতে টিভিতে দেখে আসা বিজ্ঞাপনের মডেলদের অঙ্গভঙ্গি অনুকরণ- নানারকম আলোচনায় গভীর রাত পর্যন্ত ব্যস্ত থাকি আমরা। সেবারও ব্যতিক্রম হয়নি, ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র বের করে লকারে গুছিয়ে রাখতে রাখতে অনর্গল বকে যাচ্ছি। তখনই মৌসুমি ব্যাগ থেকে একটা কি যেন ক্রিমের টিউব বের করে আমাদের সবাইকে দেখিয়ে সেটার গুণকীর্তন করতে লাগলো, এইটা মাখলে নাকি একমাসের মধ্যে বিশিষ্ট অভিনেতা হাসান মাসুদও টম ক্রুজের মতো হয়ে যাবেন!  ওর কথা শুনে মাইকেল জ্যাকসনের জন্য মনটা হু হু করে কেঁদে উঠলো। আহারে বেচারা, খামোকাই বারবার প্লাস্টিক সার্জারি করতে গিয়ে মরলেন। তাম্মি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো এইরকম একটা ক্রিম কিনে সে মিশেল ওবামাকে পাঠিয়ে দিবে, একমাসের মধ্যে গ্রিনকারড পেয়ে যাবার কথা ভেবে আনন্দে ওর মুখ ঝলমল করতে লাগলো। :goragori:  ব্যবসায়িক বুদ্ধিটা ইরার বরাবরই ভালো, আফ্রিকায় এই ক্রিম রপ্তানি করে যে আমরা অচিরেই মহিলা বিল গেটস হয়ে যাচ্ছি এই ব্যপারটা যখন সে আমাদের প্রায় বিশ্বাস করিয়ে এনেছে ঠিক তখনই বেরসিকের মতো বাদ সাধলো লোডশেডিং।  তাম্মি চরম বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল,”এই জন্যেই তো আমেরিকা চলে যাচ্ছি, মিশেলকে খালি ক্রিম টা পাঠিয়ে নেই না। ওইদেশে কোন লোডশেডিং নাই।“ আমি মাথা নেড়ে তৎক্ষণাৎ একমত হয়ে গেলাম। ক্যাডেট কলেজে চার্জার জাতীয় কিছু নিজের কাছে রাখা রীতিমতো মৃত্যুদণ্ড যোগ্য অপরাধ। অতএব হাল্কাপাতলা চিলাচিল্লি করে সুবোধ বালিকার মতো আমরা শুয়ে পড়লাম। মৌসুমি অবশ্য হাল ছেড়ে দেবার পাত্রীই নয়, অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়েই ইরার বিছানা থেকে সে ক্রিম নিয়ে ঘষতে লাগলো। টুকটাক দুয়েকটা কথার পর সব চুপচাপ।হঠাৎ করেই শুনতে পেলাম শব্দটা। বহুদূর থেকে ভেসে আসছে, যেন কোন অশরীরী আত্মা গভীর বেদনায় আর্তনাদ করে চলেছে। নিজের অজান্তেই কেঁপে উঠলাম একবার। তাম্মি ইতোমধ্যেই ফিসফিস করে জানিয়ে দিলো, কাছেই কোন এক লাল ইটের বিল্ডিঙে নাকি জয়নাল হাজারীর টর্চার সেল ছিল। একথা শোনার পরে আমাদেরর ক্যাডেট সত্তা আমাদের আর বেডে শুয়ে থাকতে দিলো না। মৌসুমির নেতৃত্বে আমরা পা টিপে টিপে চললাম শব্দের উৎসের দিকে। একেবারে কোণার রুম থেকে আসছে মনে হল শব্দটা। যতরকম দোয়াদরুদ জানা আছে সব পড়ে ফুঁ দিয়ে এগিয়ে চলছি, অন্ধকারে দেয়াল ধরে ধরে এগোতে হচ্ছে। এত ভয়ের মধ্যেও ইরাটার ফাজলামো আর গেলোনা, ও বললো আর একমাস পর লোডশেডিং হলেও আর সমস্যা হবেনা, তখন আমরা মৌসুমির রূপের আলোতেই পথ চলতে পারবো, যে হারে ক্রিম ডলছে।  ধীরে ধীরে শব্দের একদম কাছাকাছি পৌঁছে গেছি আমরা, দরজায় দাঁড়িয়ে স্পষ্টই বুঝতে পারলাম ‘জিনিস’টা রুমের ভেতরেই আছে। ওই রুমের বন্ধুদের বাঁচাতে দরজা ভেঙ্গে ঢুকে পড়ব নাকি ঘুরে দৌড় দিবো ভাবতে ভাবতেই মৌসুমি দরজার নবে হাত রেখে বললো,” এতো ভয়ের কি আছে? আমরা না ক্যাডেট!” বন্ধুগরবে আমি রীতিমতো শিহরিত, মুহূর্তেই সব ভয় ঝেড়ে ফেলে ‘ইয়া আলি’ বলে সজোরে দরজা খুলে ঢুকে পড়লাম আমরা। সাথে সাথেই রুমের সবকটা মেয়ে তারস্বরে চিৎকার আরম্ভ করলো। ঠিক ওই মুহূর্তেই ইলেক্ট্রিসিটি চলে আসায় রুমে ফকফকে আলো, হতভম্ব আমি মৌসুমির দিকে তাকাতেই বুঝে গেলাম ব্যপারটা।হলো, ওই রুমের এক বন্ধু রুমমেটদের মাঝে আনন্দ বিতরণের উদ্দেশ্যে একটি গান গাইছিলো, কিন্তু তার সঙ্গীতবিষয়ক অপূর্ব(!) দক্ষতার কারণে আমরা সেটাকে অশরীরীর  হাহাকার ভেবে ভুল করেছি।  আর অন্ধকারে ক্রিমের পরিবর্তে ইরার জুতার কালির টিউব নিয়ে মুখে দলাইমালাই করবার কারণে মৌসুমিকে দেখে আমাদের সবার হার্টে স্থায়ী সমস্যা হয়ে গেছে!

রুমে ফিরে পরবর্তী আধাঘণ্টায় কারেন্টের উদ্দেশ্যে মৌসুমি যে বাছাবাছা গালিগুলো দিলো না! ইলেক্ট্রসিটির কান থাকলে অন্তত সাত দিন আমাদের ক্যাডেট কলেজে টানা লোডশেডিং চলতো, আমি লিখে দিতে পারি
READ MORE - একটি ভূতের গল্প l

ভূতেদের সত্যিকারের বাসা ওদের কবর l

ভূতেদের যে সত্যিকারের বাসা, ওদের কবর, সেটাই যে হ্যানি দম্পতি খুঁড়েছিলো! এই হ্যানি দম্পতি হলো স্যাম হ্যানি আর জুডিথ হ্যানি। আশির দশকে ওরা টেক্সাসের হিউস্টনে খুব শখ করে একটা বাসা কিনেছিলো। বাসাটা দেখে ওদের মনে হয়েছিলো, ঠিক যেনো ওদের স্বপ্নের বাসা। আর বাসা কিনে ওরাও তো শুরু করে দিলো যতো রাজ্যের কাজ-কারবার।

তো, স্যামের মনে হলো, ওদের এতো শখের একটা বাসা, তাতে একটা সুইমিং পুল না থাকলে হয়? ব্যস, ঠিক করে ফেললো, ওদের বাসার পেছনে একটা সুইমিং পুল বানাবে। কিন্তু ওমা, সুইমিং পুলের কথা ভাবতে না ভাবতেই এক আজব চেহারার বুড়ো এসে হাজির হলো। এসে বলে কিনা, ‘তুমি যেখানে সুইমিং পুল বানানোর কথা ভাবছো, সেখানে আছে অনেক পুরোনো আমলের কবর। তোমার তো সাহস কম নয়, এমনিতেই কবরস্থানের ওপর বাড়ি বানিয়েছো, আবার এখন কবর খুঁড়ে সুইমিং পুল বানানোর চিন্তা করছো!’ এই না বলে বুড়ো কবর কোথায় আছে সেটা দেখিয়ে উধাও হয়ে গেলো।

স্যাম তো যাকে বলে একেবারে আকাশ থেকে পড়লো! এখানে কবরস্থান থাকলে বাড়ি বানানো হলো কেন? কখনো শুনেছো, কবরস্থানে বাড়ি বানানোর কথা? তারপরও বুড়ো যখন বলেছে, খুঁড়ে দেখতে সমস্যা কোথায়? ও একটা কোদাল নিয়ে খুঁড়তে লেগে গেলো। একটু পরে কোদাল কিসে জানে লাগলো। দেখে কি, পাইন কাঠ। হাত দিয়ে উপরের মাটি সরিয়ে দেখে, সত্যি সত্যিই একটা কফিন! খুলে দেখে, ভেতরে একটা কঙ্কালের মতো কি যেনো দেখা যাচ্ছে। পাশে আরেকটু খুঁড়তেই দেখে আরেকটা কফিন। এই কফিনের ভেতরে আবার লাশের বাম হাতের অনামিকায়, মানে যেই আঙ্গুলে বিয়ের আংটি পরা হয়, সেই আঙ্গুলে বিয়ের আংটিও আছে! সঙ্গে সঙ্গে শেরিফকে খবর দিলো ও। ভাবছো, শেরিফ আবার কে? আরে, ওই দেশে থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশকেই শেরিফ বলে। এসে দেখা গেলো, এ তো অনেক পুরোনো কবর, বেশিরভাগ হাড়ই গুড়িয়ে গেছে। যা-ও বা আছে, তার অনেকগুলোই ধরতে না ধরতেই গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে। আশেপাশে খুঁড়ে দেখা গেলো, আরো অনেকগুলো কফিন আছে। তার মানে ঐ আজব বুড়োর কথা আসলেও সত্যি। এখানে অনেক আগে আসলেও একটা কবরস্থান ছিলো।

কি আর করা! শখের সুইমিং পুলের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো স্যাম। কিন্তু মাথায় তো এক নতুন পোকা ঢুকে গেছে, কাদের কবরস্থান এটা? কবরগুলোই বা কাদের? আর এই কবরস্থান পরিত্যক্তই বা হলো কি করে? খোঁজ নিতে নিতে জেসপার নর্টন বলে এক লোকের খোঁজ পেলো স্যাম। সে অ-নে-ক আগে এই বাসায় থাকতো। তার কাছ থেকেই জানতে পারলো, শুধু তাদের বাসাটাই নয়, আশেপাশের অনেকগুলো বাসাই তৈরি হয়েছে একটা পরিত্যক্ত আফ্রিকান-আমেরিকানদের কবরদের উপরে। আফ্রিকান-আমেরিকান কাদের বলে জানো তো? যে সব আফ্রিকান আমেরিকায় থাকতে গিয়েছিলো, ওদেরকে বলা হয় আফ্রিকান-আমেরিকান। আর আগে তো ওরা বেশিরভাগই যেত দাস হিসেবে। কেন, আগে ইউরোপ-আমেরিকার সাদা মানুষেরা যে কালো মানুষদের দাস হিসেবে ব্যবহার করতো, সে কথা জানো না বুঝি? এটা অবশ্য কয়েক শ’ বছর আগের কথা। এখন আর পৃথিবীতে কেউ কারো দাস নয়। বড়োজোর, তোমার বাসার কাজের ছেলে বা মেয়েটা তোমাদের মাইনে দেয়া কাজের লোক। কিন্তু কোনো ভাবেই দাস নয়, মানুষ। ওর সাথে কিন্তু সেভাবেই আচরণ করবে, কেমন?

শুধু তাই নয়, এই কবরস্থান সম্পর্কে আরো অনেক তথ্যই জোগাড় করে ফেললো স্যাম। এই কবরস্থানে মোট কবর দেয়া হয়েছিলো ৬০ জনকে। সর্বশেষ কবর দেয়া হয়েছিলো ১৯৩৯ সালে। তারপর আর কাউকেই এখানে কবর দেয়া হয়নি। তা না হলে কি আর কবরস্থানে বাড়ি বানানো যায়? আর যে দুইটা কবর স্যাম খুঁড়েছিলো, ওই দুটো কবর ১৯৩০ সালের, বেটি আর চার্লি থমাসের। ওরা আবার স্বামী-স্ত্রী ছিলো।

এতো কেবল কাহিনীর ভূমিকা। আসল কাহিনী শুরু হলো এরপরে। জেনে হোক, আর না জেনে হোক, স্যাম তো দুটো কবর খুঁড়লো, এবার কবরের মালিক বেটি আর চার্লিকে ঠেকায় কে? ওরা শুরু করলো জ্বালাতন। আর শুরু করবে না কেন, বলো? তোমার সুখের বাসা এভাবে ভেঙে দিলে তুমি কি জ্বালাতন করতে না? প্রথমে ওরা কেবল স্যাম আর জুডিথের বাসায় জ্বালাতন করতো। দেখা গেলো, ওদের ঘড়িটার ব্যাটারি খুলে রেখে দিলো। কিংবা পানির কল একবার খুলছে, আবার বন্ধ করছে। কখনো বা টিভির সুইচ-ই বন্ধ করে দিচ্ছে। নয়তো ফ্যান অফ করে দিচ্ছে। কিছুদিন পর ভূতেদের জ্বালাতন শুধু ওদের বাড়িতেই সীমাবদ্ধ থাকলো না, আশেপাশের বাসাতেও শুরু হয়ে গেলো। দিনদিন জ্বালাতনের মাত্রা এতোই বেড়ে গেলো, যে ওদের পক্ষে স্বাভাবিকভাবে বাসায় থাকাই অসম্ভব হয়ে উঠলো।

একদিন হলো এক মজার ঘটনা। রাতের বেলা জুডিথ ছিলো একা, স্যাম গিয়েছিলো নাইট ডিউটি করতে। তো রাতে জুডিথ শুনলো বারান্দার স্লাইডিং ডোর ঠেলে কে যেন ঢুকলো। অথচ ডোর ছিলো লক করা। ও তো জানেই, এ বেটি আর চার্লি ছাড়া আর কারো কাজ হতেই পারে না। কোনোমতে চোখ-মুখ চেপে শুয়ে থেকে রাত পার করে দিলো। সকালে স্যাম আসলে বিছানা ছেড়ে উঠে ক্লোজেট খুলে দেখে, ওর শখের লাল জুতো জোড়া নেই! নেই তো নেই, খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। দু’জন মিলে বাসার যতো জায়গা আছে, সব জায়গায় খুঁজেও ওরা জুতো জোড়ার কোনো নাম-নিশানাই পেলো না। শেষমেশ বাড়ির পিছে গিয়ে দেখে জুতো জোড়া বেটির কবরের উপর সুন্দর করে সাজানো! পরে খেয়াল করে দেখে, সেদিন ছিলো বেটির জন্মদিন। আর তাই যেন চার্লি ওকে জন্মদিনের উপহার দিয়েছে জুডিথের লাল জুতো জোড়া! কার না রাগ লাগে বলো তো দেখি! কিন্তু কিছু করারও নেই; ভ‚তের কাণ্ড বলে কথা!

দিন দিন ওদের এমনি জ্বালাতন আরো বাড়তে লাগলো। আশেপাশের বাসাগুলোতেও কোথাও কোনো গাছ হয় না। শখ করে গাছ লাগিয়েছো কি দু’দিন পরেই মরে যাবে। কিভাবে যে মরে যায়, কে জানে! যা কিছুই করো, কিছুতেই কিছু হয় না। আর সুইচ অন-অফ করা, পানির কল খোলা-বন্ধ করা, চুলা জ্বালানো-বন্ধ করা, এসব তো আছেই। সাথে যুক্ত হলো কথা বলা। প্রায়ই ওরা শুনতো, আশেপাশে কারা যেন কথা বলছে; বিড়বিড় করে কথা বলার মতো মৃদু শব্দ শোনা যেতো।

কাঁহাতক আর সহ্য করা যায়! স্যাম আর জুডিথ ঠিক করলো, অন্য কোথাও বাসা নেবে। কিন্তু টাকা কোথায়? ওরা যেই কোম্পানির কাছ থেকে বাড়িটা কিনেছিলো, তাদের নামে এক মামলা ঠুকে দিলো! কিন্তু ফল হলো উল্টো, মামলা হেরে আরো জরিমানা গুণতে হলো ওদেরকে। এবার ঠ্যালা সামলাও! কি করা যায়।

এবার জুডিথ কোমর বাঁধলো; হয় এসপার নয় ওসপার। ওদের কবর নষ্ট করেছি, ওদেরকে কবরের বাঁধন থেকে মুক্ত করে দিয়েছে, ওরা আর কী চাইতে পারে, বড়োজোর কারো জীবন! প্রয়োজনে ও ওর জীবনই দিয়ে দিবে, তবু এই জ্বালাতন আর মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে থাকবে না। স্যামদের বাড়ির পেছনে উঠোনে গিয়ে ও নিজেই একটা কবর খুঁড়তে শুরু করলো। একটু পর ওর বড়ো মেয়ে টিনাও এসে হাত লাগালো। দুজনে মিলে আধ ঘণ্টার মধ্যেই একটা বড়োসড়ো গর্ত খুঁড়ে ফেললো। এরপর টিনার যেন শরীর কেমন কেমন করতে লাগলো। ও ড্রয়িংরুমে গিয়ে একটা সোফায় এলিয়ে পড়লো। একটু পর ও বলতে লাগলো, ‘মা, বাবা, আমার বাচ্চাটাকে তোমরা দেখো, আমার বাচ্চাটাকে দেখো।’ আর চোখের মধ্যে কী যে ভয় খেলা করতে লাগলো! আর তারপর ওর চোখ বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। ওর মুখ দিয়ে আর কথা বের হয় না।

দেখে তো সবাই-ই খুব ভয় পেয়ে গেলো। খবর দেয়া হলো এক মনোবিজ্ঞানীকে। কিন্তু সে আসা পর্যন্ত তো টিনাকে জেগে থাকতে হবে, নাকি? সবাই মিলে ওর সাথে কথা বলে ওকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করতে লাগলো। মনোবিজ্ঞানী এসে ওকে দেখে-টেখে বললো, ওর এক বড়ো ধরনের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। সবাই মিলে ওকে বাঁচানোর খুব চেষ্টা চলতে লাগলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো লাভ হলো না। দুই দিন পর মারা গেলো টিনা।

আর কী! মেয়ে হারানোর শোকে স্যাম আর জুডিথের তো পাগল হওয়ার দশা। খুব তাড়াতাড়ি-ই ওরা সেই অভিশপ্ত বাড়ি ছেড়ে দিলো। বাসা বাঁধলো মন্টানায়। এভাবে নিজেদের মেয়েকে হারিয়েই কবর খোঁড়ার অভিশাপ কাটিয়েছিলো স্যাম আর জুডিথ। কবর খোঁড়ার অভিশাপ, সে কী আর যে সে কথা!
READ MORE - ভূতেদের সত্যিকারের বাসা ওদের কবর l

অনেক দিন আগে একটি বিরাট বাড়ী ছিল l

অনেক দিন আগে একটি বিরাট বাড়ী ছিল, সেখানে অনেক লোক বাস করত। কিছু দিন অগে সেই বাড়ীতে একটি ঘরে দুইটি লোক ঘর ভাড়া করেছে। এবং তারা আসার পর থেকে সেই বাড়ীর টিনের চালের উপর ছোট-বড় ও মাঝারী আকারের পাথর ও আস্তা ইট চালের উপর মারত যেন কে? এবং বাড়ীর সবাই মনে করত সেই বাড়ীতে নাকি ভুতের দৃষ্টি পরেছে। রাত ১টা ২ টা বাজলে ১-২ টা করে ঢিল মারার শব্দ শুনা যেত। আর সন্ধ্যার দিকে একটু বেশী করে ঢিল মারায় বাড়ীর বড়রা সহ ছোটরাও ভয় পেত ঘুমাতে পারত না কান্না করত। একদিন সেই বাড়ীর নতুন ভাড়া নেয়া ছেলেরা বলল আমরা পীরের কাছে যাব। তারা পীরের কথা বলে বাড়ী সন্ধ্যার দিকে বাড়ী থেকে এসে আধা ঘন্টা পর ১টি বোতলে জল ও ১টি তাবিজ নিয়ে যায়। এবং বোতলের জল রাস্তা থেকে একেবারে বাড়ীর পিছন পর্যন্ত ছিটিয়ে দিল। পরে সেই রাতে আর একটিও ঢিলের শব্দ শুনা যায়নি। তাই বাড়ীর অন্য লোকেরা বিশ্বাস করল যে, বাড়ীতে ভূতের দৃষ্টি পরেছে। বাড়ী পরে নীরব হয়ে গেছে। সকালে উঠে ঐ দু’জন ছেলেরা বলল পীরের কাছ থেকে জল ও তাবিজ আনতে তাদের ১’শ টাকা লেগেছে, তাই তারা বাড়ীর সবার কাছ থেকে ১’শ টাকা তোলে নিয়ে গেছে। কয়েকদিন পর আরও বেশী করে ঢিল পড়ছে চালের উপর। এখন বাড়ীর পিছন দিকে কয়েক’লোক গিয়ে হাতে-নাতে ধরতে পেরেছে নতুন ভাড়া নেয়া ঐ দু’ই ছেলেকে। একজন ঢিল মারার জন্য ইট ভাঙ্গছে আর অন্যজন ছোট পাথর হাতে নিয়ে ঢিল মারছে। তাদের দেখে তারা পরে বাড়ীতে ডেকে এনে জিজ্ঞাস করা হল তোমরা এতদিন ঢিল মেরেছ কেন? একজন বলেছে না আমি একটি মেরেছি ও অন্যজন বলছে আমি যে মেরেছি তার কী কোন প্রমাণ আছে? একথা বলার পরে বাড়ীর লোকজন তাদের দু’জনকে অনেক মেরেছে। এবং তাদের বলা হয়েছে ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য। এবং পীরের কাছ থেকে জল ও তাবিজের নাম করে যে টাকা নিয়েছে তা সবই মিথ্যা তারা নিজেই স্বীকার করেছে। তার পর থেকে আজ পর্যন্ত এ বাড়ীতে কোন ঢিল পরেনি। শেষে ঐ দু’ছেলের আরেক নাম ঢিল-ওয়ালা ভূতে পরিণত হল।
READ MORE - অনেক দিন আগে একটি বিরাট বাড়ী ছিল l

ভূতের আবার ঘরও থাকে নাকি?

ভাবছো, ভূতের আবার ঘরও থাকে নাকি? বড়োজোর গাছ থাকতে পারে; প্রিয় শেওড়া গাছ, কিংবা বটগাছ বা পাকুড় গাছ। তাই বলে আস্ত একটা বাড়ি! না, আসলে ব্যাপারটা হলো গিয়ে এই বাড়িওয়ালা ভূতটা যার, মানুষ থাকতে তার নাম ছিলো বিল বেটি। এই বিল, আর তার স্ত্রী সারাহ বেটি, দুজনে মিলে নিউ জার্সিতে একটা বিশাল বাড়ি বানানো শুরু করেছিলেন; প্রায় ১৫০ একর জমির উপরে। কিন্তু বাড়ি বানানো শেষ করার আগেই, ১৯৩০ সালে মারা যান বিল। তারপর সারাহও আর বিয়ে করলেন না। তাদের ৪ ছেলেমেয়েদের মানুষ করলেন, বিয়ে দিলেন। ১৯৪১ সাল পর্যন্ত ছিলেন ঐ বাসাতেই। তারপর তারা চলে গেলেন। বাসায় একটা স্কুল হলো। কয়েক দশক স্কুলটার ঠিকানাও ছিলো ঐ বাড়ি। শেষমেশ ১৯৭২ সালে ডন বার্লিংগেম আর তার স্ত্রী ক্যারল বাড়িটা কিনে নেন। আর তারপরই আবির্ভাব ঘটলো বিল বেটির ভূতের। ডন আর ক্যারল তো বাড়িটা কিনলেন, তারপর খুব যত্ন করে বাড়িটা নতুন করে সাজালেনও। গোল বাঁধলো ওরা বাড়িতে ওঠার পর। ওরা নাকি প্রায়ই কার পায়ের শব্দ পেতেন। সেই পায়ের শব্দ শুধু হাঁটাহাঁটিই করতো না, সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা-ও করতো। কী ভীষণ কথা ভাবো!

অবশ্য বিলের ভূতের কিন্তু রসবোধও কম নয়। ধরো ডন আর ক্যারল দু’জনে মিলে খুব মজাসে একটা ছবি দেখছেন। ছবির একদম ক্লাইমেক্স চলে এসেছে, এই কি না কি হয়, অমনি বিলের ভূত দিলো চ্যানেল পাল্টে! যাঃ! কিচ্ছু বলারও যো নেই। ভূকে কি আর কিছু বলা যায়!

তবে বিলের ভূতটা খুবই ভালো। ওদেরকে ভয় দেখায় না। কেন দেখাবে বলো, ওরা যে বিলের বাসাটাকে খুব যত্ন করেই রেখেছেন। আর বিলও যে ওর বাসাটাকে খুব ভালোবাসে, সেটা একদিনের ঘটনাতেই খুব বোঝা গেলো। একদিন ডন আর ক্যারল দূরে ঘুরতে যাবেন। বের হওয়ার সময় ডন বললেন, ‘আজকে বোধহয় বৃষ্টি হবে। জানালাগুলো বন্ধ করে গেলে হয় না?’ ক্যারল ওর কথা উড়িয়েই দিলেন। ‘ধুর, আজকে এত্তো সুন্দর আবহাওয়া। আজকে আবার বৃষ্টি হবে কিভাবে?’ কিন্তু সেদিন সত্যি সত্যি বৃষ্টি নামলো। যাকে বলে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। ওরা তো চিন্তায় চিন্তায় অস্থির। না জানি ঘরের ভেতর কি অবস্থা। ওরা তো জানালা সব খুলেই চলে এসেছেন। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে দেখেন, ওমা! বাইরের দিকের সবগুলো জানালা বন্ধ! ঘরের ভেতরে এক ফোঁটা বৃষ্টির পানিও আসে নি! বিলের ভূত ছিলো বলেই রক্ষা! নইলে তো ঘরের ভেতর বন্যা-ই হয়ে যেতো!

এসব ঘটনা দেখে ক্যারল ওর এক বান্ধবীকে সব বললেন। সে আবার প্যারাসাইকোলজি নিয়ে পড়াশুনা করছে। ওকে জিজ্ঞেস করলো, ওরা কি বাসা ছেড়ে দেবে কিনা? ওর বান্ধবী বললো, ছাড়ার কি দরকার? বিলের ভূত তো আর ওদের কোনো সমস্যা করছে না। উল্টো ও আরো খুশি-ই হচ্ছে।

ভাবছো, বিলের ভূত যদি সত্যি-ই থাকে, তাহলে আগে কেউ দেখলো না কেন? আসলে আগেও দেখেছিলো। দেখেছিলো বিলের স্ত্রী সারাহ। কিন্তু নিজের স্বামীর ভূত দেখে সেটা কি আর সবাইকে বলে বেড়ানো মানায়, বলো? আর বললেই বা কে বিশ্বাস করতে যায়! তোমাদের মতো একই চিন্তা খেলেছিলো ডন আর ক্যারলের মাথায়ও। অনেক খুঁজে-পেতে সারাহর এক গৃহকর্মী ইউজিনের কাছ থেকে ওরা এই তথ্য পেয়েছিলো। একদিন নাকি ইউজিন সারাহ’র সাথে ওদের বারান্দা গেছে কি কাজে। গিয়ে দেখে কি, কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। আর ওদের দেখে মুহূর্তের মধ্যেই কোথায় যে উবে গেলো! আর সেই লোককে এক পলক দেখে সারাহ’র কি কান্না! আমার স্বামী এসেছিলো। আর এরপর থেকে তো ইউজিন আর কখনোই ওই বারান্দায় যেতো না।

শেষমেশ আর ধৈর্য্য রাখতে পারলো না ডন আর ক্যারল। ওরা অন্তত এইটুকু জানতে চায়, ওরা কার সাথে বাস করছে। ভূতের সাথে, নাকি ওদের কোনো কল্পনার সাথে। ওরা এক বিখ্যাত প্যারাসাইকোলজিস্টকে ডাকলো। সেও এসে খুব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে শুরু করলো। কিন্তু ওরাও হার মানলো, চূড়ান্ত করে কিছুই বলতে পারলো না। তাতে কি, বিল বেটির ভূত তো আর ওদের কোনো বিপদ ঘটাচ্ছে না। সুতরাং ওরা বিল বেটির ভূতের সাথে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে লাগলো।
READ MORE - ভূতের আবার ঘরও থাকে নাকি?

তারাগঞ্জের পশ্চিমপাড়ার সবচেয়ে বড় এবং পুরান দেবদারু গাছেই থাকত ভূতটা ।

তারাগঞ্জের পশ্চিমপাড়ার সবচেয়ে বড় এবং পুরান দেবদারু গাছেই থাকত ভূতটা ।
বয়স আর কত হবে?
এই ধর হাজার দেড়েক!
এই ভূতটা ছিল ভীষণ রকম বোকা।
এ জন্য অন্য সব ভূত তাকে ‘বোকাভূত’ নামে ডাকত।
আর বোকা ভূতটা, নিজেকে কি ভাবত জান? তেমন বেশি কিছু না, নিজেকে কেবল জগতের সবচেয়ে বেশি চালাক ও বুদ্ধিমান ভাবত!

একদিন হল কি, জান? না বললে জানবে কি করে!
আচ্ছা বলে দিই, বোকা ভূতটা মাঝ রাতে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে বাঁশি বাজাতে লাগল।
তার বাঁশি শুনে পাশের ঝোপ থেকে একটা শিয়াল পন্ডিত এসে হাজির।
শিয়াল পন্ডিত ভূতকে দেখে ভয়ে দৌড়াতে গিয়ে ভূতের সঙ্গেই খেল ধাক্কা। শিয়ালের ধাক্কা খেয়ে বোকাভূত তার প্রিয় বাঁশিটা ফেলল হারিয়ে । তারপর কত যে খুঁজল, তার হিসাব নেই। না পেয়ে বোকাভূতের হল ভীষণ রকম রাগ!
সে ঠিক করল, এইবার শিয়াল পন্ডিতকে আচ্ছা মত ভয় দেখাবে। সেই সুযোগ পেল একদিন।

সেদিন একটা কুকুর বেড়াতে এসেছিল বনে। আর বোকাভূত কুকুরকে শিয়াল ভেবে ভয় দেখাতে শুরু করল।
কিন্তু কুকুর কি আর ভূত ভয় পায়! কুকুরের গেল মেজাজ খারাপ হয়ে। বিরক্ত হয়ে সে বলল, আচ্ছা, ভূত তুমি আমাকে ভয় দেখাতে চাচ্ছ কেন, শুনি?
-আবার কেন বলছিস, বেকুব শিয়াল, তোর মনে নেই তোর জন্যই আমার শখের বাঁশিটা হারাতে হল।
কুকুর তো ভূতের কথা তেমন বুঝতে না পারলেও এইটুকু বুঝল, শিয়াল ভেবে তার পেছনে লেগেছে ভূতটা।
কিন্তু সে কোন ভাবেই ভূতকে বোঝাতে পারল না যে, সে শিয়াল নয়, কুকুর।
ভূত বলল, ভেবেছিস তোকে আমি চিনব না?
অতটা বোকা আমি নই। তোকে আমি ঠিক চিনেছি।
-আরে বললাম তো, আমি শিয়াল নই; আমি কু…কু…র।
-থাক আমাকে আর বোকা বানাতে হবে না। বাঁশি না দেয়া পর্যন্ত তোকে কিছুতেই ছাড়ব না তোকে।
এতক্ষণে ভড়কে গেল কুকুরটা। একা একা এই বনের মধ্যে ভূতের সঙ্গে বাহাদুরি করে কতক্ষণ আর টেকা যায়!
কিন্তু কি করবে সে,বুঝতে পারছিল না। মনে মনে নিজেকেই ধমকে দিল। কেন যে, জঙ্গলে এলাম!
-কিরে শিয়াল, মনে মনে কি বুদ্ধি আটছিস?
-দেখ তোমাকে আর কতবার বলব, আমি কু…কু…র।
ভূত হো… হো… হো… করে হেসে বলল, তাই বুঝি?
এই জন্যই তো লোকে তোকে পন্ডিত বলে।
বল বাঁশি দিবি কি দিবি না?
কুকুর কাঁদ কাঁদ হয়ে বলল, বাঁশি পাব কই?
বাঁশির খোঁজ জানি না তো!
-তাহলে ছাড়াও পাবি না, তোকে মরতেই হবে।
-কি মুশকিল? তুমি শুধু শুধুই আমাকে…
বলতে বলতে কেঁদে ফেলল কুকুরটা।
ভূত বলল, যতই কান্নাকাটি কর লাভ নেই, বাঁশি না দিলে তোকে ছাড়ব না আমি!
কোন পন্ডিতেই আজ কাজ হবে না। ভালই ভালই বলছি, বাঁশিটা দিয়ে দে। নইলে ঘাড় মটকে দেব কিন্তু।

শেষেমেশ কুকুর কোন উপায় না পেয়ে মনে মনে বুদ্ধি আটল। তারপর বলল, ও মনে পড়েছে তোমার বাঁশি পাওয়া গেছে।
-বেশ তো জলদি বল কোথায় রেখেছিস?
-তুমি এখানে থাক আমি এনে দিচ্ছি।
-না আমিও তোর সঙ্গে যাব।
-আচ্ছা, কিন্তু তার আগে আমাকে ওই সামনের জঙ্গলটাই নিয়ে চল। কুকুরটা জঙ্গল থেকে একটা লাঠি কুড়িয়ে ভূতের হাতে ধরিয়ে দিল।
-ভূত বলল এটা কি?
-আরে এটাই তো তোমার বাঁশি! নিজের বাঁশি নিজেই চিনছ না!
অনেকদিন জঙ্গলে পড়ে ছিল তো, একটু ধুয়েমুছে তারপর বাজিও।
ভূত বলল, ঠিক আছে,সেটা তোকে বলতে হবে না।
কুকুর বলল, আমি তাহলে যাই।
ভূত মাথা নেড়ে সম্মতি দিতেই কুকুরটা লেজ উঁচিয়ে দিল ভোঁ- দৌঁড়…!
READ MORE - তারাগঞ্জের পশ্চিমপাড়ার সবচেয়ে বড় এবং পুরান দেবদারু গাছেই থাকত ভূতটা ।


Must Comment: