রাত বেশি নয়,নয় টা সাড়ে নয় টা হবে হয়তো।

রাত বেশি নয়,নয় টা সাড়ে নয় টা হবে হয়তো।আমরা পাঁচজন বন্ধু মিলে সুন্দরবনের দুবলার চড়ে গর্জন গাছের নিচে বসে গল্প করছিলাম।অন্ধকার রাত।খুব ঠান্ডা বাতাস।নানান গাছের পাতার সর সর শব্দ।চা খাচ্ছি,সিগারেট খাচ্ছি,এলোমেলো বিভিন্ন কথাবার্তা বলছি।আজ সন্ধ্যায় আমরা সুন্দরবনে এসে পৌছেছি।হঠাৎ সুমন বলল,এক মাইল দূরে একটা ভূতের বাড়ি আছে,অনেক আগের পুরোনো ভাঙ্গা বাড়ি।সুন্দরবনের আশে-পাশে যারা থাকেন,তারা বলেন বাড়িটা ভূতের।অনেকে বন থেকে মধু ও কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে যারা কৌতুহলে এ বাড়ির কাছাকাছি গিয়েছে তারা আর ফিরে আসতে পারেনি।এই যুগে কেউ ভূতের কথা বললেই আমার খুব রাগ হয়।মুহূর্তের মধ্যেই আমি ঠিক করে ফেললাম ভূতের বাড়িতে আমি যাবো।মানুষের থাকার জায়গা নাই আর ভূতের বাড়ি!ফাজলামো!আমরা সবাই মিলে দুই ঘন্টা হেঁটে সেই ভূতের বাড়ি খুঁজে বের করি।তখনও রাত বারোটা বাজেনি।

দোতালা ভাঙ্গা বাড়ি।কোনো দরজা জানালা নেই।যেন পুরো বাড়িটা গাছ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে।শ্যাওলা পড়া,ইটের ফাঁকে ফাঁকে বড় বড় গাছ হয়েছে।।সবাই নিচে থাকবে,আমি একা উপরে যাবো।কারণ আমার সখ বেশি।যদি ভূত আমাকে মেরে ফেলে তাহলে আমার মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী।ওদের নানান শর্ত আমি সব মেনে নিলাম।অনেকক্ষন বাড়ির চার পাশ দিয়ে ঘুরেও,বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করার কোনো দরজা খুঁজে পেলাম না।চারিদিকে প্রায় সাত ফুটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা এবং দেয়ালের উপর তারকাটা ও ভাঙ্গা কাঁচ বসানো।

ওদের সবাইকে নিচে রেখে আমি উপরে উঠলাম।বন্ধুরা সাহায্য না করলে সাতফুটের দেওয়ালে একা ওঠা সম্ভব হতো না।ভাঙ্গা কাঁচে হাত কেটে গেল অনেকখানি।অনেক ঝামেলা করে দোতালায় উঠলাম জানালা দিয়ে।বন্ধুরা সবাই আমার অপেক্ষায় আছে।দোলায় তীব্র অন্ধকার,কিছুই দেখা যায় না।আমি খুব ধীরে ধীরে এক রুম থেকে অন্য রুমে যাচ্ছি।ছাদে ওঠার সিঁড়ি খুঁজে পাচ্ছি না।কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ খুব ভয় পেলাম।অনেক ভয় পেলাম।যদিও কোনো ভূত বা অন্য কিছু দেখিনি।শুধু মনে হলো,যেনো আমি অনন্তকাল ধরে এই ঘরে হেঁটে বেড়াচ্ছি।অনেকক্ষন পর বুঝতে পারলাম,আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি।যেদিক দিয়ে দোতালায় উঠেছিলাম সেই পথ খুঁজে পাচ্ছি না।সব ভাঙ্গা দরজা-জানালা গুলো যেনো কোনো কারণে অদৃশ্য হয়ে গেছে।এই ভূতের বাড়ি থেকে আমি আর বেরুতে পারবো না।কে যেনো আমার নাম ধরে একবার ডাকলো।তারপর এক আকাশ নিরবতা।কোনো শব্দ নেই।

আমি খুব সাহসী নই।তবে ভূত প্রেত বিশ্বাস করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।খুব সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়ে গেল।প্যাকেটে হাত দিয়ে দেখি সিগারেট আছে কিন্তু ম্যাচবাক্স নেই।খুব রাগ হলো।কার উপর রাগ হলো কে জানে!কি করি কিছুই বুঝতে পারছি না।খুব অস্থির অস্থির লাগছে।হঠাৎ শুনতে পেলাম কারা যেন ফিস ফিস করে কথা বলছে,মেরে ফেলো মেরে ফেলো।আমি চোখ বন্ধ করে বললাম- ঈশ্বর সাহায্য করো,সাহায্য করো।
READ MORE - রাত বেশি নয়,নয় টা সাড়ে নয় টা হবে হয়তো।

ঘটনাটি ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় ১৫ বছর আগে ।

যারা ভুত বিশ্বাস করেন না এ লেখাটি তাদের জন্য নয় । কেননা এটা একটি ভুত সংক্রান্ত লেখা বা ঘটনা । যা কিনা আজো আমার কাছে জীবন্ত । এখন ও আমি মাঝ রাত্রিরে জেগে বসে থাকি ভুতের ভয়ে । ঘটনাটি ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় ১৫ বছর আগে । কিন্তু আমার কাছে মনে হয় এইতো সেদিন ঘটলো ঘটনাটি । ঘটনাটির কথা মনে হলে হাত পা আমার এখনও ঠান্ডা হয়ে যায় ।

আমারা তখন পুরানো ঢাকাতে থাকি । বাবা সরকারি চাকুরি করেন । বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করেই আমরা বড় লোক হয়ে গেলাম । তা ও বাবার এক ফুপুর কল্যাণে । বাবার বড়লোক ফুপুর মৃত্যুর পর তার বিষয় সম্পতির ছোট একটি অংশ আমাদের বড়লোক করে দিল রাতারাতি ।

আমারা ভাড়া বাসা থেকে আমরা নিজেদের বাড়ীতে উঠলাম । তাও আবার তিন তলা বাড়ী । ৬টা ভাড়াটিয়াসহ বিশাল বাড়ী । আমরা উঠেছি দোতালায় । সারা দিন ভাই বোনদের সঙ্গে আনন্দ করে সময় কাটে । বাড়ীর সামনে দু’টো বড় বড় মেহগনি গাছ । তার একটিতে ছোটকাকু দোলনা টানিয়ে দেয়াতে আমাদের আনন্দের মাত্রা বেড়ে গেছে কয়েক গুন । সারা দিন হৈই চৈই । বিকেল বেলা সবাই মিলে ছাদে খেলা করতাম । এতো বিশাল ছাদ আমি আগে কখনও কল্পনাও করতে পারতাম না তা আবার নিজেদের । ছাদ সাধারনত মা তালা দিয়ে রাখতেন । শুধু বকেল বেলায় খুলে দিতেন । সন্ধ্যার পর শুধু পড়তে বসতাম । রাতে খাওয়া দাওয়ার পর কাকুর কাছে গল্প শুনতে বসা । কাকু নিত্য নতুন ভূতের গল্প বলে আমাদের ভয় পাইয়ে দিতেন । মাঝে মাঝে মাও আমাদের সঙ্গে এসে যোগ দিতেন । গল্প শেষে মা প্রায়ই হেসে বলতেন । ভুত বলে কিছু নেই ।

দেখতে দেখতে আমার এস এস সি পরীক্ষা চলে এলো । ভাল রেজাল্ট করতে পারলে বাবা রেসিং সাইকেল কিনে দেবো । তাই রাত জেগে পড়া শুনা করছি । ভাল রেজাল্ট করার চাইতে আমার সাইকেলটার দিকেই বেশি মনোযোগ । বাসার সবাই ঘুমিয়ে গেলেও আমি সারা রাত জেগে পড়ি । মাঝে মাঝে ঘরের ভেতর হাটা হাটি করি । বেশি খারাপ লাগলে ছাদে চলে যাই । কাকুর ভাষ্য মতে রাতের একটি ভাষা আছে । তাছাড়া রাতের আকাশ ও আমার দেখতে খুব ভাল লাগে । বিশাল রহস্যময় আকাশের শৈল্পিক কারুকার্য আমাকে সব সময় মুগ্ধ করে ।

(২)

সেদিন ছিল পূণিমার রাত । রাত প্রায় তিনটা বাজে । আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলাম । বাসার সবাই ঘুম । হঠাৎ ছাদ থেকে ধুপ ধুপ শব্দ ভেসে এলো । বিকেল বেলায় আমরা ছাদে খেললে যেমনটি শব্দ হয় ঠিক তেমনটি । আমি বেশ অবাক হলাম , এতো রাতে ছাদে আবার কে খেলছে !

কাকু আর আমি একই রুমে থাকি । বেশ কয়েকবার শব্দ হওয়ায় কাকুকে ডাক দিলাম । কাকুর উঠার নামটি নেই । নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে । অনেকক্ষন ডাকা ডাকি করার পরে কোন রকম মাথা তুলে বললেন তুই গিয়ে দেখনা কে ?
ইদুর টিদুর হবে হয়তো । বলে কাকু আবার নাক ডাকতে শুরু করলেন । এদিকে ছাদের শব্দ দৌড়া দৌড়ি পর্যায় পৌছে গেছে । আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম আমার তেমন ভয় করছেন । বরং দেখতে ইচ্ছে করছে এতো রাতে ছাদে কে দৌড়া দৌড়ি করছে ।

আমাদের রান্না ঘরের দেয়ালে মা ছাদের চাবি ঝুলিয়ে রাখেন । আমি ঘর থেকে বেড় হয়ে ছাদের চাবি নিলাম । আমাদের ফ্লাট থেকে বেড় হতেই ডান দিক দিয়ে উঠে গেছে ছাদের সিঁড়ি । প্রতিটি বারান্দায় বাতি জ্বলছে । তিন তলার বারান্দা গুরে ছাদের সিঁড়ি । আমি ছাদের সিঁড়িতে উঠার পরও আমার কোন ভয় লাগছিল না । তিন তলা থেকে ছাদের ছাদের দরজা দেখা যায় । বন্ধ দরজা । তালা দেখা যাচ্ছে । তবে ছাদে শব্দ করছে কে ?

আমি ছাদের তালা খুলে ফেললাম । চাঁদের আলোয় ছাদ ভেসে যাচ্ছে । ছাদে বেড় হলেই সামনে রবিন চাচ্চুদের ৪ তলা বাড়ী । রবিন চাচ্চুদের বাসা থেকে আমাদের পুরো ছাদটা দেখা যায় ।

ছাদের এ মাথা ; ও মাথা বেশ ভাল করে দেখলাম কেউ নেই । আমি বেশ অবাক হলাম । তা হলে শব্দ করলো কে ? পানির ট্যেন্কির উপড় দেখলাম । না । কেউ নেই । এবার কিন্তু আমার গা বেশ কেমন ছমছম করছে । আশে পাশের বাড়িগুলোর দিকে বেশ কয়েকবার তাকিয়ে আমি নীচে নেমে এলাম ।

ঘরে এসে ডকডক করে দু গ্লাস পানি খেলাম । এমনিতেই আমি বারবার হিশু পায় বলে রাতেরবেলা পানি কম খাই । কিন্তু সেদিন তেস্টা যেনো আর মিটছিলো না । ২য় গ্লাস পানি শেষ করার মুর্হুতে আবার ধুপ ধুপ শব্দ ভেসে এলো । আমি গ্লেলাসটি রেখে উঠে পড়লাম । ছাদের সিঁড়িতে এসে দেখি ছাদ তালা মারই আছে । দরজা বন্ধ । কিন্তু দরজার ওপাশেই কে যেনো দৌড়াচ্ছে । আমি ভয়ে ভয়ে তালা খুলে ছাদে এলাম । আবারও চাঁদের আলোয় চোখ ভেসে গেলো । আমি পুরো ছাদ বেশ ভাল করে দেখলাম । না । কেই নেই । নিজেকে কেমন বোকাবোকা মনে হলো । নিজেকে শান্তনা দিলাম হয়তো রাত জেগে পড়ার ফলে উল্টা পাল্টা শব্দ শুনছি ।

ছাদ তালা দিয়ে নামার জন্য পেছন গুড়তেই চমকে উঠলাম । হাতের ডান পাশে সিঁড়ির শেষ মাথার ছাদের দেয়াল ঘেষে কে যেনো বসে আছে । ভয়ে আমার বুক তখন হাপারের মতো উঠা নামা করছে । আমি কোন রকম জিজ্ঞষ করলাম । কে ! কে ওখানে ? হালকা আলো স্পষ্ট দেখা যাচ্চে দু’হাটুর মাঝ খানে মাথা রেখে কে যেনো বসে আছে ।
ছোট্র শরীরটা দেখে আট দশ বছরের বাচ্চা বলে মনে হলো । আমি কানে তখন কিচ্ছু শুনছি না ।
চোখেও ভাল করে দেখছি বলে মনে হলো না ।
শুধু তাকিয়ে আছি । আর জোড়ে জোড়ে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করছি কে ! কে ওখানে ?

বেশ কয়েক বার চিৎকার করতেই সামনে বসে থাকা কায়াটা হাটু থেকে মাথা তুলে আমার দিকে তাকালো । ভয়ে আমি চমকে উঠলাম । জাপানি ভুতের সিনামায় দেখা আট নয় বছরের একটি ছেলে আমার দিকে হাটু থেকে মুখ তুলে তাকালো । বড় বড় দুটো চোখ । সমস্ত মুখ কেমন ফেকাসে হয়ে আছে ।
অনেকক্ষন পানিতে ভিজলে চামড়া যেরকম ফেকাসে হয় তেমনটি ।
আমি আরো জোড়ে চিৎকার করলাম কে কে ?
ছেলেটি কোন উত্তর দিলো না শুধু একটি হাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো ।
আমি ভয়ে তখন কি ভাবে যে নীচে নেমে এলাম বলতে পারবো না ।
যখন চোখ খুললাম তখন দেখি আমি বিছানায় শুয়ে আছি মা ;বাবা,কাকু আর একজন ডাক্টার আমায় ঘিরে আছেন ।
বাবা কাকুকে বকছেন আমদের কেন ভুতের গল্প শুনায় তার জন্য । মা’র হাতের ফাঁক দিয়ে আমার চোখ যখন দরজার কাছে গেলো তখন আবার চমকে উঠলাম । ছাদে দেখা ছেলেটি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে । আমার চোখা চোখি হতেই । ডান হাতটি আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো । আমি আবার জ্ঞান হারালাম ।
সে বার আমাকে অনেকদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিলো । কিন্তু আশ্চযের বিষয় সে রাতের পর ঐ ছেলেটিকে আর কোনদিন দেখা যায়নি আমাদের ছাদে দেখা যায়নি। সে রাতে অবশ্য আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল সেটি হলো আমাদের পাশের বাসার রবিন চাচ্চু মারা গিয়েছিলো । ভাল মানুষ হঠাৎ নাকি কি দেখে খুব ভয় পেয়েছিলেন । প্রিয় পাঠক এ দুটো ঘটনার মাঝে কোন মিল আছে কিনা আমি বলতে পারবনা ।আপনারা ভেবে দেখুন ।।
READ MORE - ঘটনাটি ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় ১৫ বছর আগে ।

আমি আগাগোড়াই রাজধানীতে বেড়ে উঠা মানুষ।

আমি আগাগোড়াই রাজধানীতে বেড়ে উঠা মানুষ। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব ঢাকাতেই ছিল। কিন্তু বর্তমানে চাকুরী করছি ঢাকার বাইরে। মূলত ভালো বেতন এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধার লোভেই এখানে আসা। আমার পরিচিত বলতে এখানে কেউ নেই। বা-মা, বন্ধু-বান্ধব, আত্নীয়-স্বজন সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন আছি গত মাস-চারেক ধরে। প্রথম প্রথম কয়েকদিন খুব খারাপ লেগেছিল। পরিবারের মানুষগুলোর কাছ থেকে কখনো দূরে থাকতে হয়নি বলে তাদের অভাবও কোনোদিন অনুভব করিনি। আসলে মানুষ যখন নিয়মিত কাউকে দেখে, কারো সাথে মেশে…তার অভাব কখনো বোধ করেনা বরং তার নিয়মিত উপস্থিতিই মাঝে মধ্যে একঘেঁয়ে লাগে।

আমাদের কোম্পানীতে স্টাফদের থাকার জন্য একটি আলাদা কোয়াটারের ব্যবস্থা আছে। সমস্যা একটাই, তা হল-এক রুম দুজনকে শেয়ার করতে হয়। আমার রুমমেট হলেন আদিল ভাই। তিনি আমার ডিপার্টমেন্টেই কাজ করেন। আদিল ভাইকে পছন্দ করে এমন একজন লোকও অফিসে নেই। অপছন্দের কারনটা ২-১দিনের মাথায় বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলাম। উনি কখনোই কোনো কথা সোজা ভাবে বলেন না। প্রত্যেকটা কথার মধ্যে একটা খোঁচা থাকবেই। আকার-ইঙ্গিতে, ভাব-ভঙ্গিতে সবসময় বোঝাতে চেষ্টা করেন যে তার চেয়ে জ্ঞানী এবং দক্ষ লোক এই অফিসে আর কেউ নেই। আর চোখে মুখে সর্বদাই কেমন যেন একটা রহস্যের আঁভা দেখতে পাওয়া যায়। ভাবখানা এমন যে উনি কোনো আধ্যাত্নিক টাইপের লোক। অফিসের মোটামুটি সব কলিগের সাথেই নাকি অন্তত একবার হলেও তার কথা কাটাকাটি হয়েছে। ইদানিং অবশ্য সবাই তাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। আমার এমনই পোঁড়া কপাল যে এই লোকই আমার রুমমেট!

একসাথে একই রুমে থাকলে মানুষের ভীমরতিগুলো খুব চোখে পড়ে। প্রত্যেকটা মানুষেরই অবশ্য কিছু না কিছু ভীমরতি থাকে সেটা মেনে নেয়াই যায় কিন্তু এই লোকের ভীমরতির কোনো শেষ নেই। তাছাড়া মাঝে-মধ্যে এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথাবার্তা বলেন যে হজম করা খুব কষ্ট হয়ে পড়ে। মোট কথা কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে তার সাথে একরুমে থাকা প্রায় অসম্ভব। ৩-৪ দিনের মাথায় আমার নাভিশ্বাস উঠে গেল। আমি অফিসের আর একজন সিনিয়র কলিগ রেহান ভাইয়ের সাথে আমার সমস্যার কথা শেয়ার করলাম। রেহান ভাইয়ের সাথে প্রথম দিন থেকেই আমার একটা সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। উনি জানালেন যে কেউই নাকি আদিলের রুমে বেশিদিন টিকতে পারে নাই। ঐ রুমে নাকি একটা বেড বেশিরভাগ সময় ফাঁকাই থাকে । তবে তিনি আমাকে হুট করে রুম না ছাড়ার পরামর্শ দিলেন। কারন হিসেবে বললেন যে, আদিল মারাত্নক গিরিঙ্গিবাজ ও ঝঁগড়াটে লোক। রুম ছাড়ার মত ছোট একটা ঘটনাকে বিশাল ইস্যু বানিয়ে গ্যাঞ্জাম-ক্যাচাল সৃষ্টি করবে এটা মোটামুটি নিশ্চিত। আমার মত একজন নতুন ইমপ্লয়ীর জন্য সেটা নাকি মোটেও সুখকর হবেনা।

কিন্তু এদিকে তো আমার জান যায় যায় অবস্থা। মাঝে মাঝে আদিলের উপর মেজাজ এমন খারাপ হয় যে ইচ্ছে করে বাম হাতে একটা থাপ্পর লাগাই। এই তো সেদিন…কথা নাই বার্তা নাই রাত তিনটার দিকে হঠাৎ আমাকে ডাকতেছে, তাও আবার উচ্চস্বরে! আমি তো হুরমুর করে জেগে উঠলাম। উঠে দেখি উনি একটা নিভানো সিগারেট মুখে নিয়ে বসে আছেন। আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “”আপনি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন? হঠাৎ সিগারেট ধরাতে গিয়ে দেখি ম্যাচ নেই। আপনার কাছে ম্যাচ হবে”?” আমার মেজাজটা এত খারাপ হয়েছিল যে বলার মত না! নিজেকে অনেক কষ্টে সামলালাম। তাকে কোনো উত্তর না দিয়েই আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন অফিসে গিয়ে রেহান ভাইকে বললাম, “ভাই আপনি আমাকে এই ভেজাল থেকে উদ্ধার করেন নাহলে আমার চাকরিই ছাড়তে হবে””। আমার কথা শুনে রেহান ভাই কিছুক্ষন হাসলেন। তারপর বললেন, “”আসলে আপনাকে আগে কোনোদিন রুম শেয়ার করতে হয়নি তো তাই আপনি একটু বেশিই বেকায়দায় পড়ে গেছেন। তাছাড়া আপনার ভাগ্যটাও এত খারাপ যে আদিলের সাথেই আপনাকে রুম শেয়ার করতে হচ্ছে। যাকগে টেনশনের কিছু নেই। আপনার একটা ব্যবস্থা আমি করবই””। রেহান ভাইয়ের কথায় আমি আশ্বস্ত হতে পারলাম না। উনি কিইবা ব্যবস্থা করবেন? হয়ত আমাকে একটু সান্ত্বনা দিলেন। হয়ত তিনি ধরে নিয়েছেন কদিন পর আমার এমনিতেই এডজাস্ট হয়ে যাবে। মানুষ পারে না এমন কি কিছু আছে?

এভাবেই আরো বেশকটা দিন পার হয়ে গেলো। আদিলের সাথে এডজাস্ট করা কোনোদিনই সম্ভব হবে না তা আমি ভালোভাবেই জানতাম। পরিবার পরিজন থেকে দূরে থাকায় এমনিতেই মন খুব একটা ভালো থাকে না তার উপর আদিলের মত একটা পেইন! মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম…আমার সমস্যার কথা বসকেই জানাবো। তিনি কোনো ব্যবস্থা না করলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যাবো।

এর মাঝে তিনদিনের টানা ছুটি পেয়ে একদিন ঢাকায় চলে গেলাম। ছুটি কাটিয়ে যখন আবার কোয়াটারে ফিরলাম তখন দেখি আদিল নামক “পেইন”টা নেই। আশেপাশের কলিগদের কাছে জানতে পারলাম সে নাকি ৭দিনের ছুটি নিয়েছে। কথাটা শুনে মনে মনে ঈদের আনন্দ পেলাম। যাক ৭দিন অন্তত মহাসুখে কাটানো যাবে। কিন্তু সেদিন রাতেই ঘটল আমার জীবনে এক স্মরনীয় ঘটনা। বলে রাখা ভালো যে, আমি যে রুমে থাকি তা নিচতলায় অবস্থিত। নিচতলায় মশার উপদ্রপ বেশি বলে কখনোই জানালা খুলে ঘুমাই না। সেদিন কেন জানি মনে হচ্ছিল জানালা খুলেই ঘুমাবো। পরে আবার চিন্তা করলাম…থাক দরকার নেই। দরজা-জানালা সবকিছু লক করা আছে কিনা তা চেক করে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।

মাঝরাতে হঠাৎ নিম্নচাপ অনুভব করায় ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। উঠে যা দেখলাম তা দেখে তো আমার চক্ষু ছানাবড়া। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে যা দেখছি তা ঠিক দেখছি কিনা! ভালো করে চোখ ডলতে লাগলাম। দেখলাম…আদিল ভাইয়ের খাটের উপর যে তোশক এবং চাঁদর ছিলো তা মেঝেতে ফালানো। খাটের এক কোনার দিকে তা স্তুপাকৃতি হয়ে আছে। কিন্তু কে করলো এই কাজ? বাসায় তো আমি একা! চোর ডাকাত ঢুকলো নাতো বাসায়? আমি উঠে দরজা-জানালা সবকিছু আবার চেক করলাম। কই সবই তো ঠিক আছে। চোর ডাকাত ঢুকলে তো দরজা-জানালা ভেঙ্গে ঢুকতে হবে। সব দরজা-জানালা ভিতর থেকে লক করা। তাহলে চোর ঢুকলো কিভাবে? তাছাড়া আমার দুটা দামী মোবাইল সেট, নেটবুক ছাড়াও আরো অনেক জিনিসপত্র আছে বাসায়। চোর ঢুকে থাকলে সেগুলো রেখে যাবে কেনো? তার মানে কি দাড়ালো এটা কোনো ভুত-প্রেতের কাজ?…এছাড়া এই ঘটনার আর কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারলাম না। আমি ছোটবেলা থেকেই ভুত-প্রেতে বিশ্বাস করিনা। কিন্তু এখন চোখের সামনে যা দেখছি তাই বা অবিশ্বাস করি কিভাবে? মনে মনে ঠিক করলাম অন্য কলিগদের এত রাতে আর বিরক্ত করবনা। একটু পরেই তো সকাল হবে তখন সবাইকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলব।

ভোরের আলো ফুটতেই আমি নক করলাম লিমন ভাইদের ফ্ল্যাটে। আমার ঠিক পাশের ফ্ল্যাট। এত সকালে আমাকে দেখে একটু অবাকই হলেন লিমন ভাই। আমি লিমন ভাইকে রুমে নিয়ে আসলাম। পুরো ব্যাপারটা খুলে বললাম। উনি আমার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন। আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন…””তার মানে আপনি বোঝাতে চাচ্ছেন এগুলা ভুতের কাজ? দেখেন…আমি এসব অতিপ্রাকৃ্তিক ব্যাপার স্যাপার একদমই বিশ্বাস করিনা। আপনার নিশ্চয়ই কোনো ভুল হচ্ছে। হয়ত আপনি ঠিকমত দরজা লক করে ঘুমান নি। দরজা খোলা ছিল এবং খোলা দরজা দিয়ে কেউ ঢুকে এই কাজ করেছে”।” আমি লিমন ভাইকে বললাম, ““ভাই, আমারও আপনার মতই এরকম কিছু একটা সন্দেহ হচ্ছিল। তাই সবার প্রথমে দরজা খোলা আছে কি না তা চেক করেছি। আর খামাখা তো আমার এরকম একটা নাটক সাজানোর কোনো দরকার নেই, তাই না?”” লিমন ভাই হেসে বললেন, ““আমি কি বলেছি নাকি আপনি নাটক সাজিয়েছেন? তবে আমার মনে হচ্ছে ঘুমের ঘোরে কাজটা আপনিই করেছেন কিন্তু এখন আর মনে করতে পারছেন না”।” লিমন ভাইয়ের কথা শুনে আমার মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেলো। আমি চিৎকার করে বললাম, “”তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন আমি সিজোফ্রেনিক?”” আমার চিৎকার শুনে দেখি রেহান ভাই হাজির। উনি আমার সব কথা শুনে বললেন, “”আচ্ছা আপনি কি নিশ্চিত যে আপনার কোনো কিছুই খোয়া যায় নি? আপনি একটু ভালো করে দেখবেন সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা?”” আমি রেহান ভাইকে বললাম, “”ভাই আপ্নারা কেনো বিশ্বাস করছেন না যে এখানে চোর ঢোকেনি। এখানে অন্যরকম কিছু একটা ঘটেছে”।” রেহান ভাই বললেন…””আপনি এই মূহুর্তে মেন্টাল স্ট্রেসের মধ্যে আছেন। এই অবস্থায় স্বাভাবিক চিন্তা করাটা কঠিন। আমি যা বলি শুনুন। একটু ভালো করে খোজ করুন যে আপনার কিছু খোয়া গেছে কিনা!”” রেহান ভাইয়ের কথা শুনে মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করলাম। হঠাৎ মনে হল যে আমার মানিব্যাগটা চোখে পড়ছে না। তন্ন তন্ন করে সারা রুম খুজলাম কিন্তু মানিব্যাগটা আর খুজে পেলাম না। আমার মনে পড়ল যে কাল রাতে আমি আমার মানিব্যাগটা রেখেছিলাম আদিল ভাইয়ের খাটের উপর। রেহান ভাই বললেন, “”কাল রাতে একটা চোর আমার রুমের জানালাও খোলার চেষ্টা করেছে কিন্তু ভিতর থেকে লক করা ছিল বলে খুলতে পারেনি। আমার অবশ্য সেই সময় চিৎকার করা উচিৎ ছিল তাহলে হয়ত চোরটা পালিয়ে যেত আর আপনার উপর দিয়ে এই শনির দশা যেত না। ভুল হয়ে গেছে। আমি খুবই সরি”।” আমি বললাম…””ভাই আমার জানালাও তো লক করা তাহলে চুরির ঘটনা কিভাবে ঘটল? আমি বা আদিল ভাই তো কখনো জানালা খুলিনা। এই দেখেন এখনো জানালা লক করা”।” রেহান ভাই লক করা অবস্থায় আমার থাই জানালা খোলার চেষ্টা করলেন এবং অবাক বিস্ময়ে দেখলাম জানালাটি খুলে গেলো। রেহান ভাই হেসে বললেন, “”আপনার জানালার লক নষ্ট। চোর ঠিকই জানালা খুলেছে এবং হাত বাড়িয়ে আস্তে আস্তে আদিলের তোশকটি টেনে এনেছে। তার চুরির লক্ষ্যবস্তু ছিল আপনার মানিব্যাগটি যা আপনি ভুলে আদিলের বিছানার উপর রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তবে রসিক চোর চৌর্যকর্ম শেষে জানালাটা টেনে ঠিক আগের অবস্থায় রেখে গেছে। তাই তাৎক্ষনিকভাবে চুরির ব্যাপারটা আপনার মাথাতেই আসেনি”।”

রেহান ভাইয়ের কথা শুনে লিমন ভাই হো হো করে হাসতে লাগলেন। আমাকে টিটকিরির সুরে বললেন, “”ভাই আমি আপনার কথা শুনে কিন্তু একটা সময় বিশ্বাসই করে ফেলছিলাম যে এটা ভুতের কান্ড। আপনি আমার এতদিনের লালিত বিশ্বাস মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রায় ভেঙ্গে ফেলেছিলেন…হাহাহাহাহাহা!”” উনার কথা শুনে আমিও হেসে দিলাম।

রেহান ভাই আমাকে বললেন, “”এখন অফিসে গিয়ে পুরো ব্যাপারটা বসকে জানান। গিয়ে বলেন যে এই রুমে আপনি মোটেও নিরাপদ না। আর দোতালায় জহির সাহেবের রুমে একটা বেড খালি আছে। আপনি বসকে বলে আজকেই সেখানে উঠে যান”।”

আমি বসকে পুরো ব্যাপারটা জানালাম। উনি কোয়াটারটির সিকিউরিটি ম্যাটার নিয়ে খুবই কনসার্ন্ড হলেন এবং পুরো ব্যাপারটার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। আমি সেদিনই আমার রুম চেঞ্জ করে ফেললাম। সেদিন থেকে আজ অবধি বেশ শান্তিতে আছি। আমি এখন আদিল থেকে মুক্ত। যদিও আমার মানিব্যাগে হাজার পাঁচেক টাকা ছিল এবং বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজ ছিল কিন্তু এটা কোনো ব্যাপারই না। মানিব্যাগটা চুরি না হলে তো আর আদিলের মত মহাপেইন থেকে মুক্ত হতে পারতাম না এত সহজে!

ঘটনার সপ্তাহখানেক পর একদিন রেহান ভাই আমার সেই হারানো মানিব্যাগ আমার হাতে তুলে দিলেন। আমি অবাক হয়ে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম…”এটা আপনি এতদিন পর কোথায় পেলেন?” উনি রহস্যমাখা একটা হাসি দিয়ে বললেন, “”আমি কিন্তু কথা দিয়েছিলাম যে আপনাকে আদিল থেকে মুক্ত করার একটা ব্যবস্থা করবই”।”
READ MORE - আমি আগাগোড়াই রাজধানীতে বেড়ে উঠা মানুষ।

তখন চলতে ছিল আষাঢ় মাস।

তখন চলতে ছিল আষাঢ় মাস। আষাঢ় মাস ভ্রমনের জন্য মোটেও সুবিধার নয়। যখন তখন বৃষ্টির ফলে রাস্তা-ঘাট কাদায় সয়লাব হয়ে থাকে। তারপরও আমাকে যেতে হয়েছিল। কথা ছিল ভ্রমন সংঙ্গি হিসাবে আমার বাল্যবন্ধু ইমরান থাকবে। কিন্তু যাবার আগের দিন ইমরান আমাকে চৌধুরী সাহেবের বাড়ি যাবার বিস্তারিত ঠিকানাটা হাতে ধরিয়ে দিল। করুন গলায় বললো, দোস্ত প্লিজ তুই একা গিয়ে ঘুরে আয়। আমার অফিসের জরুরী কাজে আমাকে চট্রগ্রাম যেতে হবে। কণে তোর পছন্দ হলে পরের বার আমি আর তুই যাব।

ওর এমন অনায্য দাবী শুনে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। সাথে সাথে তির্ব প্রতিবাদ করে বললাম, এটা তোর খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। তুই জানিস আমি কেমন। আমার পক্ষে কিছুতেই অপরিচিত জায়গায় একা যাওয়া সম্ভব নয়। আর নিজের পাত্রী দেখতে যাব নিজেই! ছিঃ কেউ একা কণে দেখতে যায়?
আমার ভৎসনায় ওরে খুব বিচলিত দেখায়। ও ভাল করেই জানে মেয়েদের ব্যাপারে আমার সিমাহিন অস্বস্তির কথা। ২৮ বছর পেরিয়ে যাবার পরও মেয়েদের ব্যাপারে আমার লাজুকতা ভয়াবহ পর্যায়ে। কিন্তু ইমরানের নানা যুক্তির কাছে, আর সারা জীবনের সবচেয়ে কাছের বন্ধুর দাবীর কাছে পরাজয় হয় সব কিছুর। আমি গিয়ে ছিলাম কুসুমপুর। তার গল্পই বলব আজ।

সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল খুব। রেলের কাচের জানালা দিয়ে সেই বৃষ্টি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে ছিলাম। কতক্ষন ঘুমিয়ে ছিলাম আমি জানিনা। রেল যখন ঝাকুনি দিয়ে থামল ধরমর করে উঠলাম। ততক্ষনে বেশিরভাগ যাত্রী নেমে গিয়েছে। বৃষ্টিপাত তখনও চলতেছিল। দৌড়ে প্লাটফর্মে ঢুকলাম বটে তবে শরীরের বেশ কিছুটা ভিজে গেল আষাঢ়ের বৃষ্টিতে। ষ্টেশন মাষ্টারের কক্ষের সামনে দাড়িয়ে ভিজে যাওয়া চশমার গ্লাস পরিস্কার করলাম। কেমন যেন ঝাপসা দেখছি সব। মাথাটাও ঝিমঝিম করছে। টানা সাত ঘন্টার রেল ভ্রমনের ক্লান্তিতে এমনটা হয়েছে বোধহয়।

ষ্টেশন মাষ্টারের কক্ষটা বহুদিন চুনকাম করা হয়নি। অনেক জায়গায় প্লাস্টার উঠে গিয়ে লাল ইট বেরিয়ে আছে। স্যাতসেতে দেয়াল। ষ্টেশন মাষ্টারের চেয়ারের বাম পাশে একটা কাঠের আলমারী। আলমারীর দরজা আটকানো থাকলেও আলমারীর উপরে পুরাতন রেজিষ্টার খাতা আর ময়লা ফাইলের স্তুব। ষ্টেশন মাষ্টারের চেয়ারের একটা হাতল নেই। তেল চিটচিটে হয়ে চেয়ারটা তার আসল চেহারাটা হারিয়ে ফেলেছে। ভদ্রলোকের গায়ের রং কালো। বয়স ৫০বছরের বেশি হবে। গালে বিশ্রি একটা কাটা দাগ। তবে গোফটা বেশ ভারি। যতœ করে গোফটাকে কামিয়েছেন ষ্টেশন মাষ্টার।
আমি তাকে সালাম দিলাম । তিনি বিরক্তিভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। টাই পরা সুশ্রী আমাকে অন্যরা সমিহ করলেও তিনি আমাকে যেন খেয়ালই করতে চাইল না। গলা পরিস্কার করে আমি তাকে কিছু বলতে গেলাম ঠিক তখনি সে মাথা ঘুরিয়ে বললো, ঢাকার ট্রেন আগামীকাল সকাল ৯টায়।
- আমি কিছুক্ষন আগের ট্রেনে ঢাকা হতে এসেছি। এসেই একটা ভয়ানক সমস্যায় পড়েছি। কথা ছিল শরিফ চৌধুরীর লোকজন আমার জন্য গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবেন। কিন্তু এখন ষ্টেশনে কাউকে খুজে পাচ্ছিনা। এমনকি কোথাও একটা রিকশাও পেলাম না।
আমার কণ্ঠে অসহয়ত্ব প্রকাশ পেলো। কিন্তু ষ্টেশন মাষ্টার বেশ নির্বিকার ভাবে বললো, জমিদারী চলে গিয়েছে ৪০ বছর আগে, কিন্তু ওনার ডাট কমে নাই!
আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম ষ্টেশন মাষ্টারের ধৃষ্টতা দেখে। বিস্ফোরিত চোখে প্রশ্ন করলাম, কি বলছেন এসব? আমার কথার উত্তর না দিয়ে তিনি বললেন, চৌধুরী সাহেবের বাড়িতো মহল্লার শেষ মাথায়। তাছাড়া দু’দিন ধরে যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছে তাতে রাস্তায় হাটু পানি জমে গেছে। চৌধুরী সাহেব আপনার জন্য একটা রিকশা পাঠিয়ে ছিলেন, তবে রেল দুই ঘন্টা লেট করে আসায় আর তুফান থাকায় সে হয়ত চলে গিয়েছে।
আমি হাতঘড়িতে চোখ রাখলাম, রাত ১০টা বেজে ৩৬ মিনিট। গ্রামে অবশ্য সাড়ে দশটাই অনেক রাত। আর সেটা যদি হয় ঝড় বৃষ্টির রাত!
ওয়েটিং রুমের বেঞ্চিতে এসে বসে পড়লাম। ভারি ক্লান্তি লাগছে। পেটের ভেতর খিদেরাও আক্রমন চালাতে শুরু করে দিয়েছে। অসহ্য লাগতে ছিল। বুঝতে পারছিলাম না কি করে এই অনাকাঙ্খিত বিপদ হতে উদ্ধার পাবো। বন্ধু ইমরানের চৌদ্দ্যগুষ্টি উদ্ধার করতে লাগলাম। বার বার ঘড়ি দেখতে ছিলাম। সেকেন্ডের কাটা গুলি যেন ঘন্টার কাঠা হয়ে গেল, সময় কাটতে চাইছিল না। তারপরও বসে বসে একঘন্টা কাটিয়ে দিলাম, কিন্তু বৃষ্টি থামার কোন লক্ষন দেখলাম না। দেয়ালের পেরেকের সাথে হারিকেন ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। বাতাসে হারিকেনের আলো কাঁপছে। ঘোলা কাচের ভেতর থেকে লাল ফ্যাকাসে আলো গভির অন্ধকারের কাছে তেমন পাত্তা পাচ্ছেনা।

ওয়েটিং রুমে এখন আর কেউ নেই আমি ছাড়া। বাইরের বৃষ্টির শব্দ আর রাতের নিঃসঙ্গ নিজর্ণতা মিলে ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। আমার গা ছমছম করছিল। ভয় পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল অচেনা পৃথীবিতে চলে এসেছি আমি। জানালা দিয়ে বাইরের নিকষ কালো অন্ধকার ঘরে ঢুকছে। ভয়াবহ এমন সময়ে হঠাৎ মনে পড়ল আরে আমার কাছেতো চৌধুরী সাহেবের বাসার নাম্বার আছে! কি বোকাই না আমি! উঠে দ্রুত ষ্টেশন মাষ্টারের কক্ষের দিকে ছুটলাম। হতাশ হলাম, কক্ষে তালা ঝুলছে। দুরে একজন প্রহরীকে দেখলাম সিমেন্টের বেঞ্চে গুটিসুটি মেরে ঘুমুচ্ছে।
আবার আগের জায়গায় চলে এলাম। কেন যেন বার বার মনে হচ্ছিল আমি একটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে ডুবে আছি। সারাটা রাত হয়ত আমাকে নিঘুর্ম এখানে কাটাতে হবে। হাতঘড়ির দিকে তাকাতেও বিরক্ত লাগতে ছিল। নিজেকে অভিসাব দিয়ে ভাবছিলাম কেন ঝোকের মাথায় এভাবে চলে এলাম?
বিরক্তি কাটানোর জন্য চৌধুরী সাহেবের অদেখা মেয়েটার কথা ভাবতে লাগলাম। ইমরান বলছিল মেয়েটার চেহারা নাকি অনেক সুন্দর। মায়া ভরা মুখ। দেখলেই মনে ভরে যাবে। গলার স্বরও নাকি খুব মিষ্টি। ভাল রবীন্দ্র সংগীত গায়। যাক বিকেলে বারান্দায় বসে কফি খেতে খেতে ওর রবীন্দ্র সংগীত শোনা যাবে।
চোখে তন্দ্রামত এসেছিল বোধহয়। হঠাৎ নারী কণ্ঠের শব্দে চোখ খুলে তাকালাম। আর তাকাতেই বিস্মিত হলাম। আমার সামনে দাড়িয়ে আছে অপূর্ব সুন্দরী একটি মেয়ে। সেও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লাল শাড়িটা তাকে খুব মানিয়েছে। মনে হচ্ছে স্বর্গের হুর ভুল করে মর্তে চলে এসেছে। মায়াবি চেহারার দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরাতে পারতে ছিলাম না। হাসনে হেনার তির্ব গন্ধে সারা রুম ভরে গিয়েছে। তরুণী কি হাসনে হেনার গন্ধযুক্ত কোন পারফিউম ব্যবহার করেছে? তার ফর্শা হাতের দিক তাকালাম। মেহেদি দেওয়া হাতে কাচের চুড়ি।অদ্ভদ ঘোরলাগা মুহূর্ত। সে বললো, আপনি নিশ্চয় শফিক সাহেব, তাইনা?
আমি বললাম, হ্যা। কিন্তু আপনি কে?
আমি মেহজাবিন চৌধুরী। বাবা আপনার জন্য যাকে পাঠিয়ে ছিল সে অবিবেচকের মত চলে যাওয়ায় আমি খুবই দুঃখিত। আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি। উঠুন। সে আমার দিকে তাকিয়ে নির্দেশ করে।
বিস্মিত আমি কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম মেহজাবিন এর আচরনে। এতরাতে একটি মেয়ে কি কওে অচেনা এক পুরুষের জন্য গাড়ি নিয়ে ষ্টেশনে আসে? আর গাড়ি থাকলে তার বাবা কেন রিকশা পাঠিয়ে ছিলেন? বুঝতে পারছিনা কি করবো। আমার দ্বিধা দেখে বিরক্তি ভরা কণ্ঠে বলে, কি হলো আসুন। আমার হাতে সময় খুব কম।
ব্রিফকেসটা হাতে নিয়ে মেহজাবিনকে অনুসরন করি।
পুরানো দিনের নীল রংয়ের একটি জিপ গাড়ি। গাড়ির ভেতরের লাইট নেই। সামনে হেড লাইটের আলোয় মেহজাবিনকে দেখছি। অসিম শূন্যতা মেয়েটার চোখে। কিছুটা দুঃচিন্তাগ্রস্থ বলেও মনে হল। মেয়েদের পাশে অনেক বার বসেছি, কিন্তু আজ কেন জানিনা অন্যরকম লাগছে। আমি বললাম, আপনাদের এখানে কি বিদুৎ নেই? সে গভির ভাবনায় ডুবে ছিল উত্তর দিলনা। আমিও কথা বলার মত কিছু খুজে পেলামনা। আমি তাকে প্রথম দেখায় ভালোবেসে ফেলেলাম। কি আশ্চর্য ২৮ বছরের জীবনে এমনটা কখনো ঘটেনি। এত সহজে কারো প্রেমে পড়া যায় আমার ভাবনায় তা ছিলনা। আমি খুবই আশ্চর্য! ইচ্ছে করছে এখুনি তাকে বলি যে আমার কণে পছন্দ হয়েছে। মেহজাবিন আপনাকে আমার খুব ভাললেগেছে।
কিন্তু তাকি উচিৎ হবে? ব্যাপারটা বেশ হাস্যকর হয়ে যাবে ,তাই ওপথে না গিয়ে প্রশ্নকরি আপনাদের বাড়িতে যেতে আর কতক্ষন লাগবে?
সে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো, বেশি না আর পনেরো মিনিট লাগতে পারে। আপনি নিশ্চয় খুব ক্লান্তি অনুভব করছেন?
না না, তেমন নয়। তবে অন্ধকারে একা বসে থাকার সময় বেশ ভয় পাচ্ছিলাম। শহরের মানুষতো!
সে হাসলো শব্দ করে, বলেন কি? ভুতের ভয় আছে আপনার?
না তেমনটা নয়। আসলে একা ছিলামতো!
ও আচ্ছা।
সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। বিদুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টি কমেছে। বাতাস বইছে খুব। আমি ষ্টেশনে বসে থাকা বিরক্তিকর সময় গুলো ভুলে গেলাম। মেহজাবীনকে মনে হল আমার বনলতা সেন। ইচ্ছে করছিল সারারাত তার সাথে গাড়িতে বসে থাকি। মনে মনে ইমরানকে ধন্যবাদ দিলাম আর তখনি হঠাৎ করে মনে হল, ইমরান বলেছিল চৌধুরী সাহেব তার বড় মেয়ের জন্য পাত্র খুজছেন। দ্বিধায় পড়ে গেলাম। মেহজাবীন কি বড় না ছোট?
যদি ছোট হয়? তবে বড় মেয়ে রেখে নিশ্চয় চৌধুরী সাহেব তার ছোট মেয়েকে বিয়ে দিবেন না। তেমনটা হলে আমি না হয় মেহজাবিন এর জন্য অপেক্ষা করবো। মনকে স্বান্তনা দিলাম।
ভাবনায় ছেদ পড়ল মেহজাবীনের কণ্ঠে ও বললো, নামুন আমরা চলে এসেছি। ঝাকি দিয়ে থেমে গেল গাড়িটা। সাথে সাথে হেড লাইট অফ হয়ে গেল। ব্রিফকেসটা নিয়ে নিচে নামলাম। আবছা আলোয় শ্যাওলা পড়া পুরাতন আমলের বিসাল এক লোহার গেট দেখলাম। ইটের তৈরী বেশ চওড়া একটা রাস্তা দেখলাম। এটা যে এককালে জমিদার বাড়ি ছিল তা আধারের মাঝেও টের পাওয়া গেল। মেহজাবীন বললো, আপনি ভেতওে যান, বাবা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।
আপনি?
আমি পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকবো। বাবা যদি জানে ষ্টেশনে আপনাকে আনতে গিয়েছিলাম তাহলে অনেক বকা দিবে। উনি খুব রক্ষনশীল স্বভাবের। সে হাসল। তার হাসিটা বেশ অদ্ভুদ লাগতে ছিল। তাকিয়ে দেখি জিপের ভেতর কোন ড্রাইভার নেই। বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। মুখ শুকিয়ে গেল আমার। আমার ঘাবড়ে যাওয়া বেশ উপভোগ করছে মেহজাবীন। হিহি করে হেসে উঠল সে। কি হলো যান, দরজায় কড়া নাড়–ন।
হাওয়ায় মিলিয়ে গেল যেন মেহজাবীন। হাসনে হেনার তির্ব গন্ধটাও মিলিয়ে গেল। কাপা হাতে দ্রুত দরজায় কড়া নাড়তে লাগলাম।

হাওয়ায় মিলিয়ে গেল যেন মেহজাবীন। হাসনে হেনার তির্ব গন্ধটাও মিলিয়ে গেল। কাপা হাতে দ্রুত দরজায় কড়া নাড়তে লাগলাম। আমার শরীরও কাপতে ছিল। পেছনে তাকাতে ভয় পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল কেউ একজন আমার পেছনে দাড়িয়ে আছে। জীবনে এমন অভিজ্ঞতা খখনো হয়নি আর, তাই বেশ অস্বস্তিতে ছিলাম। কি জানি হয়ত মেহজাবীন আমাকে শহরের মানুষ পেয়ে ভড়কে দিচ্ছে। ওর রহস্যময়ী আচরন আমাকে দ্বিধায় ফেলে দিল। কেউ কি নেই ঘরে? দরজায় পাল্লায় ক্রমাগত আঘাত করছি, কোন সাড়া নেই?
হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার পায়ের উপর কেউ একজন হাত রাখছে। বরফের মত ঠান্ডা হাত। ভয়ে শিড়দারা শক্ত হয়ে যাচ্ছিল। চিৎকার করতে চাইলাম কিন্তু গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হলোনা। হার্টফেল করার পূর্ব মুর্হূতে বিকট শব্দে দরজা খুলে গেল। মুখের উপর হারিকেন উচু করে ধরলো কেউ একজন। হঠাৎ চোখে আলো পড়ায় কিছুই দেখতে পাচ্ছিলামনা। কোনমতে বললাম, আমি শফিক আহমেদ ঢাকা থেকে আসছি। এটা কি চৌধুরী বাড়ি?
এবার হারিকেন নিচে নামলো। চৌধুরী সাহেব বললো, আহারে বাবা আপনাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। কি করবো যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছিল। আসেন আসেন ঘরে আসুন। আমি বিব্রত কন্ঠে বললাম, আমার পায়ের দিক আলো ফেলুন কি যেন আমার পায়ে। আলো ফেলতেই দেখি একটি বড়সড় আকারের ব্যাঙ আমার পায়ের উপর বসে আছে।
ঘরে ঢুকে অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা হল। জমিদার বাড়ি এতদিন সিনেমা আর নাটকে দেখেছিলাম কিন্তু বাস্তবে যে তা আরো বেশি আর্কষনীয় হয় তা বুঝলাম। দেয়ালে দু’নলা বন্দুক ঝুলানো। দুটো তলোয়ারও সাজিয়ে রাখা হয়েছে। হরিনের মাথা আর বাঘের চামড়াও ঝুলানো আছে। আসবাব পত্রগুলি আভিজাত্যর ছাপ বয়ে বেড়াচ্ছে।
খাবার টেবিলে আরেক জন বৃদ্ধ ভৃত্যকে পেলাম। চৌধুরী সাহেবও বসলেন আমার সাথে কিন্তু তার দু’মেয়ের কাউকেই ঘরে দেখলাম না। মনটার ভেতর খুব টান অনুভব করছিলাম। মেহজাবীন একবারের জন্য উকি দিলেও পারতো। ধুর মেয়েটা যে কিনা!
খাওয় দাওয়া শেষে কিছুক্ষন গল্প করলাম চৌধুরী সাহেবের সাথে। তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে তার বাবার জমিদারীর সময়ের নানা ঘটনা বলতে লাগলেন। তিনি জানালেন দেয়ালে ঝুলানো বাঘটাকে তিনি নিজে শিকার করেছেন। তার শিকারের গল্পও শুনলাম। একবার তিনি অল্পের জন্য বাঘের হাত থেকে বেচে গিয়ে ছিলেন সে কথাও জানলেন তিনি। তার গল্প শুনতে বেশ লাগতে ছিলেন। কিন্তু রাত অনেক হওয়ায় তা থামাতে হল। পরিস্কার বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। ক্লান্ত ছিলাম বলে খুব সহজেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙলো পরদিন সকাল ৯টায়।
কক্ষের সামনের বারান্দায় দাড়ালাম। সামনের সুন্দর ফুলের বাগান দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। অনেক ফুল ফুটেছে। বাতাশে ফুলের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। নানা জাতের অসংখ্য ফুলের গাছ। চারপাশের সবুজ গাছ পালা আর পাখির কিচির মিচির শব্দ ভীষণ ভাল লাগছিল। মুগ্ধ হয়ে অপরুপ প্রকৃতি দেখতে ছিলাম।
হঠাৎ কেউ একজন আমার হাত ধরলো। চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখি একটা নয় দশ বছরের একটা মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
কে তুমি? প্রশ্ন করতেই হাত ছেড়ে দৌড়ে পালালো মেয়েটি। আমি তার দৌড়ে যাওয়া দেখলাম। হেটে সামনে যেতেই গতরাতের বৃদ্ধ ভৃত্যটার সাথে দেখা হল। বয়স ৭০বছর হবে। ভাল করে দিনের আলোতে তার দিকে তাকালাম সে কাস্তে হাতে বাগানের আগাছা পরিস্কার করছে। বাগান ভরা ফুল, লাল নীল সবুজ ফুল। একসাথে এত ফুল দেখিনি কখনো। বৃদ্ধ একমনে কাজ করতে ছিল, কাছে গিয়ে বললাম ঐ মেয়েটি কে?
সে চোখ তুলে তাকালো, তারপর বললো, ওর নাম ময়না। আমার নাতি, বোবা কথা বলতে পারেনা। ভয় পায় ও সবাইরে ভয় পায়।
আমি প্রশ্ন করি এই বাগান কে গড়ে তুলে ছিল? সে দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে বললো মেহজাবীন। বৃদ্ধর কথাটা শুনে ভাল লাগলো। তারমানে মেহজাবীন ফুল খুব পছন্দ করে, না?
উত্তর না পেয়ে পেছনে তাকাতেই দেখি বৃদ্ধ নেই। আমি সামনের দিকে এগুতে থাকি। বিশাল বড় বাড়িটার চারদিকে সবুজের সমরোহ আমাকে মুগ্ধ করে। এমন বাড়িতে বিয়ে হলে ভালই হবে। আজ নিশ্চয় চৌধুরী সাহেবের কন্যাদ্বয়ের সাথে দেখা হবে। আচ্ছা মেহজাবীন কি আমাকে পছন্দ করেবে? কি জানি! নারী হৃদয়তো বড় বিচিত্র। তাছাড়া আমাকে তো কোন নারী কখনো সেভাবে চায়নি। হালকা টেনশনও ফিল করছিলাম।
কিছুদুর সামনে গিয়ে দেখলাম বাগানের পাশে সুন্দর সান বাধানো ঘাটের পুকুর। পুকুরে লাল রংয়ের শাপলা ফুল ফুটে আছে। আর স্বচ্ছজলের উপর মাছেরা হা করে জল খাচ্ছে! না, বোধহয় অক্সিজেন নিচ্ছে। তাকিয়ে ছিলাম মুগ্ধ নয়নে, হঠাৎ পেছন থেকে চৌধুরী সাহেবের কণ্ঠ‘ বাবা তুমি এখানে আর আমি সারা বাড়ি খুজতেছি। চল নাস্তা খাবে।
হেসে বললাম পুকুরের মাছ দেখতে খুব ভাল লাগতে ছিল। অপূর্ব!
পরে এসে বড়শি দিয়ে না হয় মাছ ধরিও। আমি তাকে অনুসরন করে পিছন পিছন যাচ্ছিলাম। ডান দিকে ঘুরতেই টিনের চালের গ্যারেজের নিচে একটা জীপ গাড়ি দেখে চমকে উঠলাম। থমকে দাড়িয়ে জিপটাকে ভাল করে পর্যাবেক্ষন করতে লাগলাম। বিস্মিত হলাম যখন দেখলাম গাড়িটার দুটো চাকা খোলা, ব্যাকডালা ভাঙা। একটা হেডলাইটও নেই। মরিচায় জর্জরিত বডি। সিটের উপর পাখির মল মুত্র। মনেহয় গত দুই এক বছর কেউ এটা ছুয়েও দেখেনি। গতরাতে কি আমি এই গাড়িতে চড়ে এসেছিলাম?
চৌধুরী সাহেব পিছন ফিরে বললো কি হলো? কি দেখছো?
আমি তাকে প্রশ্ন করলাম আপনার এরকম গাড়ি কয়টা?
একটাইতো ছিল। এটা এ্যাকসিডেন্টের পর আর সারিনি। ও আমার সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। তিনি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন।
আমি আতংকিত হয়ে পড়লাম। গলা দিয়ে কথা বের হতে চাচ্ছিলনা বিস্ময়ে। কোনমতে বললাম মেহজাবীনতো কাল রাতে…!
এবার চৌধুরী সাহেবের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। বিস্মিত নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন তুমিও দেখেছো! দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন তিনি। তার চোখে জ্বল টলমল করে।
সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, মেহজাবীন ছিল আমার বড় মেয়ে। খুব ভালবাসতাম ওরে আমরা। লেখা পড়ায় খুব ভাল ছিল। অসাধারণ ছিল ও। কিন্তু বেশি ভাল কিছু আল্লাহ পৃথিবীতে বেশি দিন রাখেন না। এই গাড়িটা ওর খুব প্রিয় ছিল। নিজে ডাইভিংও শিখেছিল। আজ থেকে ছয় বছর পূর্বের ঘটনা। সেদিন সন্ধায় ওর বান্ধবীর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান ছিল। অনুষ্ঠান শেষ করে যখন ফিরতে ছিল তখন বাইরে ছিল আষাঢ়ের বৃষ্টি। রাস্তার অবস্থাও ভাল ছিলনা। একটা ট্রাককে সাইড দিতে গিয়ে ড্রাইভার নিয়ন্ত্রন হারিয়ে খালে পড়ে যায়। এ্যাকসিডেন্টে দু’জনই মারা যায়।
কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন চৌধুরী সাহেব। আমি নিবার্ক পাথরের মূর্তির মত তার দিকে তাকিয়ে থাকি। যন্ত্রনায় আমার গলার কাছে আটকে যায় আমার খুব কাদতে ইচ্ছে করে, কিন্তু পারিনা। হৃদয় ভাঙার কষ্টযে এত কঠিন আমার জানা ছিলনা। অসহয় দৃষ্টি মেলে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া গাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকি।
তুমি কাদছো কেন?
কাল তাহলে মেহজাবীন আমাকে কি করে ষ্টেশন হতে এবাড়িতে নিয়ে এল?
কি বলছো তুমি! আঁতকে উঠে তিনি বিস্ফোরিত নয়নে তাকান আমার দিকে। আমি গত রাতের ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনা তাকে বলি। সব শুনে নিশ্চুব হয়ে যায় চৌধুরী সাহেব। কিছুক্ষন পরে বলেন, তোমার মত এমন করে অনেকেই তাকে দেখেছে। তবে আমি তা বিশ্বাস করিনি। আজ করছি। প্রতি বছর আষাঢ় মাস এলেই নাকি ওরে জীপগাড়ি নিয়ে ঘরতে দেখা যায়।
চোখ মুছে তিনি জীপ গাড়িটার দিকে তাকিয়ে বলেন, আর মায়া করে লাভ নেই। অভিসপ্ত গাড়িটাকে বিক্রি করে দিতে হবে।
তাই ভাল হবে। মাথা নিচু করে তার পেছন হাটতে হাটতে বলি।
READ MORE - তখন চলতে ছিল আষাঢ় মাস।

প্রতিদিন বিকেল হলেই বাড়ী ফিরে আসে জাহিদ ।

প্রতিদিন বিকেল হলেই বাড়ী ফিরে আসে জাহিদ । বাসা বেশ খানিকটা দুর তো বটেই.. তাছাড়া তার নতুন বিয়ে করা বউ বাসায় একা থাকতে ভয় পায় । বিকেলের দিকে গ্রামের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কাজ শেষ করে সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে । নতুন চাকরি একটু কষ্ট তো করতেই হবে । এইভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দেয় সে । তার বাসায় যাওয়ার রাস্তাটা অনেক ঘুর পথে । কয়দিন আগে একটা সর্টকাট আবিষ্কার করেছে সে । রাস্তাটা একটু নির্জন অবশ্য কিন্তু দিনের বেলায় যায় বলে ভয় লাগেনা জাহিদের ।

সেদিন কাজ শেষ করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল । প্রচন্ড শীতের সময় , ছয়টা বাজতে না বাজতেই রাতের মত হয়ে গেল। বের হওয়ার সময় একবার মনে হল ঘুরপথেই যাবে নাকি!! কিন্তু পরমুহূর্তেই হেসে উড়িয়ে দিল ও । ধুর, এই শী্তের মধ্যে এত দূর ঘুরে যাব!! তাই বড় টর্চটা হাতে নিয়ে তাড়াতাড়ি সাইকেল বের করে রওনা হয়ে গেল জাহিদ ।
রাস্তাটা পাকা নয় । পাকা হবার কথাও না । এমনিতেই মানুষজন খুব কম চলাচল করে এখান দিয়ে । প্রচন্ড শীতের মধ্যে এখন তো কারো আসার প্রশ্নই আসে না ।
হঠাৎ করেই ফুশ করে শব্দ , আর সেই সাথে সাইকেল নড়বড় ।
সাইকেল খুব জোরে চলছিল । তাই সরাসরি মাটিতে ।
শব্দ শোনার পর আর বলে দিতে হল না কি হয়েছে । জাহিদ তিক্ত মনে ভাবল বাঙালী বাঘা জিনিস । কী কী প্রবাদ যে বানাইছে । যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই কিনা সন্ধ্যা হয় ! টায়ারটাও এখনই পাংচার হইতে হইল ! হাত থেকে পড়ে টর্চটা নিভে গিয়েছিল । শংকিত মনে জাহিদ মাটি হাতড়ান শুরু করল । টর্চের মত কিছু একটা হাতে ঠেকল । তুলে নিয়ে সুইচ চাপতেই মনটা আবারো তিক্ততায় ভরে গেল । “চমৎকার !! আর কী চাই !!” এইটাও শেষ । সোজা হয়ে দাড়িয়ে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করার চেষ্টা করল জাহিদ । কি করা যায় ! অনেকক্ষন ভেবে এটুকুই বুঝল যে এখানে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করার চেষ্টা করতে থাকলে মাথা চিরদিনের মত ঠান্ডা হয়ে যাবে !
প্রথমে সাইকেলটাকে ঝোপের আড়ালে নিয়ে রাখলো কোনরকমে। নিজে কোনরকমে বাসায় পৈছতে পারলেও সাইকেলটা নিয়ে যাওয়া সম্ভব না । সকালে নিয়ে গেলেই হবে ।
তারপর আবার রাস্তায় দাড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই হঠাৎ আশায় বুকটা নেচে উঠল । দূরে গাড়ির দুটো হেডলাইট এদিকেই আসছে । এই জায়গায় গাড়ি কিভাবে এল এ চিন্তা মাথায় এলেও জাহিদ তা মাথায় স্থান দিল না । জাহিদ অপেক্ষা করতে থাকল । কিন্তু গাড়িটা খুব বেশী স্লো । জাহিদ নিজেও একটু এগিয়ে গেল । গাড়িটা ওর সামনে এসেই থামল । জাহিদ খুশি মনে গাড়ির পেছনের সীটে গিয়ে উঠল । আস্তে করে গাড়ীর দরজা লাগাতেই গাড়িটা আবার চলতে শুরু করল ।
গাড়ির ভেতরটা বেশ গরম । জাহিদের মনে হল ও যেন ঠান্ডা দোযখ থেকে গরম বেহেশতে এসে পড়ল । গাড়ীর চালককে কিভাবে ধন্যবাদ দেবে বুঝতে পারছিল না জাহিদ । পেছন থেকে ও বলল-
” থ্যাংকিউ ভাই । জীবনটা বাঁচালেন ।”
চালক জবাব দিল না ।
একটু অস্বস্তিতে পড়ল জাহিদ । আবার বলল-
“রাস্তায় হঠাৎ সাইকেলের চাকা পাংচার হয়ে গেল আরকি হে হে।”
এবারো কোন জবাব নেই ।
জাহিদ বুঝতে পারছিল না এই লোক কথা বলে না কেন?
আবারো ও বলল
“এদিকে কার বাসায় যাবেন?”
এবারো কোন জবাব নেই।
এবার একটু মেজাজ খারাপ হল জাহিদের । ব্যাপার কি? যাই হোক ও চুপ করে গেল ।
কিছুক্ষণ পর ওর টনক নড়ল । কি ব্যাপার !! গাড়ী এত আস্তে আস্তে চলছে কেন ? সামনে ঝুকে জাহিদ ঐ লোককে ডেকে বলতে চাইল “ভাই গাড়ি এত আ-
মেরুদন্ড দিয়ে বয়ে যাওয়া শীতল স্রোত তার কথা মাঝপথেই থামিয়ে দিল । চালকের আসনে কেউ বসে নেই । সবার আগে যে সম্ভাবনাটা মাথায় এল তা আর ভাবতে চাইল না জাহিদ। গাড়ি থেকে নেমে যেতে চাইল ও । কিন্তু আতংকে ও নড়তে পারছিল না । সামনে রেল ক্রসিং । গাড়িটা খুব আস্তে আস্তে ঐ রেললাইনের উপর গিয়ে দাড়াল । হঠাৎ ট্রেনের হুইসেলের শব্দে জাহিদের মাথা পরিষ্কার হয়ে গেল । তাহলে ভুতটার তাহলে এই মতলব ! এখন ট্রেন এলে জাহিদ একদম চ্যাপ্টা হয়ে যাবে । তাড়াতাড়ি ও দরজার হাতল ধরে টান দিল । আবারো ভয়ে ও পাগল হয়ে গেল । বারবার হাতল ধরে টান দিলেও ওটা খুলছিল না । গাড়িটা আবারো নড়তে শুরু করছিল । ওদিকে ট্রেন কাছে চলে আসছিল । ভয়ে আর পরিশ্রমে হাঁপাতে হাঁপাতে যখন ও জীবনের আশা প্রায় ছেড়ে দিচ্ছিল তখনই ও খেয়াল করল দরজাটা তো লক করাও থাকতে পারে । তাড়াতাড়ি লকে হাত দিয়ে লকটা খুলে ও বাইরে ঝাঁপিয়ে পড়ল । মাটিতে গড়িয়ে ও কিছুটা দুরে সরে এলো । তখনই আবারো গাড়িটা চলতে শুরু করল । গাড়িটা রেললাইন পার হয়ে গেলেই ট্রেন চলে গেল । জাহিদ মাটিতে শুয়ে চোখে আতংক নিয়ে গাড়িটার দিকে তাকিয়ে ছিল । গাড়িটা আবারো ওর সামনে এসে দাঁড়াল ।

গাড়ির পেছন থেকে হঠাৎ এক যুবক বের হয়ে গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছিল । তার সারা গায়ে এই শীতের রাতেও ঘাম । জাহিদের একটু খটকা লাগল । ভুতেরাও ঘামে ?!! যুবক জাহিদকে দেখতে পেয়ে কাছে এসে বলল ”কী ব্যাপার, মাটিতে শুয়ে আছেন কেন ? আমার গাড়িটা যে রেললাইনের উপর হ্যাং হয়ে ছিল দেখেন নি ? ”
জাহিদ কোনরকমে ঘাড় নাড়ল ।
”আচ্ছা মানুষতো আপনি ! আরেকটু হলেই মারা যাচ্ছিলাম আর আপনি হেল্প করতে আসলেন না ? পাক্কা দুই কিলোমিটার ধরে গাড়িটাকে ঠেলছি !! আসুন আসুন , আমার সাথে ঠেলুন ।

জাহিদ বিনা বাক্য ব্যয়ে উঠে যুবকের সাথে গাড়ি ঠেলতে শুরু করল ।
READ MORE - প্রতিদিন বিকেল হলেই বাড়ী ফিরে আসে জাহিদ ।

মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনের এমএইচ১৪৪৬ ফ্লাইটটি লাংকাউই মাটি ছুঁলো ঠিক বিকেল চারটায়।

মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনের এমএইচ১৪৪৬ ফ্লাইটটি লাংকাউই মাটি ছুঁলো ঠিক বিকেল চারটায়। কুয়ালালামপুর থেকে এক ঘন্টার বিমান যাত্রায় পৌঁছে গেলাম লাংকাউই। প্লেন থেকে নেমেই গা ছম ছম করা অনুভূতি। অন্য বিমান বন্দরগুলো থেকে এই এয়ারপোর্ট যেন ঠিক একেবারেই আলাদা। এয়ারপোর্টের চারপাশে তাকিয়ে যে জৌলুস চোখে পড়ে তা নেই এখানে। অরণ্য, পর্বত আর সাগরের মাঝখানে অবলীলায় নেমে গেলাম আমরা প্রায় তিনশ’ ট্যুরিস্ট। আমি যদি দৃষ্টিপাতের লেখক যাযাবরের মতো বাংলা লিখতে পারতাম তবে লাংকাউই বিমান বন্দরটিকে উইলিংডন এয়ারপোর্টের সাথে তুলনা করতে পারতাম। কিন্তু আমার বাংলা লেখার গাঁথুনি অতো শক্ত নয়। তাই অমন করে বর্ণনা করা আমার পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। যাযাবর (বিনয় মুখোপাধ্যায়) তার দৃষ্টিপাতে লিখেছেন উইলিংডন এয়ারপোর্টটি বৃহৎ নয়। কিন্তু গুরুত্বে প্রধান, সংবাদপত্রে এর বহুল উল্লেখ। একথাটা লাংকাউই এয়ারপোর্টের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য। ছোট্ট একটা দ্বীপের সাদামাটা একটা এয়ারপোর্ট। কিন্তু লাংকাউইয়ের গুণগান সকলের মুখে মুখে। লাংকাউই শুধু এশিয়ার নয় পৃথিবীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্যুরিস্ট স্পট। এখানে কোন ইমিগ্রেশন নেই কারণ আমরা একই দেশে ভ্রমণ করছি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। ছোট্ট এয়ারপোর্টের মূল ভবনে এসে এবার ভালো করে আমাদের সহযাত্রীদের মুখগুলোর দিকে একবার তাকালাম। প্রায় সবার চেহারাই ইউরোপীয় ধাঁচের। হাতে গোনা কয়েকজন চায়নিজ। অর্থাৎ বুঝাই গেল আমরা সবাই ট্যুরিস্ট। নিছক ভ্রমণের অভিপ্রায়েই আমরা সবাই এখানে এসেছি। ভ্রমণ ছাড়া অন্য কোন কাজে মানুষ লাংকাউই আসবেই বা কেন? ডিপারচার অর্থাৎ নির্গমন গেটের দিকে চাইতেই দেখলাম একজন নারীর বিশাল পোট্রেট সামনের দেয়ালে। বুঝতে চেষ্টা করলাম এই রমণীটি কে। জাতীয় পর্যায়ে কোন বিখ্যাত নারী ছাড়া এখানে কোন পোট্রেট থাকার কথা নয়। ছবিটির সামনে এগিয়ে গেলাম আমি আর আমার মেয়ে অনি। অন্য ট্যুরিস্টরা যে যার মতো বেরিয়ে যাচ্ছে। আমাদের কোন তাড়া নেই। আর অজানাকে জানার জন্যই এই দ্বীপে এসেছি, যে দ্বীপটিকে তাবৎ চরাচর থেকে আলাদা বলেই অনুমান হয়। আমি আর অনি বেশ কিছুক্ষণ পোট্রেটটির নিচে এবং আশেপাশে মেয়েটির নাম অথবা পরিচিতি খোঁজার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোথাও তার পরিচয় লেখা নেই। লোকালয় থেকে তেপান্তরে এসে হঠাৎ কোন নারীকে চেনাও প্রায় অসাধ্য। ব্যাংকক শহরে যদি আপনি ট্যাক্সিতে এক চক্কর দেন তবে দেখবেন প্রতিটি হাইরাইজ ভবনে রাজা-রানীর যুগল কিংবা একক পোট্রেট লাগানো আছে। রাজকীয় ঢং-এর পোট্রেট। দেখলেই বুঝা যায় এটি রানী কিংবা রাজকুমারী। কিন্তু যে পোট্রেটটির সামনে আমরা দাঁড়ালাম তাকে অতি সাধারণ নারী বলে অনুমান হয়। একে রাজকুমারী ভাবার কোন অবকাশ নেই। ব্যর্থ হয়ে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে এলাম। কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারতাম মেয়েটির পরিচয়। কিন্তু শুরুতেই এতো অনুসন্ধিৎসা দৃষ্টিকটু বলে মনে হলো। যখন ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছি তখন সুদি বললো ঐ মেয়েটির আরো। বেশ ক’টি ছবি আছে আশেপাশে। অনি বললো, মেয়েটি নিশ্চয়ই এই দ্বীপের কোন নামকরা হিরোইন অথবা মডেল। তাই তার ছবি সব জায়গায় ডিসপ্লে করা হয়েছে। তবে আমার মনে খটকা লেগেই থাকলো। কারণ মেয়েটির বেশভূষা মোটেই মডেল কিংবা নায়িকাদের মতো নয়। তবে ইচ্ছা থাকলো পরে এই নারীর রহস্যটি উদঘাটন করতে হবে। ট্যাক্সিতে উঠলাম আমরা চারজন। হোটেল বুকিং করা আছে আগে থেকেই। আমরা যখনই বিদেশে ভ্রমণ করি, তখন সব সময়ই আমাদের ভ্রমণ সঙ্গী মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন। যেখানেই আমাদের ডেসটিনেশন হোক না কেন আমাদের যাওয়া আসা সব সময় কুয়ালালামপুর দিয়ে। মাত্র দুদিন আগেই আমরা কুয়ালালামপুর এসে পৌঁছেছি সিডনি থেকে। কেএল’এ এক রাত থেকে আজ এসেছি লাংকাউইতে। সিডনিতে ডাক্তারি কনফারেন্স থাকলেও লাংকাউইতে এসেছি নিছক ভ্রমণে। আমাদের মালয়েশিয়া ভ্রমণের ইটিনারারি ঠিক করে দিয়েছেন মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনের ঢাকা অফিসের বিপ্লব চক্রবর্তী। প্রতিবারই কম ভাড়ায় বিমান টিকেট এবং কম দামে ফাইভ স্টার হোটেলে থাকার ব্যবস্থা বিপ্লব দা’ই করেন। লাভ শুধু এটুকুই না, বিপ্লব দার বদন্যতায় ইকোনোমি ক্লাসের টিকিট কেটে আমরা বিজনেস ক্লাসেও ভ্রমণ করেছি দু একবার। বিজনেস ক্লাসে সিটখালি থাকলেই আমাদের টিকিটটা আপগ্রেডেড হয়ে যায় অবলীলায়। এতো সুযোগ দেয়ায় আমরাও অন্য এয়ারলাইনের দিকে ঝুঁকি না। এবারও ঠিক একইভাবে ভ্রমণে বের হয়েছি। লাংকাউই হোটেল বুকিং-এর ভাউচার আমাদের সাথে।

কোনদিন এতো নির্জন দ্বীপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। এদেশটা যদি মালয়েশিয়া না হতো তবে হয়তো ভয়ই লাগতো। কারণ মালয়েশিয়ার প্রায় সব ট্যুরিস্ট স্পটই আমাদের দেখা। এশিয়ান কিংবা ওয়েষ্টার্ন সব কিছুই আছে এ দেশটিতে। কিন্তু তার সাথে আছে নিèিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তাই সারা দুনিয়ার ট্যুরিস্টরা নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ায় মালয়েশিয়ার প্রত্যন্ত এলাকায়। কোন ট্যুরিস্ট স্পটে যদি নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর না হয় তবে সে দেশে কোন ট্যুরিস্ট যাবে না কখনো। সেই দিক থেকে মালয়েশিয়ার সাফল্য একশতে একশ। ট্যাক্সিতে উঠেই ড্রাইভারকে বললাম, হলিডে ভিলা বীচ রিসোর্টে যেতে কতোক্ষণ লাগবে। ড্রাইভার জানালো পৌনে এক ঘন্টার মধ্যে আমরা পৌঁছে যাবো হোটেলে। হোটেলের নামই বীচ রিসোর্ট। অর্থাৎ বুঝতেই পারলাম সমুদ্রের পাড় ঘেঁষেই হবে আমাদের লাংকাউইর নিবাস। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়েই বুঝলাম, এটি জনশূন্য একটি প্রত্যন্ত দ্বীপ, যাকে সমগ্র চরাচর থেকে বিচ্ছিন্ন বলেই বিভ্রম হয়। হয় পাহাড় না হয়তো সাগরের পাশ ঘেঁষে আমাদের গাড়ি শাঁ শাঁ করে এগিয়ে যাচ্ছে হলিডে-ইন ভিলার দিকে। আশপাশে সমুদ্র সৈকতের ছড়াছড়ি। গোয়া কিংবা আমেরিকার মাওয়ি দ্বীপের সাথে লাংকাউই’র মিল রয়েছে অনেকাংশে। দূর থেকে দেখে মনে হলো মাওয়ি’র বিশ্ববিখ্যাত পাপালুয়া, কাপালনি, কাহানা কিংবা কাপালুয়া বীচের চাইতে লাংকাউই’র সৈকতগুলো কোন অংশে কম সুন্দর নয়। প্রায় দেড় যুগ আগে মাওয়ি’র কাপালুয়া বীচের পাড়ে এক রিসোর্টে আমি থেকে এসেছি এক সপ্তাহ। পাহাড়ের ওপরের হোটেল কিংবা সৈকত লাগোয়া রিসোর্টে রাত্রি যাপনের অভিজ্ঞতা সবসময়ই রোমাঞ্চকর।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ছোট্ট একটা শহরের উপস্থিতি টের পেলাম। বলা যায় একদম বিরান ভূমি থেকে জনারণ্যে প্রবেশ করলাম। সমুদ্রের পাশ ঘেঁষে চলতেই হঠাৎ চোখে পড়লো একটি বিশাল রিসোর্ট। চোখ ফেরাতেই দেখলাম গেটে লেখা হলিডে ভিলা বীচ রিসোর্ট ও স্পা। বুঝতে পারলাম হোটেলে পৌঁছে গেছি। গাড়ি থেকে নেমেই বুঝলাম এ হোটেলের আদব-কায়দা ট্র্যাডিশনাল। অর্থাৎ অন্য পাঁচ তারকা হোটেলের সাথে এর কোন মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। বুঝা গেল, এ দ্বীপের ঐতিহ্যগত ভাবধারায় গড়ে তোলা হয়েছে এই রিসোর্টটিকে। হোটেল রিসেপশনে এসে আমাদের ভাউচারটি দিলাম। প্রত্যেক হোটেল কাউন্টারে যেয়ে আমি সচরাচর যে কথাটি সব সময় রিসেপশনিষ্টকে বলি সেই কথাটি এখানেও বললাম। অর্থাৎ আমি অভ্যর্থনাকারিনীকে অনুরোধ করলাম যাতে সে যতোটা সম্ভব উঁচু ফ্লোরে আমাদের রুমটির বরাদ্দ দেয়। কারণ কুড়ি তলা কিংবা পঁচিশ তলা হোটেলের জানালা দিয়ে রাতের অচেনা শহরগুলোকে স্বপ্নের মত লাগে। গতকাল রাতেই থেকে এসেছি কুয়ালালামপুরের জালান ইসমাইল রোডের রেনেসাঁ হোটেলের তেইশতম ফ্লোরের একটি ডিলাক্স রুমে। রেনেসাঁ হোটেলের জানালা দিয়ে চাইলে মনে হয় হয়তো হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে টুইন টাওয়ার। তারকা হোটেলের উঁচু তলায় থাকার ব্যাঞ্জনাই আলাদা। তাই লাংকাউই এসেও উঁচু ফ্লোরে থাকার বায়না ধরলাম রিসেপশনিষ্টের কাছে। আমাদের যাঞ্চা শুনে অভ্যর্থনাকারিনীকে একটু অবাক হতে দেখলাম। সহাস্যে পুতুলের মতো চায়নীজ মেয়েটি বললো, আমাদের হোটেলে তো হাইরাইজ ফ্লোর নেই। আমাদের হোটেলটিই তো মাত্র দোতলা। অর্থাৎ হাইরাইজ বলতে সেকেন্ড ফ্লোর। মনে মনে লজ্জা পেলাম এই ভেবে, যে হোটেলে এসেছি সেই হোটেল সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। যদি নিজে কখনো ইন্টারনেটে হোটেল বুক করি তবে তখন হোটেলের রুম সংখ্যা, হোটেলটি কতো তলা কিংবা ব্রেকফাস্ট ফ্রি কিনা এসব বিষয়-আশয়গুলো ভালো মতো দেখে নেই। কিন্তু এবারের ভ্রমণে তার ব্যত্যয় ঘটেছে। আমাদের হোটেল বুকিং, সাইট সিটিং সবকিছু ঠিক করে দিয়েছেন বিপ্লব দা মালয়েশিয়ান এয়ার লাইনের প্যাকেজের ভেতর। তাই হোটেল সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়ার দরকার হয়নি। মেয়েটি আমাকে হেসে জানালো, উঁচু তলাতে থাকতে পারবো না কিন্তু ঘর থেকে হাত বাড়ালেই সমুদ্রের জল ছুঁতে পারবো। হোটেলের লবিটি এমন ঢং-এ বানানো যে, সেখানে দাঁড়িয়ে কারু পক্ষেই বুঝা সম্ভব নয় হোটেলটি কতো বড় এবং এটি কতো তলা হোটেল। হলিডে ভিলার রুম খুলেই আমার বৌ চন্দনার মুখে চাঁদের হাসি। এমন দৃশ্য কোথায় গেলে আর দেখা যাবে? ঠিক যেন রুমের দোরগোড়ায় সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। লবিতে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের ফোঁপানি শোনা যায়নি। কিন্তু এখন তা স্পষ্ট। পানটাই তেনঘা সী বীচের ওপর চৌদ্দ একর জমির উপর গড়ে উঠেছে এই হোটেল। হোটেলটি গড়ে তোলা হয়েছে গ্রামের আদলে। লাংকাউই দ্বীপের পশ্চিম উপকূলে এটি একটি পশ রিসোর্ট। তিনশ আধুনিক রুমের এক বিশাল সমাহার এই রিসোর্টে। আমাদের রুমের ঠিক সামনেই বিশাল সুইমিংপুল, আর তার পাশ ঘিরে তিনটি লন টেনিস কোর্ট। জামা কাপড় পাল্টে বেরিয়ে গেলাম হোটেল পর্যবেক্ষণে। অনি-সুদি দুজনেই চাইছিল সুইমিংপুলে নামতে। কিন্তু চন্দনার আপত্তিতে তা হলো না। তখন চারদিকে আঁধার নামছে গুঁড়ি গুঁড়ি। সন্ধ্যায় সাঁতরালে যদি ঠান্ডা লাগে, সেই ভয়ে কাউকেই সুইমিংপুলে যেতে দেয়া হলো না। লবিতে নেমে হোটেলের চারপাশ ভাল মতো পর্যবেক্ষণ করলাম বেশ কিছুক্ষণ। বুঝতে পারলাম লাংকাউই শহর থেকে এই রিসোর্টটি প্রায় বিচ্ছিন্ন। আশপাশে কোন লোকালয় চোখে পড়লো না। হোটেলের সামনে জঙ্গলের ভেতর দু’ একটা ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট আছে ট্যুরিস্টদের জন্য। সাহেবরা অনেক সময়ই ফাইভ ষ্টার হোটেলে বসে খেতে পছন্দ করে না। তাই রুচি পাল্টাতে আসে এসব ঘুপচি ঘরে। সুইমিংপুলের পাশ ঘেঁষে চলে এলাম সী বীচে। সী বীচে তখনও অতি উৎসাহী সাহেব মেমরা স্নানে ব্যস্ত। সী বীচের চারপাশে তখন বীয়ার আর স্যাম্পেনের ফোয়ারা। হোটেলের ট্রপিক্যাল বীচ বার তখন পরিপূর্ণ। এ দৃশ্য দেখলে কে বলবে মালয়েশিয়া মুসলিম অধ্যুষিত একটি দেশ। আপনার মনে হবে এটি হাওয়াই দ্বীপের ওয়াইকিকি বীচ। সন্ধ্যা গড়ালো। অনি তাড়া দিচ্ছিল ডিনারের জন্য। কোথায় ডিনার খাবো তা নিয়ে বিভ্রান্তি। সুদি বললো চলো ট্যাক্সি ভাড়া করে শহরের ভেতর যাই। চন্দনা সায় দিলো না। এ হোটেল থেকে মূল শহরের দূরত্ব কতোটুকু, তা আমাদের ধাতে নেই। বিদেশ বিভূই। কাউকে এখানে জানি না – চিনিও না। তাই রাতে আর বেরুলাম না। ডিনার করবো এ হোটেলেই। কোথায় ডিনার সারবো। তাতেও দ্বিধাদ্বন্দ্ব। লাগেন্ডা রেস্টুরেন্ট, মারিও ইতালিয়ান রেস্টুরেন্ট, সানসেট টেরেসে তখন মহাধূমধামে ডিনার চলছে। ইতালিয়ান খাবার আমাদের পছন্দ নয়। খোদ রোমে যেয়েও আমরা পিজা-পাস্তা খেতে চাইনি। অনির মহাপছন্দ পিজা। ও আমাদের জোর করেই ইতালিয়ান রেস্টুরেন্টের দিকে নিয়ে যেতে চাইলো। আমরা সায় দিলাম না। বিদেশে গেলেই আমরা বাফেট ডিনার কিংবা লাঞ্চ খুঁজি। কারণ এতে খাবার সিলেকশনের স্বাধীনতা থাকে। হোটেলের একজন কর্মীকে জিজ্ঞেস করলাম এই হোটেলে কিংবা আশপাশে বুফে ডিনারের ব্যবস্থা আছে কিনা? সে বললো মিড নাইট পর্যন্ত লাগেন্ডা রেস্টুরেন্টে বারবিকিউ ডিনার চলবে। বারবিকিউ ডিনার মানে আগুনে ঝলসানো মাংস কিংবা মাছের ডিনার। ঢুকে গেলাম লাগেন্ডাতে। খাসী, গরু, সামুদ্রিক মাছ কিংবা গলদা চিংড়ির বারবিকিউ। তবে ওটি পারফেক্ট বারবিকিউ ডিনার ছিল না। ঝলসানো খাবারের সাথে ছিল শতেক রকমের এশিয়ান, আমেরিকান কিংবা জাপানী খাবার দাবার। মাথাপিছু মাত্র বিশ ডলারে অমন ডিনার ইউরোপ আমেরিকাতে কেন সিঙ্গাপুরেও চিন্তা করা যায় না। বড় বড় গলদা চিংড়ি, কুককে বলা সাথে সাথে হয়ে যায় ফ্রাই। যতো খুশী খাও। কেউ বাধা দিবে না। যতো খুশী খাও আর যতোক্ষণ খুশী ততোক্ষণ খাও এদুটোই বুফে ডিনারের বাড়তি চার্ম। খেতে খেতে হঠাৎ করেই অনি বললো বাবা দ্যাখো, ঐ মেয়েটির ছবি এই হোটেলেও আছে। চেয়ে দেখি সত্যিই তাই। এই একই নারীর পোট্রেট আমরা এয়ারপোর্টে ও বিভিন্ন জায়গায় দেখে এসেছি। কিন্তু কোথাও এই নারীর পরিচয় লেখা নেই। এখানেও নেই। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়েই দেখলাম শুধু এক জায়গায় নয় বিভিন্ন জায়গায় এই রমণীর পোট্রেট শোভা পাচ্ছে। অনুসন্ধিৎসাটা আর চেপে রাখতে পারলাম না। রিসেপশনিষ্ট মেয়েটির কাছে এসে ঐ নারীর পোট্রেটটির দিকে ইঙ্গিত করে জানতে চাইলাম তার পরিচয়। চাইনীজ মেয়েটি আমার প্রশ্নটি শুনে বোধহয় বেশ অবাকই হলো। এমনিতেই ফকফকা সুন্দরী মংগল মেমদের মুখ দেখতে অনেকটা পুতুলের মতো। আর এখন আমার প্রশ্ন শুনে ঐ মেমটির মুখ যেন পুরোপুরি বার্বিডল হয়ে গেল। চোখে কোন নড়ন-চড়ন নেই। একদৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকলো আমার মুখের দিকে। বুঝতে পারলাম তৈলচিত্রের ঐ নারী মূর্তিটি সম্পর্কে না জেনে এই দ্বীপে আসা আমার উচিত হয়নি। বাকিংহাম প্যালেসের সামনে দাঁড়িয়ে কোন পর্যটক যদি রাণীমাতার পোট্রেটের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে কোন বৃটিশ মেমের কাছে জানতে চায় ঐ ছবিটি কার তবে ঐ মেম সাহেবের মুখের আদল বিস্ময়ে যেমন বদলে যাবে ঠিক তেমনি অবস্থা তখন চাইনীজ মেয়েটির। সে সোজা সাপটা আমার প্রশ্নের কোন উত্তর দিল না। ড্রয়ার থেকে একটা বই বের করে তা আমার হাতে ধরিয়ে দিল। শুধু আলতো করে বললো লাংকাউই দ্বীপ মানেই ঐ নারী। বাকীটা বই থেকে পড়ে নিতে। বইটা হাতে নিলাম। ডিসকভারি সিরিজের বই। প্রচ্ছদে লেখা লাংকাউই – আইল্যান্ড অব লিজেন্ড। অর্থাৎ অলৌকিক কাহিনীর দ্বীপ লাংকাউই। চন্দনা, সুদি আর অনির চোখে তখন অনেক ঘুম। গত দুদিনে টায়ারিং জার্নি করেছি আমরা চারজন। মেলবোর্ণ থেকে সিডনি, সিডনি থেকে কুয়ালালামপুর তারপর এক রাত না পেরুতেই লাংকাউই। ওরা চলে গেল ঘরে। আমার তখনও ঘুম বা ক্লান্তি আসেনি। নতুন কোন কিছু জানার থাকলে আমার চোখে কখনো ঘুম আসে না।

একা একা চলে গেলাম সী সাইড বারে। তখনো জোড়ায় জোড়ায় বিদেশীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে সমুদ্রের পাড়ে। সাগরের পাড় ঘেঁষে ওপেন স্টেইজ বানানো ডিনার ডান্সের জন্য। প্রতি শনিবার সারারাত এখানে কনসার্ট হয় আর তার সাথে ডিনার আর ডিসকো। হোটেলের পেছনে এক জায়গায় একটা সাইনবোর্ড দেখলাম। তাতে লেখা আছে খবঃ ঁং সধহলধ ুড়ঁ. মাঞ্জা কথাটা বাংলা না ইংরেজি তা বুঝতে পারলাম না। ছোটবেলায় যারা ঘুড়ি উড়িয়ে অভ্যস্ত তারা সবাই মাঞ্জা কথাটার সাথে পরিচিত। সুতাকে ধারালো করার জন্য বার্লি আর কাঁচের গুঁড়া দিয়ে ঘুড়ি ওড়ানোর সূতাতে মাঞ্জা দেয়া হয়। বার কয় চোখ কচলে ভাল করে তাকিয়ে দেখি ঐ সাইনবোর্ডটির পাশেই গুপ্তঘরের মতো একটি দরজা। নীল আলোর দরজা, স্পষ্টতই বুঝা গেল এটা হোটেলের মাসাজ পার্লার। চীনা, মালয়ি, ইতালি ও বাহারি মেয়ের সমাবেশ আছে এখানে। লেখা আছে মাসাজ করার ফি আশি রিংগিত। কিন্তু আমি জানি আশি রিংগিতই শেষ কথা নয়। মাসাজ রুমে একবার কোন পর্যটককে ঢুকাতে পারলেই কম্ম ফতে। একেক কাজের জন্য একেক রকমের চার্জ। মালয়েশিয়ান মেয়েরা এ কাজে মহা পটু। কি করে সাহেবদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আহোরণ করতে হয় তা তারা জানে। শুধু জানে বললে ভুল হবে, খুব ভালো জানে। পেনাং শহরের মাসাজ পার্লারগুলো একবার ঘুরে দেখলেই বুঝা যাবে এরা সিঙ্গাপুর তো কোন ছাড়, কোন কোন ক্ষেত্রে থাইল্যান্ডের পাটায়া পুখেতকেও হার মানিয়ে দিবে। মাসাজ পার্লারের কাণ্ড কাহিনী সবই আমি জানি। তবে মানুষকেও যে মাঞ্জা দেয়া যায় তা আজ রাতেই প্রথম জানলাম।

রাতে ব্যালকনিতে বসে আগামীকালের ভ্রমণসূচি নির্ধারণ করি। হলিডে ভিলার এই রিসোর্টের একটা বিশেষ দিক হলো সমুদ্রের দিকের প্রতিটি রুমের সাথে আছে লাগোয়া সুপরিসর ব্যালকনি। কোন ফাইভ ষ্টার হোটেলে সাধারণত এমন দেখা যায় না। একবার আমরা ছিলাম জাকার্তার শারি প্যানপ্যাসিফিক হোটেলে। ঐ হোটেলেও ছিল রুম লাগোয়া ব্যালকনি। রাতে যখন জাকার্তা ঘুমায় তখন ব্যালকনিতে বসে নিশি রাতের শহর দেখা যায়। সুউচ্চ হোটেলের ব্যালকনিতে বসে রাতের আঁধারে চা কফি খেলে পরিবেশকে অনেকটা ভুতুড়ে মনে হয়। মনে হয় যেন চিলেকোঠায় বসে আছি। তবে হলিডে ভিলাকে চিলেকোঠা ভাবার কোন উপায় নেই কারণ এই হোটেলটিই মাত্র দোতলা। রাত বাড়ে আর সমুদ্রের গর্জন বাড়ে। হোটেল সংলগ্ন সমুদ্রের সৈকতটি রাতেও আলোতে উজ্জ্বল। বোঝা যায় সিকিউরিটির কারণে এতো আলোক বিন্যাস। অতি উৎসাহী পর্যটকরাও এতোক্ষণে সৈকত ছেড়ে নিজ নিজ ঘরে চলে গেছে। তাই সমুদ্র পাড় এখন একেবারেই সুনশান। রাতে ঘরে শুয়েও অন্তর দিয়ে অনুভব করতে থাকি সমুদ্রের হাসি কান্না মেশানো গর্জন। সমুদ্র স্রোতের আওয়াজ এতো কাছে অনুমান হয় যে মাঝে মাঝে মনে হয় এই বুঝি সাগরের নোনাজল উপচে পড়বে আমাদের ঘরে। পুখেতের বিখ্যাত সমুদ্র সৈকত পাতং বীচে আমরা একবার চার পাঁচ দিন কাটিয়ে এসেছি আন্দামান সী ভিউ হোটেলে। সেখানেও ঘরের পাশেই ছিল সমুদ্র। এখানেও তাই। আজো আমার মনে আছে পুখেত থেকে ঢাকা ফিরে আসার দু সপ্তাহের মধ্যে পৃথিবীর ভয়াবহ সুনামীতে পুখেত লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল। পাতং বীচের পাড়ে গড়ে ওঠা প্রায় দু ডজন ডিলাক্স হোটেল সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এদের মধ্যে একটি ছিল আন্দামান সী ভিউ হোটেল। আজ রাতে আমরা যেমন লাংকাউই সাগরের পাড়ে বিছানায় শুয়ে আছি নিশ্চয়ই ঐদিন রাতে আন্দামান সী ভিউতেও কারুর পরিবার নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে ছিল ঐ ঘরটিতে। কে জানতো ঐদিন রাতের আঁধারে তাদের সবার দেহ মহাকালের জন্য মিশে যাবে সমুদ্রের নোনাজলে। সাগর পাড়ে পর্যটন করার ভয়াবহতা মনে করতে করতেই এক সময় ঘুম আসে দু চোখ জুড়ে।

সকালে লাগেন্ডা রেষ্টুরেন্টে বাফেট ব্রেকফাষ্ট। বলা যায় রাজকীয় নাস্তা। এক নাস্তাতেই শত পদের খাবার। ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর কিংবা মালয়েশিয়ার যেকোন শহরে যারা প্যাকেজ ট্যুরে ভ্রমণ করে অভ্যস্ত তারা সবাই জানে এসব হোটেলের সকালের খাবার কতোটা জাঁকালো। সকাল দশটার দিকে ব্রেকফাষ্ট করলে দুপুরের লাঞ্চটা বেমালুম চেপে যাওয়া যায়। আর কেউ যদি সত্যি সত্যি ভোজন রসিক হয় তবে পেট চুক্তি ব্রেকফাষ্ট খেয়ে লাঞ্চ-ডিনার স্কিপ করে একেবারে আগামীকাল ব্রেকফাষ্ট টেবিলেও আসতে পারেন। আমার স্ত্রী-কন্যার আবার বুফে ব্রেকফাষ্টে কমপক্ষে এক ঘন্টা কাটানোর অভ্যাস। আজো তাই হলো, সকাল আটটা থেকে ন’টা পর্যন্ত কাটলো লাগেন্ডা রেষ্টুরেন্টে। সকাল ন’টায় বের হয়ে এসেই দেখি মে ফ্লাওয়ার ট্র্যাভেল এজেন্সির মংক্রোবাস আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। মালয়েশিয়ান এয়ার লাইনের সাথে আমাদের ট্যুরের চুক্তিতেই এই ট্যুর অন্তর্ভুক্ত। শুধু আমরা না, আরো একটি সাহেব-মেমদের ফ্যামিলি আমাদের সাথে যোগ হলো। তারা এসেছে ইতালী থেকে লাংকাউই দেখতে। আমাদের ড্রাইভার ইংরেজিতে ফ্লুয়েন্ট। সাধারণত প্রতিটি ট্যুরিস্ট স্পটেই দেখেছি ড্রাইভাররা ইংরেজি বুঝতে ও বলতে পারে। শুধু এর ব্যত্যয় দেখা যায় থাইল্যান্ডে। থাইরা কখনো ভাল ইংরেজি বুঝে না। এমনকি ষ্টার রেটেড হোটেলেও এ অবস্থা। ড্রাইভার প্রথমেই জানতে চাইলো আমরা প্রথমে কোথায় যেতে ইচ্ছুক। আমার কোন কিছু বলতে হলো না। ইতালীয় মেমটি আমাদের দিকে ভ্রƒক্ষেপ না করেই বলে দিল তারা সর্বপ্রথমে কুটা মাশুরি দেখতে আগ্রহী। আমাদেরও তাই ইচ্ছা। দুই ফ্যামিলির ইচ্ছা হুবহু এক। তাই গাড়ী চললো কুটা মাশুরির দিকে। এই প্রথম দিনের আলোতে লাংকাউই দ্বীপকে ভালভাবে দেখতে চেষ্টা করলাম।

মোট তেরটি রাজ্য নিয়ে মালয়েশিয়া। এর মধ্যে এগারোটি মালয়ি পেনিনশ্যুলাতে আর বাকী দুটি বোরনিও দ্বীপে। বোরনিও পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম দ্বীপ। লাংকাউই মালয়েশিয়ার কেডা রাজ্যে অবস্থিত, যা একেবারেই সমুদ্রের ভেতরে। বাসে ট্রেনে করে এই দ্বীপে আসা যাবে না। আসতে হবে আকাশে উড়ে আর নাহলে জলে ভেসে। কেডা রাজ্যকে বলা হয় জরপব নড়ষি ড়ভ গধষধুংরধ. খাদ্য শস্য উৎপন্ন করতে এই দ্বীপ মালয়েশিয়ায় এক নম্বরে। ছোট ছোট ৯৯টি আরকিপিল্যাগো বা দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে লাংকাউই। আন্দামান সাগরের পাড়ে থাইল্যান্ডের পাশ ঘিরে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর একটি স্বপ্নিল পর্যটন কেন্দ্র। সমগ্র দ্বীপটির আয়তন ৫২৮ বর্গ কিলোমিটার। লাংকাউই দ্বীপের জনসংখ্যা ষাট হাজার। এ দ্বীপের রাজধানীর নাম কূয়া। সমগ্র লাংকাউই একটি ডিউটি ফ্রি দ্বীপ। খধহমশধরি কথাটা এসেছে দুটি শব্দ সংযুক্ত হয়ে। খধহম কথার অর্থ হলো হেলাং। এটি একটি মালয়ি শব্দ যা ঈগল পাখীকে বোঝায়। আর কধরি একটি সংস্কৃত শব্দ যার অর্থ মার্বেল। এক সময় এই দ্বীপ ছিল ঈগল পাখীদের অভয়ারণ্য। আর এখানে পাওয়া যায় বিবিধ ধরনের মার্বেল। তাই ঈগল আর মার্বেল দুটি কথার সংযুক্তি ঘটিয়ে এ দ্বীপের নামকরণ করা হয়েছে খধহমশধরি। আমাদের মাইক্রোবাসটি চলছে সাগরের পাড় ঘেঁষে আর পাহাড় ডিঙ্গিয়ে। পাহাড় আর সাগরের মহামিলন এই দ্বীপে। বিস্তীর্ণ এলাকা কিন্তু কোথাও কোন জনবসতি দেখা যায় না। রাস্তায় হেঁটে যাওয়া মানুষের সংখ্যা নাই বললেই চলে। রাস্তায় বের হয়েই আমার মনে হলো এই দ্বীপের মানুষগুলো গেল কোথায়? চারপাশ এতো ভূতুড়ে আর জনমুনিষ্যি শূন্য কেন? হঠাৎ করেই আমার ছেলে সুদি বললো বাবা ঐ দ্যাখ শহর। ডান দিকে তাকাতেই দেখি সত্যিই তাই। হঠাৎ করেই যেন নির্জন সাগরে ভেসে ওঠা আইসবার্গের মতো একটা ছোট্ট শহর দৃশ্যমান হলো। গাড়ী চলছে শহরের দিকে। গাড়ীতে উঠেই একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম আমরা। কুটা মাশুরি যে লাংকাউই’র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান তা রাস্তায় বেরুলেই বুঝা যায়। কয়েকশ গজ পর পরই ছোট ছোট সাইনবোর্ডে তীর চিহ্ন দিয়ে দেখিয়ে দেয়া আছে মাশুরির মিউজিয়াম কোন্ দিকে। লাংকাউইতে পর্যটনের স্থান অগুনতি কিন্তু তাদের মধ্যে কুটা মাশুরি অনন্য। ঠিক এমন অবস্থা দেখেছি ল্যুভর মিউজিয়ামে। প্যারিসের এই মিউজিয়ামে তিশিয়ান, রেমব্রান্ট, পোশিয়ান, রাফায়েল, বাউচার, ক্যারভ্যাগিনো কিংবা মাইকেলাঞ্জেলোসহ অনেক জগৎ বিখ্যাত শিল্পীদের ছবি শিল্পকর্ম ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিন্তু পর্যটকদের তো সব শিল্পকর্মের প্রতি তেমন কোন আকর্ষণ নেই। সবাই যেতে চায় মোনালিসার কাছে। তাই ল্যুভর কর্তৃপক্ষ এই বিশাল মিউজিয়ামের গেট থেকে মূল গ্যালারি পর্যন্ত ছোট ছোট সাইনবোর্ডে অ্যারো চিহ্ন এঁকে বুঝিয়ে দিয়েছে লিওনার্দো ভিঞ্চির মোনালিসা কোন্ দিকে। ল্যুভরে দেখেছি মানুষের ঢল মোনালিসার গ্যালারির দিকে। ঠিক একই অবস্থা লাংকাউইতে। এই দ্বীপের সব প্রধান প্রধান জায়গায় লেখা আছে কুটা মাশুরি কোন পথে যেতে হবে। এর কিছুক্ষণ পরেই আমরা পৌঁছে গেলাম কূয়া শহরে। ছোটখাটো একটা ছিমছাম শহর। তবে আভিজাত্যে সিঙ্গাপুর কিংবা ব্যাংককের সাথে তুলনীয়। এমন একটি নির্জন দ্বীপে হঠাৎ করে একটা আধুনিক শহর পাওয়া যাবে তা ভেবে অবাক হতে হয়। আমাদেরকে নামিয়ে দেয়া হলো শহরে। বলা হলো এক ঘন্টা সময় দেয়া হলো শহর দেখার জন্য। তারপর গাড়ী ছাড়বে মাশুরির মিউজিয়ামের দিকে। কূয়া শহর থেকে কুটা মাশুরির দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। এক ঘন্টা অনেক সময়। পায়ে হেঁটে চললাম, শহর পরিভ্রমণে। এই শহরটির নাম কূয়া কেন তার পেছনে একটা ছোটখাটো ইতিহাস আছে। মালয়ি ভাষায় কূয়া কথার ইংরেজি অর্থ হলো এৎধাু অর্থাৎ রস কিংবা মাংসের ঝোল। কথিত আছে এক সময় এই দ্বীপের রাজার সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করার জন্য দুই বিশালদেহী পুরুষের মধ্যে মল্ল যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় এই স্থানটিতে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে বিশাল ভান্ডে রাখা মাংসের ঝোলের পাত্রটি ভেঙ্গে যায়। সুরা বা ঝোল সবটুকু ছড়িয়ে পড়ে মাটিতে। এই ঝোল থেকেই এই জায়গাটির নাম হয়ে যায় কূয়া অর্থাৎ ঝোল। বেশ কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে অন্য দশটা শহর থেকে কূয়াকে পার্থক্য করা যায় না। একটা গতানুগতিক আধুনিক শহরে যা যা থাকা দরকার, তার সব কিছুই আছে কূয়া শহরে। কিন্তু এরই মধ্যে চেয়ে দেখি চন্দনা, সুদি আর অনি আমার চারপাশে নেই। ওরা হারিয়ে গেছে সে কথা আমি বিলক্ষণ চিন্তাও করলাম না। আশপাশে চেয়ে দেখার চেষ্টা করি কোথাও কোন বড় মার্কেট কিংবা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর আছে কিনা। ক’কদম এগুতেই চোখে পড়লো বিরাট মার্কেট। সামনে সাইনবোর্ড। তাতে লেখা বিলিয়ন সুপার মল। আমি নিশ্চিত বুঝতে পারলাম ওরা এখানেই আছে। একটু এগুতেই অনির কথার আওয়াজ পেলাম। ও আমাকে ডেকে বলছে- বাবা আমরা এখানে। মার্কেটের নাম বিলিয়ান মার্কেট। এই মার্কেটটা কি সাধারণ মানুষের জন্য না শুধু বিলিয়নারীদের জন্য তা বোধগম্য হলো না। কিছুক্ষণ পর চন্দনা মার্কেট থেকে বেরিয়ে আমাকে বললো এই মার্কেটে জিনিসপত্রের দাম অনেক কম তাই সে সন্ধ্যায় এখানে আসতে চায়। আমাদের প্যাকেজ ট্যুর বিকেল চারটা পর্যন্ত। তাই ট্যাক্সি ভাড়া করে সন্ধ্যায় এখানে আসা খুবই সহজ। রাজী হলাম আবার সন্ধ্যায় কূয়া শহরে আসতে। সাড়ে দশটার দিকে রওয়ানা হলাম কুটা মাশুরির দিকে।

কড়ঃধ গধযংঁৎর কথা যার অর্থ হলো মাশুরির শহর। কড়ঃধ কথার অর্থ হলো ঞড়হি। মাশুরি নামের এক নারীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এই শহর। লাংকাউই দ্বীপের উলু মেলাকা এলাকায় গড়ে উঠেছে কুটা মাশুরি কালচারাল সেন্টার। একে অনেকে মিউজিয়ামও বলে। মিউজিয়ামের গেটে আমাদের গাড়ী থামলো। নেমেই দেখি শত শত পর্যটক লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভেতরে ঢোকার টিকিট কেনার জন্য। জনপ্রতি এন্ট্রি ফি দশ রিংগিত। আমাদের সাথে যারা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে তারা সবাই বিদেশী। এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ডজন ডজন এয়ারকন বাস আর মাইক্রোবাস। সবাই এখানে বিদেশী।

কুটা মাশুরিতে ঢুকেই প্রথম চোখে পড়লো একটি সমাধি। বুঝতে পারলাম এটি মাশুরির সমাধি। মাশুরির পুরো নাম মাশুরি বিনতে পানডাক মায়া। তখনও আমি বুঝতে পারছিলাম না এই নারী এই দ্বীপে কেন এতো বিখ্যাত। কেন সবাই আসে এই নারীর সমাধিতে? এর উত্তর পেতে দেরী হলো না। না জেনে শুনে এখানে সেখানে ঘোরাফেরা করার চাইতে জেনে শুনে দেখা ভাল। তাই ঢুকে গেলাম মাশুরির মিউজিয়ামে। কারণ হোটেলের বুকলেটে মাশুরির ছবি আছে অনেক কিন্তু ইতিহাস আছে অতি সামান্য। মিউজিয়ামের গেটে প্রতিদিন সকাল ন’টা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত মালয়ি কিশোর-কিশোরীরা নাচ গান করে। মিউজিয়ামে ঢুকেই বুঝতে পারলাম মাশুরি নামের এই নারী কেন লাংকাউইতে অদ্বিতীয়।

মাশুরি মিউজিয়ামটি মাশুরির ব্যক্তিগত কথকথা আর পারিবারিক জীবন নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে। মূল গ্যালারিটির প্রতিটি জায়গায় স্থান পেয়েছে ঐ অনিন্দ সুন্দরী নারীর পোর্টেট। ১৮১৫ সালের দিকে মাশুরি বিনতে পানডাক মায়া নামের এক যুবতীর রূপের কথা এই দ্বীপে সর্বত্র আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব আসতে থাকে চারদিক থেকে। সে সময় লাংকাউই এর গোষ্ঠী প্রধান ছিল দাতু পাকেরান জায়া। তার ছোট ভাই ওয়ান ডারুসের সাথে মাশুরির বিয়ে ঠিক হয়। মাশুরির বিয়েতে তার বাবা পানডাক মায়া এবং মা কিট অ্যালাং যারপরনাই খুশী হয়। সামান্য কৃষকের মেয়ে হয়ে যায় রাজবধূ। কিন্তু মাশুরির জীবন সুখের হয়নি। স্বামী তাকে ভালবাসলেও সে রাজ পরিবারের অন্যদের কাছ থেকে এতোটুকু ভালবাসা পায়নি। সবচেয়ে আশ্চর্য হলো রাজার ছোট ভাই এর সাথে বিয়েতে প্রাথমিকভাবে মাশুরি নিজে রাজীই হতে চায়নি। মাশুরি চেয়েছিল সাধারণ যুবকের বৌ হয়ে ছিমছাম সাধারণ জীবন বেছে নিতে। কিন্তু দ্বীপের সবচেয়ে সুন্দরী নারীর বিয়ে হবে অন্য পুরুষের সাথে তা লাংকাউই-এর গোষ্ঠী প্রধানরা মেনে নেয়নি। প্রায় জোর করেই মাশুরিকে ওয়ান ডারুসের সাথে বিয়ের পিঁড়িতে বসানো হয়। স্বামী ভাগ্য মাশুরির ভালো ছিল। কিন্তু ওয়ান ডারুসের বড় ভাই রাজা পাকেরান জায়ার স্ত্রী মোহরা একেবারেই মাশুরিকে সহ্য করতে পারছিল না। মোহরা নানাভাবে তার বান্ধবীদের দিয়ে মাশুরিকে হেনস্তা করতে থাকে। এক সময় মোহরা মাশুরির রূপে আর গুণে অসহ্য হয়ে তাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করে। ১৮১৯ সালের প্রথম দিকে মাশুরির স্বামী বিদেশে যায় কয়েক সপ্তাহের জন্য। আর ঐ সুযোগেই মোহরা তার পরিকল্পনাটি চরিতার্থ করে। একদিন বিকেলে মাশুরির এক দু:সম্পর্কের আত্মীয় যুবক বাটু বাহারা থেকে মাশুরির সাথে দেখা করতে আসে। যুবকটির নাম ছিল ডেরামবাং। বিকেলে মাশুরি আর ডেরামবাং বসে আলাপ করছিল। তারপর দিন মোহরা চারদিকে রটিয়ে দেয় মাশুরি চরিত্রহীন। সে ঐ ভিনদেশী যুবকের সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। মোহরা তার তিন বান্ধবীকে সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করলো। তারা বললো মাশুরিকে নাকি তারা ঘরের ভেতর সহবাসরত দেখেছে। মাশুরির জীবনে নেমে এলো ঘোর অমানিশা। স্বামী রাজ্যে নেই কিন্তু বিচার হয়ে গেল একতরফা। স্ত্রীর প্ররোচনায় রাজা পাকেরান জায়া তড়িঘড়ি করে মাশুরির বিচার করে ফেলে। বিচারে মাশুরির প্রাণদণ্ড হয়। একই সাথে কথিত প্রেমিক ডেরামবাং-এরও প্রাণদণ্ড হয়। প্রতারণা আর বিশ্বাসঘাতকতার জন্য নিষ্পাপ মাশুরি মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। রাজা ছোট ভাই ওয়ান ডারুসের জন্য অপেক্ষা করলো না। তাড়াতাড়ি ভাই ফিরে আসার আগেই মাশুরির প্রাণ সংহার করতে সে সব আয়োজন পূর্ণ করে। মৃত্যুদণ্ডের দিন একটি গাছের সাথে মাশুরিকে বেঁধে ফেলা হয়। তারপর প্রকাশ্য দিবালোকে কীরিচ দিয়ে মাশুরির শরীরে আঘাত করা হয়। রাজ জল্লাদ আরিয়া বার বার বিভিন্ন অস্ত্র দিয়ে মাশুরিকে আঘাত করতে থাকে কিন্তু কোন অস্ত্রই মাশুরির শরীরে বিঁধছিল না। রাজ্যের সব ভয়ংকর অস্ত্র দিয়ে পর পর পাঁচ দিন চেষ্টা করেও মাশুরির প্রাণদণ্ড কার্যকর করতে ব্যর্থ হয় রাজা। রাজা আর মোহরা লজ্জায় ডুবে যায়। চারদিকে যখন প্রচণ্ড রোদ তখন মাশুরিকে যে স্থানে বেঁধে রাখা হয়েছে তার ওপরে পাখিরা তাদের পাখা দিয়ে সামিয়ানা তৈরি করে রাখতো যাতে মাশুরির শরীরে একটুও রোদের আঁচ না লাগে। এতোসব অলৌকিক কাণ্ড-কারখানা দেখে রাজ্যের অধিবাসীদের মনে ধারণা জন্মে যে, মাশুরি হয়তো কোন ষড়যন্ত্রের শিকার। তখন রাজ্যের সব কৃষকরা তাদের যাবতীয় সোনাদানা আর শস্য রাজাকে দিয়ে পরিবর্তে মাশুরির প্রাণ ভিক্ষা করে। রাজা সামান্য নরম হলেও তার স্ত্রী মোহরাকে পেয়ে বসে খুনের নেশায়। যে করেই হোক মাশুরিকে হত্যা করতেই হবে। সে তখন জল্লাদ আরিয়াকে মাশুরির কাছে পাঠায় কেন তাকে হত্যা করা যাচ্ছে না রহস্য জানতে। লজ্জায় মাশুরি আর এ জীবন রাখতে চায়নি। সে তখন আরিয়াকে বলে তাদের পারিবারিক কীরিচ দিয়ে আঘাত করলেই তার মৃত্যু ঘটবে। এর পরদিন মাশুরির পারিবারিক কীরিচ দিয়ে মাশুরিকে আঘাত করা হলো। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে মাশুরি লাংকাউই দ্বীপকে অভিশাপ দিয়ে যায়। সে বার বার উচ্চারণ করতে থাকে সে যদি নিষ্পাপ হয় তবে সাত জনম এই দ্বীপে কোন শস্য দানা মাটিতে ফলবে না। এই দ্বীপ হয়ে যাবে বিরাণ ভূমি। কথিত আছে মাশুরির বুকে আঘাত করার পর তার বুক থেকে লাল রক্তের পরিবর্তে সাদা রক্ত গল গল করে বেরুতে থাকে। আর ঐ সাদা রক্ত মাটিতে না পড়ে আকাশের দিকে ধাবিত হয়ে মেঘের সাথে মিশে যায়। মাশুরির মৃত্যু হওয়ার সাথে সাথে বনে বনে আগুন লেগে যায়। পাকা শস্য ক্ষেতের ফসল জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যায়। মাত্র এক বছরের মধ্যে লাংকাউই মরুভূমির মতো নিষ্ফলা হয়ে ওঠে। মাশুরির অভিশাপে এই দ্বীপ হয়ে ওঠে অভিশপ্ত রাজ্য। ক্ষুধার তাড়ণায় এ দ্বীপের মানুষ মূলত থাইল্যান্ডের দিকে চলে যায়। রাজ্য ফেলে রাজারা হয় দেশান্তরী। মাশুরির বাবা-মা মেয়ে হারানোর লজ্জায় আর ক্ষোভে থাইল্যান্ডের পুখেতে আশ্রয় নেয়। একমাত্র পুত্র ওয়ান হাকিমকে নিয়ে মাশুরির স্বামী ওয়ান ডারুস থাইল্যান্ডে নির্বাসিত জীবন যাপন করে। মাশুরির অভিশাপের সাত জনম পার হয় হয় ১৯৮০ সালে। লাংকাউই এর মানুষরা আশায় ছিল কখন মাশুরি পরিবারে সাত জেনারেশন পার হয়। কারণ শুধু তাহলেই মাশুরির অভিশাপের মেয়াদ পার হবে। দুর্ভিক্ষ আর ক্ষুধার রাজ্য আনন্দে নেচে ওঠে ১৯৮০ সালে। ঐ বছর ওয়ান ডারুস আর মাশুরির পরিবারে জন্মগ্রহণ করে এক নবজাতক নারী, যার নাম আসিয়া নোয়াই। জন্মের পর পরই মালয়েশিয়ানরা আসিয়াকে থাইল্যান্ড থেকে লাংকাউই নিয়ে আসে। কথিত আছে আসিয়া লাংকাউই এর মাটিতে পা রাখার সাথে সাথে রাতারাতি বদলে যায় এই দ্বীপের আদল। মাত্র পঁচিশ বছরে এই দ্বীপ আজ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত। উৎকৃষ্ট মানের ধান উৎপন্ন করার জন্য লাংকাউই আজ মালয়েশিয়ার গর্ব। পরিমাণে বেশি নয় কিন্তু মানে এখানকার ধান চমৎকার। মাশুরিকে লাংকাউই-এর অধিবাসীরা দেবতা জ্ঞানে শ্রদ্ধা করে। তাকে বলা হয় সততা আর পবিত্রতার প্রতীক। প্রায় এক ঘন্টা আমরা মিউজিয়ামে এদিক সেদিক ঘুরে দেখলাম। শত বছরের পুরনো ফটো আর পোর্ট্রেট ভরা গ্যালারি। আর তার সাথে আছে অডিও আর ভিডিও বর্ণিত ইতিহাস। মাশুরি আর তার পরিবারের বংশানুক্রম সাজানো আছে পোস্টারে। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য হলো এই মিউজিয়ামে মাশুরির ওপর লেখা ইংরেজিতে কোন বই নেই। ইচ্ছে ছিল ক্যামেরা দিয়ে পোস্টারগুলোর ছবি করে নেয়া। কিন্তু সেখানেও বিপত্তি। মিউজিয়ামের ভেতর ক্যামেরা নিয়ে প্রবেশে কড়াকড়ি। ক্যামেরায় ক্লিক করলেই হুজ্জতি। তাই অগত্যা ডায়রিতে যতোটা পারলাম লিখে নিলাম। আমার মেয়ে এসব বিষয়ে পারঙ্গম। আমি একটা আর অনি অন্যটা এভাবে মাশুরি সম্বন্ধীয় বেশকিছু ইতিহাস আমরা দুজন টুকে নিলাম। মিউজিয়ামের এক জায়গায় লেখা আছে এই সমাধিস্থলে মাশুরিকে হত্যা করা হয়নি। মাশুরির প্রাণদণ্ড কার্যকর করা হয় তামান কীরিচ নামক স্থানে। মাশুরির সমাধিস্থল থেকে তামান কীরিচের দূরত্ব পঁচিশ কিলোমিটারের মতো, জায়গাটা এয়ারপোর্ট সংলগ্ন। সেখানেও মাশুরির একটি স্মৃতিসৌধ আছে। ইতিহাস পড়ে জানলাম যে কীরিচটি দিয়ে মাশুরিকে হত্যা করা হয় সেটি রক্ষিত আছে তামান কীরিচ এলাকায়। এবং এই কীরিচের নামানুসারেই জায়গাটির নাম হয়ে গেছে তামান কীরিচ। এবার মিউজিয়াম দেখে বের হলাম মাশুরির স্মৃতি বিজড়িত জায়গাটি ঘুরেফিরে দেখতে। মাশুরি স্মৃতিসৌধের কাছে দাঁড়িয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হলো। যখন প্রথম এই সমাধির কাছে এসেছিলাম তখন আমার এমন অনুভূতি ছিল না। ভেবেছিলাম কোন রাজকন্যার সমাধিক্ষেত্র এটি। কিন্তু এটি যে এক নির্যাতিতা রাজবধূর সমাধি তা এইমাত্র জানলাম। চারপার্শ্বে অনেক বিদেশী। সবারই আকর্ষণ মাশুরির সমাধি। একপাশে তৈরি করা আছে স্থায়ী মঞ্চ। সেই মঞ্চে কোন কোন বিশেষ দিনে মাশুরির জীবন নিয়ে থিয়েটার হয়। একজন মালয়েশিয়ান নায়িকা আছে যার মুখের আদল অনেকটা মাশুরি বিনতে পানডাকের মতো। সাধারণত ঐ নায়িকাকে দিয়েই মাশুরির রোল করানো হয়। এই নারীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে কুটা মাশুরি বা মাশুরির টাউন নামে একটি ছোট্ট শহর। প্রতিবছর গড়ে কুড়ি লক্ষ পর্যটক এই সমাধিস্থলে আসে। ধারণা করা হয় মাশুরির পরিবার এই এলাকাতেই বাস করতো। মাশুরির মৃত্যুর পর রাজ পরিবারটি সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। রাজবাড়ীর অবশিষ্ট আর কিছু এখানে নেই। শুধু আছে মাশুরির ঘরের রিপ্লিকা। সমাধিস্থল থেকে মাত্র একশ গজ দূরে আছে টেলেগা মাশুরি। অর্থাৎ মাশুরির কুয়া। কথিত আছে ঐ কুপের জল মাশুরি নিজে ব্যবহার করতো। এই কুয়ার জল হোলি ওয়াটার হিসেবে বিবেচিত। তাই এক বোতল জল কিনতে দিতে হয় দশ রিংগিত। এসব কাণ্ড-কারখানা দেখে আমি ভাবি কি করে পর্যটকদের পকেট খালি করতে হয় সে বিদ্যায় মালয়িরা সিঙ্গাপুরিয়ান কিংবা থাইদেরও ছাড়িয়ে গেছে। এই এলাকার লোক আর্ট কালচারে বেশ উন্নত। পোর্ট্রেট আঁকিয়েরা সারি সারি বসে আছে। পঁচিশ রিংগিত দিলে আধ ঘন্টার মধ্যে তৈরি করে দিবে পেন্সিল স্কেচের পোর্ট্রেট। প্রতিদিন সকাল নটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত চলে এসব বিচিত্র কাজ কারবার।

দুপুর তখন দেড়টা। এবার যাচ্ছি সমুদ্র সৈকতে। কিন্তু আমার মাথা থেকে তামান কীরিচের ব্যাপারটা যাচ্ছে না। সী বীচ তো জীবনে অনেক দেখেছি। কিন্তু এমন ইতিহাস তো কোনদিন শুনিনি। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম আমাদের ফেরার রাস্তায় তামান কীরিচ পড়বে কিনা। কিন্তু সে হতাশ হওয়ার মতো উত্তর দিল। সে বললো তামান কীরিচ কুটা মাশুরি শহরের ঠিক উল্টো পাশে। যেতে হলে অন্য দিন যেতে হবে। গাড়ীতে উঠার আগে মাশুরির সমাধি সম্পর্কিত আর একটি তথ্য জেনে নিলাম। ১৯৪০ সালের আগে মাশুরির কবরটি বাঁধানো ছিল না। ঐ বছর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী টেংকু আব্দুর রহমান পুত্রা আলহাজ্ আনুষ্ঠানিকভাবে মাশুরির সমাধি স্থল স্থাপনার উদ্বোধন করেন। মালয়েশিয়ানরা মাশুরি লিজেন্ডটি পুরোপুরি বিশ্বাস করে। তারা বিশ্বাস করে ১৯৮০ সালে অভিশাপমুক্তির পর থেকে রাতারাতি লাংকাউই বিখ্যাত হয়ে গেছে। ছোট্ট একটা দ্বীপ যেখানে বাস কিংবা ট্রেনে যাওয়া যায় না, সাগর থেকে চাইলে মনে হয় সাগরের মধ্যে ভেসে আছে এক খন্ড সবুজ ভূমি। আর সেই ছোট্ট দ্বীপ শহর লাংকাউইতে আছে ৭৫টি স্টার রেটেড হোটেল। চিন্তা করা যায় কতোটা আকর্ষণীয় এই শহরটি।

এবারের গন্তব্য সী বীচ। সমুদ্র সৈকত সব পর্যটকদের জন্যই আকর্ষণীয়। কিন্তু ক’ বছর আগেই আমরা ভারতের গোয়া আর আমেরিকার হাওয়াই দ্বীপের সী বীচগুলো দেখে এসেছি। যারা গোয়া বীচ কিংবা ওয়াইকিকি সী বীচ দেখে এসেছে তাদের কাছে পৃথিবীর অন্য কোন সৈকত তেমন ভাল লাগার কথা নয়। তবুও গাইডরা বললো লাংকাউই এর সমুদ্র সৈকতগুলো নাকি অন্য ধরনের। এ দ্বীপের একেকটি সৈকতের বৈশিষ্ট্য নাকি আলাদা ধরনের। লাংকাউইতে দেখার আছে অনেক কিছু। জলপ্রপাত, বিখ্যাত সেভেন ওয়েল, বুটিক ভিলেজ, ওরিয়েন্টাল ভিলেজ, লাংকাউই ক্যাবেল কার, আন্ডার ওয়াটার ওয়ার্ল্ড, কুমীরের ফার্ম, রাজকীয় প্রমোদতরীতে নৌবিহার- সব আছে এই ক্ষুদ্র দ্বীপটিতে। কিন্তু এখানে পর্যটকরা আসে মূলত এখানকার পৌরাণিক কাহিনীগুলোর স্পর্শ পেতে। তাই লাংকাউইকে বলা হয় ওংষধহফ ড়ভ ষবমবহফং . অলৌকিক কাহিনীর দ্বীপ। এ দ্বীপের প্রহেলিকাময় অতীত পর্যটকদের কাছে টানে। কুটা মাশুরির উত্তরে আরেক লৌকিক কাহিনীর স্থান গড়ে উঠেছে। এর নাম লেক অব প্র্যাগনেন্ট মেইডান অর্থাৎ কুমারী মাতার বিল। কথিত আছে শত শত বছর আগে এক পরীর পছন্দ হয়েছিল পার্থিব পুরুষকে। কুমারী পরীর গর্ভে জন্ম নেয় আধা হুর আর আধা মানুষ এক সন্তান। কিন্তু জন্মের কিছুক্ষণ পরই শিশুটি মারা যায়। পরী দেশের রাজকন্যা ব্যথিত হয়ে মৃত সন্তানকে এই বিলের জলে ভাসিয়ে দেয়। মর্ত ত্যাগ করার আগে ঐ রাজকন্যা পরী বলে যায় যে, বন্ধ্যা নারীরা এই লেকের জলে স্নান করলে তারা গর্ভধারণ করতে সক্ষম হবে। আজো এই রীতি লাংকাউই তে চলে আসছে। প্রতিদিন ডজন ডজন বন্ধ্যা নারী এখানে স্নান করতে আসে সন্তান কামনায়। এ সব দেখে আধা ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম প্রথম সমুদ্র সৈকতে। একেবারেই গ্রামের ভেতর দিয়ে ঢুকে গেলাম সৈকতে। যে রাস্তায় এলাম তার চারপাশে রাবার ট্রি ফার্ম। রাবার শিল্প লাংকাউই-এর প্রধান ব্যবসা। দ্বীপ জুড়েই মানুষের সংখ্যা বড়ো কম। পায়ে হেঁটে চলা মানুষ রাস্তায় খুবই কম। ড্রাইভার কাম গাইড আমাকে বললো এখানকার সব বাড়িতেই অন্তত: একটি মোটর সাইকেল আছে। কোন কোন পরিবারে চার পাঁচটি মোটর বাইকও আছে। বাচ্চারা স্কুলে যায় বাই সাইকেলে। নিরাপদ রাস্তা-ঘাট। গাড়ী ঘোড়ার সংখ্যা নিতান্তই কম। দ্বীপময় ঘুরে বেড়ায় শুধু পর্যটকদের বহর। সৈকতের পাশেই ছোট্ট বাজার। বলা যায় একটা শুঁটকি মাছের বাজার। এতো বড় শুঁটকি মাছের আড়ত কিন্তু তেমন কোন উৎকট গন্ধ নেই। আস্ত সামুদ্রিক মাছের শুঁটকি থেকে শুরু করে কাচকি মাছের শুঁটকি সব পাওয়া যায়। লাংকাউই এর শুঁটকি ব্যবসা জমজমাট। রাস্তাঘাটে শুঁটকির ভ্যান গাড়ী ঘুরে বেড়ায়। দাম কম বলে আমার বৌ চন্দনা এক সাথে কম করে হলেও আট দশ কেজি কাচকি মাছের শুটকি কিনে ফেললো। দাম এতো আকর্ষণীয় যে, শুধু আমার বৌ কেন যে কোনদিন শুঁটকি খায়নি সেও যদি এমন কম দামে এতো ভাল শুঁটকি পায় তবে তারও কিনে নিয়ে কাউকে গিফট দিতে ইচ্ছে করবে। চলে এলাম সৈকতে। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকি সৈকতের রং-এর দিকে। পুরো সৈকতটি কালো রং-এর। বালির রং কালো। পাথরও কালো। তাই সৈকতের নাম ব্ল্যাক স্যান্ড বীচ। মালয়ি ভাষায় এই বীচকে বলা হয় পাসির হিটাম বীচ। কেন এই বীচের রং কালো তা নিয়েও লিজেন্ড আছে। এখানে লেখা আছে বহুকাল আগে জলদেবীর কাছে এখানকার জেলেরা একটা ওয়াদা করেছিল। কিন্তু বার বার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও তারা ঐ ওয়াদা পূরণ করেনি। তাই ক্ষুব্ধ জলদেবীর অভিশাপে জেলেদের সব ঘরবাড়ী পুড়ে যায় এবং সৈকতের বালিতে লেগে যায় আগুন। তাই আজও এই সৈকতের রং কালো। তবে ভূ-তাত্ত্বিকরা বলেন এই সৈকতের বালিতে টারমুলিন, ইলমেনাইট ও জিরকনের পরিমাণ বেশি। এই তিনটি যৌগ একত্র হওয়ার জন্য এখানকার সৈকতের রং কালো। এরপর আরো তিনটি সৈকত দেখে আবার হোটেল পানে যাত্রা। আজকের মতো এখানেই শেষ।

হোটেলে ফিরলাম বিকেল সাড়ে তিনটায়। আমাদের হোটেলের উল্টো দিকের ওয়ারং রেস্টুরেন্ট থেকে লাঞ্চ সারলাম। দুপুরে ঘুমালেই সময় অপচয়। বিদেশে এলে কম সময়ে যতো বেশি দেখা যায় ততই ভাল। চন্দনা সকালে কূয়া শহরে দেখে এসেছে আকর্ষণীয় বিলিয়ন মার্কেট। সে সেখানে যাওয়ার জন্য উদ্গ্রীব। তাকে উস্কে দিচ্ছে সুদি আর অনি। এখানে ট্যাক্সি পাওয়া দুষ্কর। হোটেল লবিতে বলা মাত্র কোত্থেকে এক ক্যাব এসে হাজির হলো মুহূর্তে। ছুটলাম বিলিয়ন মার্কেটের দিকে। পাহাড় আর সাগরের সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে পৌঁছে গেলাম কূয়া শহরে। বিলিয়ন মার্কেটে ঢুকেই বুঝতে পারলাম বিলিয়নিয়ার না হলেও বিলিয়ান মার্কেট থেকে কেনাকাটা করা যাবে। চন্দনা চা, কফি থেকে শুরু করে কসমেটিক সবকিছু কিনলো এখান থেকে। পুরো লাংকাউই ডিউটি ফ্রি জোন। তাই দাম আকর্ষণীয়।

মার্কেটিং করে আর শহর ঘুরে রাত ন’টায় ফিরছি হোটেলের দিকে। চারদিক মহাশূন্যের মতো সুনশান। সাগরের পাশ দিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে রাস্তা। কোথাও কোথাও ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি পাহাড়। শহর থেকে হলিডে ভিলা রিসোর্ট এক ঘন্টার পথ। রাস্তায় তেমন কোন গাড়ীঘোড়াও নেই, আলোও নেই। এই নির্জন পথে আমরা চারজন। সাথে অপরিচিত ড্রাইভার। বিরাণ রাস্তা দিয়ে ফেরার সময় আমার মনে হয়েছিল এই ড্রাইভার যদি ইচ্ছা করে যে সে এই নির্জন প্রান্তরে আমাদেরকে খুন করে লাশ সমুদ্রে কিংবা পাহাড়ের গুহায় লুকিয়ে রাখবে তবে তা খুব কঠিন কাজ হবে না। বন্দুকের গুলির শব্দও কোন মানুষের কর্ণকুহরে প্রবেশ করবে না। অথবা সে আমাদেরকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে পারে যেখান থেকে আমাদের সর্বস্ব লুট করে আমাদের লাশ গুম করে ফেলা হবে অতি সহজ। আমার পকেট আর চন্দনার ভ্যানিটি ব্যাগ মিলিয়ে কম করে হলেও তিন হাজার ডলার। ভয়ে গা ছম ছম করা অস্বাভাবিক নয়। আমি আমাদের দেশের অবস্থাটা চিন্তা করতে থাকি। কোন দেশে ট্যুরিজম সেন্টার গড়ে তোলার পূর্ব শর্ত হলো নিèিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তা না হলে কেউ আসবে না সে জায়গায়। এশিয়ার বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র থাইল্যান্ডের পাটায়াতে বিদেশী যুবক শোভরাজ খুন করেছিল এক বিদেশিনীকে। তাই পাটায়ার ব্যবসা ক’ বছরের জন্য লাটে উঠেছিল। টাইট সিকিউরিটি ছাড়া যতো ভাল দৃশ্যই থাক না কেন কোন দেশ পর্যটন ব্যবসায় ভাল করতে পারবে না। ক’ বছর আগে এক জাপানীজ যুবক এসেছিল ঢাকায় হলিডে করতে। ভোর ছ’টায় কাওরানবাজার এলাকায় জগিং করতে যেয়ে পেটে ছুরিকাঘাত এবং মানিব্যাগ লুট। এমন দেশে কখনও পর্যটক আসে? রাত দশটার দিকে নির্বিঘেœ পৌঁছে গেলাম হলিডে ভিলাতে। নিশ্চয়ই এখন ডিনার খাওয়ার সময়। কেউ আর বাফেট ডিনার খেতে পছন্দ করলো না। ফেরার পথে তুলসী নামে একটি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট চোখে পড়েছে। দূর খুব বেশি নয়। হেঁটে গেলে বড়জোর পনের মিনিট। নির্জন রাস্তায় হেঁটে চলে এলাম তুলসী হোটেলে। এসেই দেখা হলো হোটেল বয় কালামের সাথে।

মাত্র ক’দিন আগে সে পেনাং থেকে লাংকাউই এসেছে। শহর হিসেবে পেনাং এর সাথে লাংকাউই-এর কোন তুলনাই চলে না। পেনাং মালয়েশিয়ার টিপটপ শহর। আর লাংকাউই নির্জন দ্বীপ। এখানে বড়জোর সাত দিন একনাগাড়ে থাকা যায়। এরচেয়ে বেশি নয়। তাই জানতে ইচ্ছা করলো কেন সে পেনাং থেকে এখানে চলে এলো। সে বললো তার কাছে কোন বৈধ কাগজপত্র নেই। ভিসার মেয়াদ শেষ। পেনাং-এ অবৈধভাবে থাকা বিপজ্জনক। তাই চলে এসেছে সে এই নির্জন দ্বীপে ভাগ্যান্বেষণে। সকাল আটটা থেকে রাত একটা পর্যন্ত ডিউটি। বেতন ৮০০ রিংগিত অর্থাৎ ষোল হাজার টাকা। এক লক্ষ ষাট হাজার টাকা খরচ করে সে মালয়েশিয়া এসেছে টাকা রোজগার করতে। এতো কষ্ট করে মাসে রোজগার ষোল হাজার টাকা। বিয়ের এগার দিন পর বৌকে একা ফেলে কালাম এসেছে মালয়েশিয়া। গত দেড় বছরে বৌ’র সাথে যোগাযোগ শুধু কালেভদ্রে টেলিফোনে। রাত তখন বারোটা। হঠাৎ শুরু হলো বজ্রপাতসহ বৃষ্টি। রেস্টুরেন্ট থেকে ট্যাক্সি ক্যাব ডেকে দিল। স্বাভাবিক ভাড়া পাঁচ রিংগিত। আমাদের দেশ হলে ড্রাইভার যেতেই চাইতো না। অথবা সে এমন ঢং করতো যেন সে এই ঝমঝম বৃষ্টিতে আমাদেরকে লিফট দিয়ে কৃতার্থ করেছে। তারপর ভাড়া হাঁকতো তিনচার গুণ। কারণ তখন যা চাইবে আমরা তা দিতে বাধ্য। হোটেলে এসে ড্রাইভারের কাছে ভাড়া জানতে চাইলাম। সে মিটার দেখিয়ে পাঁচ রিংগিতই চাইলো। এক রিংগিতও বেশি দাবী করলো না। মনে মনে ভাবি এরা জাতে মালয়ি কিন্তু আদব কায়দায় ইউরোপীয়। মালয়েশিয়ার উন্নতি ঠেকায় কে? একটা জাতি যদি সৎ ও কর্মঠ হয় তবে তাদের উন্নতি আটকে রাখা যায় না। ডা: মাহাথির মোহাম্মদ তা প্রমাণ করে দিয়েছেন।

তিন দিন লাংকাউই ভ্রমণ করে আজ চলে যাচ্ছি কুয়ালালামপুর। আমাদের ফ্লাইট বিকেল চার টায়। কিন্তু আমার মাথা থেকে মাশুরির লিজেন্ড এখনও দূর হয়নি। যে কীরিচ দিয়ে মাশুরিকে হত্যা করা হয়েছে তা রক্ষিত আছে তামান কীরিচ নামক জায়গায়। জেনে নিয়েছি জায়গাটি এয়ারপোর্ট সংলগ্ন। তাই প্ল্যান করে রেখেছিলাম ফেরার সময় দেখে যাব ঐ মনুমেন্টটি। হোটেল থেকে চেক আউট করলাম দুপুর বারোটার দিকে। তারপর চললাম তামান কীরিচ।

এক সময় রাস্তায় তামান কীরিচ নামের অ্যারো সাইন দেখতে পেলাম। বুঝা গেল পৌঁছে গেছি গন্তব্যে। তামান কীরিচ একেবারেই জনশূন্য এলাকা। শুধু মাশুরির স্মৃতিসৌধ ছাড়া আশপাশে আর তেমন কিছু নেই। যে গাছের সাথে বেঁধে মাশুরিকে হত্যা করা হয়েছিল তার গোড়াটি বাঁধাই করা আছে। কীরিচের আদলে গড়ে তোলা হয়েছে মনুমেন্ট। আমাদের ড্রাইভারটি বললো মূল কীরিচটি এই মনুমেন্টের ভেতর প্রোথিত করে রাখা হয়েছে। আমরা চারজন ঘুরেফিরে বেশ কিছুক্ষণ মাশুরির প্রাণদণ্ড কার্যকরের স্থানটি দেখলাম। সুদি আর অনি মাশুরির স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য বেশ কিছু ছবি তুলে নিলো। দুইশত বছরের পুরনো হলেও মাশুরির জন্য দুঃখ হলো। যে সময় মাশুরিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় তখন সে ছিল দ্বিতীয় বারের মতো গর্ভবতী। নিজের জন্য নয় অনাগত সন্তানের জন্য প্রসব পর্যন্ত প্রাণদণ্ড স্থগিত রাখার অনুরোধ করেছিল মাশুরি। কিন্তু অন্য নারী মোহরা তাতে কর্ণপাত করেনি। গর্ভবতী নারীর প্রাণদণ্ড কার্যকর করা হয় এখানে নির্মমভাবে। মাশুরির মৃত্যুর পর পরই পুরো লাংকাউই এর শস্যক্ষেতে আগুন লেগে যায়। সেই পুড়ে যাওয়া ধান এখনো মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে। মাশুরিকে হত্যার বছরেই রাজাও তার স্ত্রী মোহরা লাংকাউই থেকে বিতাড়িত হয়। ঐ বছরই সিয়ামিজ (থাই) রা লাংকাউই দখল করে নেয়। ১৯৮০ সালে মাশুরি বংশের সপ্তম জেনারেশনের নবজাতক আছিয়া নোয়াই লাংকাউই-এর মাটিতে পদার্পণ করে এ ভূমিকে অভিশাপমুক্ত করে আবার থাইল্যান্ডে চলে যায়। কারণ তারা আর লাংকাউইতে স্থায়ীভাবে থাকতে চায়নি। কিন্তু ২০০১ সালে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের অনুরোধে মাশুরির পরিবারের সদস্যরা স্থায়ীভাবে লাংকাউইতে ফিরে আসে। ২০০১ সালের মার্চ মাসে প্রধানমন্ত্রী দ্বীপব্যাপী অনুষ্ঠান করে নিজে মাশুরির পরিবারকে বরণ করে নেন। এরপর থেকে লাংকাউইকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

মাশুরি বিনতে পানডাক মায়ার কাহিনীটি মালয়িরা পুরোপুরি বিশ্বাস করে। তাদের কাছে মাশুরি কোন ভোজবাজি, অলীক কিংবা কাল্পনিক আখ্যান নয়, এটি বাস্তব সত্য কাহিনী।

মাশুরির জন্য দু’ ফোঁটা চোখের জল ফেলে চলে এলাম এয়ারপোর্ট। ফিরে যাচ্ছি কুয়ালালামপুর। তিন দিন এই লৌকিক উপাখ্যানের দেশে থেকে যা হৃদয় দিয়ে অনুভব করে গেলাম তা লাংকাউই না গেলে অন্যকে বুঝানো যাবে না। আমার এই ভ্রমণ কাহিনী পড়ে কেউ যদি লাংকাউই-এর রূপ-গন্ধ-বর্ণ-স্বাদকে অন্বেষণ করতে চান তবে তা হবে প্রায় অসম্ভব। লাংকাউই না যেয়ে তাকে অনুভব করার বিষয়টি হবে কমলালেবুর পরিবর্তে ভিটামিন-সি খাওয়ার মতো স্বাদহীন।
READ MORE - মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনের এমএইচ১৪৪৬ ফ্লাইটটি লাংকাউই মাটি ছুঁলো ঠিক বিকেল চারটায়।

প্রতি বছর শীতের ছুটির সময় ভাবি কিছুদিন গ্রামে কাটিয়ে আসব।


প্রতি বছর শীতের ছুটির সময় ভাবি কিছুদিন গ্রামে কাটিয়ে আসব। দলবল নিয়ে যাব- হৈচৈ করা যাবে। আমার বাচ্চারা কখনও গ্রাম দেখেনি- তারা খুশি হবে। পুকুরে ঝাঁপাঝাঁপি করতে পারবে। শাপলা ফুল শুধু যে মতিঝিলের সামনেই ফোটে না, অন্যান্য জায়গাতেও ফোটে তাও স্বচক্ষে দেখবে।
আমার বেশির ভাগ পরিকল্পনাই শেষ পর্যন্ত কাজে লাগাতে পারি না। এটা কেমন করে জানি লেগে গেল। একদিন সত্যি সত্যি রওনা হলাম।
আমাদের গ্রামটাকে অজ পাড়াগাঁ বললেও সম্মান দেখানো হয়। যোগাযোগ-ব্যবস্থার এমন সুন্দর সময়েও সেখানে পৌঁছাতে হয় গরুর গাড়িতে। বর্ষার সময় নৌকা, তবে মাঝখানে একটা হাওর পড়ে বলে সেই যাত্রা অগস্ত্যযাত্রার মতো।
অনেকদিন পর গ্রামে গিয়ে ভালো লাগল। দেখলাম আমার বাচ্চাদের আনন্দবর্ধনের সব ব্যবস্থাই নেওয়া হয়েছে। কোত্থেকে যেন একটা হাড়জিরজিরে বেতো ঘোড়া জোগাড় করা হয়েছে। এই ঘোড়া নড়াচড়া করে না, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। খুব বেশি বিরক্ত হলে দীর্ঘনিশ্বাসের মতো একটা শব্দ করে এবং লেজটা নাড়ে। বাচ্চারা এতবড় একটা জীবন্ত খেলনা পেয়ে মহাখুশি। দু-তিনজন একসঙ্গে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসে থাকে।
তাদের অসংখ্য বন্ধু-বান্ধবও জুটে গেল। যেখানেই যায় তাদের সঙ্গে গোটা পঞ্চাশেক ছেলেপুলে থাকে। আমার বাচ্চারা যা করে তাতেই তারা চমৎকৃত হয়। আমার বাচ্চারা তাদের বিপুল জনপ্রিয়তায় অভিভূত। তারা তাদের যাবতীয় প্রতিভা দেখাতে শুরু করল-কেউ কবিতা বলছে, কেউ গান, কেউ ছড়া।
আমি একগাদা বই সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার পরিকল্পনা- পুরোপুরি বিশ্রাম নেওয়া। শুয়ে বসে বই পড়া, খুব বেশি ইচ্ছা করলে খাতা-কলম নিয়ে বসা। একটা উপন্যাস অর্ধেকের মতো লিখেছিলাম, বাকিটা কিছুতেই লিখতে ইচ্ছা করছিল না। পান্ডুলিপি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। নতুন পরিবেশে যদি লিখতে ইচ্ছা করে।
প্রথম কিছুদিন বই বা লেখা কোনোটাই নিয়ে বসা গেল না। সারাক্ষণই লোকজন আসছে। তারা অত্যন্ত গম্ভীর গলায় নানান জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনায় উৎসাহী। এসেই বলবে- ‘দেশের অবস্থাডা কী কন দেহি ছোডমিয়া। বড়ই চিন্তাযুক্ত আছি। দেশের হইলডা কী? কী দেশ ছিল আর কী হইল?’
দিন চার-পাঁচেকের পর সবাই বুঝে গেল দেশ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। গল্পগুজবও তেমন করতে পারি না। তারা আমাকে রেহাই দিল। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। গ্রামের নতুন পরিবেশের কারণেই হোক বা অন্য কোনও কারণেই হোক আমি লেখালেখির প্রবল আগ্রহ বোধ করলাম। অসমাপ্ত পান্ডুলিপি নিয়ে বসলাম। সারাদিন লেখালেখি কাটাকুটি করি, সন্ধ্যায় স্ত্রীকে সঙ্গে করে বেড়াতে বের হই। চমৎকার লাগে। প্রায় রাতেই একজন দুজন করে ‘গাতক’ আসে। এরা জ্যোৎস্নাভেজা উঠোনে বসে চমৎকার গান ধরে-
“ও মনা
এই কথাটা না জানলে প্রাণে বাঁচতাম না।
না না না-আমি প্রাণে বাঁচতাম না।”
সময়টা বড় চমৎকার কাটতে লাগল। লেখার ব্যাপারে আগ্রহ বাড়তেই লাগল। সারাদিনই লিখি।
এক দুপুরের কথা- একমনে লিখছি। জানালার ওপাশে খুট করে শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখি খালিগায়ে রোগামতো দশ-এগারো বছরের একটা ছেলে গভীর আগ্রহে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে আগেও দেখেছি। জানালার ওপাশ থেকে গভীর কৌতূহলে সে আমাকে দেখে। চোখে চোখ পড়লেই পালিয়ে যায়। আজ পালাল না।
আমি বললাম- কী রে?
সে মাথাটা চট করে নামিয়ে ফেলল।
আমি বললাম- চলে গেলি নাকি?
ও আড়াল থেকে বলল- না।
‘নাম কী রে তোর?’
‘মন্তাজ মিয়া।’
‘আয় ভেতরে আয়।’
‘না।’

আর কোনও কথাবার্তা হল না। আমি লেখায় ডুবে গেলাম। ঘুঘুডাকা শ্রান্ত দুপুরে লেখালেখির আনন্দই অন্যরকম। মন্তাজ মিয়ার কথা ভুলে গেলাম।
পরদিন আবার এই ব্যাপার। জানালার ওপাশে মন্তাজ মিয়া। বড় বড় কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম- কী ব্যাপার মন্তাজ মিয়া? আয় ভেতরে।
সে ভেতরে ঢুকল।
আমি বললাম, থাকিস কোথায়?
উত্তরে পোকা-খাওয়া দাঁত বের করে হাসল।
‘স্কুলে যাস না?’
আবার হাসি। আমি খাতা থেকে একটা সাদা কাগজ ছিঁড়ে তার হাতে দিলাম। সে তার এই বিরল সৌভাগ্যে অভিভূত হয়ে গেল। কী করবে বুঝতে পারছে না। কাগজটার গন্ধ শুঁকল। গালের উপর খানিকক্ষণ চেপে রেখে উল্কার বেগে বেরিয়ে গেল।
রাতে খেতে খেতে আমার ছোট চাচা বললেন- মন্তাজ হারামজাদা তোমার কাছে নাকি আসে? আসলে একটা চড় দিয়ে বিদায় করবে।
‘কেন?’
‘বিরাট চোর। যা-ই দেখে তুলে নিয়ে যায়। ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দিবে না। দুই দিন পরপর মার খায় তাতেও হুঁশ হয় না। তোমার এখানে এসে করে কী?’
‘কিছু করে না।’
‘চুরির সন্ধানে আছে। কে জানে এর মধ্যে হয়তো তোমার কলম-টলম নিয়ে নিয়েছে।’
‘না, কিছু নেয়নি।’
‘ভালো করে খুঁজে-টুজে দ্যাখো। কিছুই বলা যায় না। ঐ ছেলের ঘটনা আছে।’
‘কী ঘটনা?’
‘আছে অনেক ঘটনা। বলব একসময়।
পরদিন সকালে যথারীতি লেখালিখি শুরু করেছি। হৈচৈ শুনে বের হয়ে এলাম। অবাক হয়ে দেখি মন্তাজ মিয়াকে তিন-চারজন চ্যাংদোলা করে নিয়ে এসেছে। ছেলেটা ফোঁপাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে প্রচন্ড মার খেয়েছে। ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়ছে। একদিকের গাল ফুলে আছে।
আমি বললাম, কী ব্যাপার?
শাস্তিদাতাদের একজন বলল, দেখেন তো এই কলমটা আপনের কি না। মন্তাজ হারামজাদার হাতে ছিল।
দেখলাম কলমটা আমারই, চার-পাঁচ টাকা দামের বলপয়েন্ট। এমন কোনও মহার্ঘ বস্তু নয়। আমার কাছে চাইলেই দিয়ে দিতাম। চুরি করার প্রয়োজন ছিল না। মনটা একটু খারাপই হল। বাচ্চা বয়সে ছেলেটা এমন চুরি শিখল কেন? বড় হয়ে এ করবে কী?
‘ভাইসাব, কলমটা আপনার?’
‘হ্যাঁ। তবে আমি এটা ওকে দিয়ে দিয়েছি। ছেড়ে দিন। বাচ্চা ছেলে এত মারধর করেছেন কেন? মারধর করার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করে নেবেন না?’
শাস্তিদাতা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, এই মাইরে ওর কিছু হয় না। এইডা এর কাছে পানিভাত। মাইর না খাইলে এর ভাত হজম হয় না।
মন্তাজ মিয়া বিস্মিত চোখে আমাকে দেখছে। তাকে দেখেই মনে হল সে তার ক্ষুদ্র জীবনে এই প্রথম একজনকে দেখছে যে চুরি করার পরও তাকে চোর বলেনি। মন্তাজ মিয়া নিঃশব্দে বাকি দিনটা জানালার ওপাশে বসে রইল। অন্যদিন তার সঙ্গে দুএকটা কথাবার্তা বলি, আজ একটা কথাও বলা হল না। মেজাজ খারাপ হয়েছিল। এই বয়সে একটা ছেলে চুরি শিখবে কেন?
মন্তাজ মিয়ার যে একটা বিশেষ ঘটনা আছে তা জানলাম আমার ছোট চাচির কাছে। চুরির ঘটনারও দুদিন পর। গ্রামের মানুষদের এই একটা অদ্ভুত ব্যাপার। কোন ঘটনা যে গুরুত্বপূর্ণ, কোনটা তুচ্ছ তা এরা বুঝতে পারে না। মন্তাজ মিয়ার জীবনের এত বড় একটা ব্যাপার কেউ আমাকে এতদিন বলেনি, অথচ তুচ্ছ সব বিষয় অনেকবার করে শোনা হয়ে গেছে। মন্তাজ মিয়ার ঘটনাটা এই-
তিন বছর আগে কার্তিক মাসের মাঝামাঝি মন্তাজ মিয়া দুপুরে প্রবল জ্বর নিয়ে বাড়ি ফেরে। সেই জ্বরের প্রকোপ এতই বেশি যে শেষ পর্যন্ত মন্তাজ মিয়ার হতদরিদ্র বাবা একজন ডাক্তারও নিয়ে এলেন। ডাক্তার আনার কিছুক্ষণের মধ্যেই মন্তাজ মিয়া মারা গেল। গ্রামে জন্ম এবং মৃত্যু দুটোই বেশ স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা হয়। মন্তাজ মিয়ার মা কিছুক্ষণ চিৎকার করে কাঁদল। তার বাবাও খানিকক্ষণ ‘আমার পুত কই গেলরে’ বলে চেঁচিয়ে স্বাভাবিক হয়ে গেল। বেঁচে থাকার প্রবল সংগ্রামে তাদের লেগে থাকতে হয়। পুত্রশোকে কাতর হলে চলে না।
মরা মানুষ যত তাড়াতাড়ি কবর দিয়ে দেওয়া হয় ততই নাকি সোয়াব এবং কবর দিতে হয় দিনের আলো থাকতে থাকতে। কাজেই জুম্মাঘরের পাশে বাদ আছর মন্তাজ মিয়ার কবর হয়ে গেল। সবকিছুই খুব স্বাভাবিকভাবে।
অস্বাভাবিক ব্যাপারটা শুরু হল দুপুর রাতের পর, যখন মন্তাজ মিয়ার বড় বোন রহিমা কলমাকান্দা থেকে উপস্থিত হল। কলমাকান্দা এখান থেকে একুশ মাইল। এই দীর্ঘ পথ একটি গর্ভবতী মহিলা পায়ে হেঁটে চলে এল এবং বাড়িতে পা দিয়েই চেঁচিয়ে বলল, তোমরা করছ কী? মন্তাজ বাঁইচ্যা আছে। কবর খুঁইড়া তারে বাইর কর। দিরং কবরা না।
বলাই বাহুল্য, কেউ তাকে পাত্তা দিল না। শোকে-দুঃখে মানুষের মাথা খারাপ হয়ে যায়। কবর দিয়ে দেওয়ার পর নিকট আত্মীয়-স্বজনরা সবসময় বলে-“ও মরে নাই।” কিন্তু মন্তাজ মিয়ার বোন রহিমা এই ব্যাপারটা নিয়ে এতই হৈচৈ শুরু করল যে সবাই বাধ্য হল মৌলানা সাহেবকেডেকে আনতে।
রহিমা মৌলানা সাহেবের পায়ে গিয়ে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, মন্তাজ বাঁইচ্যা আছে- আপনে এরে বাঁচান। আপনে না বললে কবর খুঁড়ত না। আপনে রাজি না হওয়া পর্যন্ত আমি পাও ছাড়তাম না। মৌলানা সাহেব অনেক চেষ্টা করেও রহিমাকে ঝেড়ে ফেলতে পারলেন না। রহিমা বজ্রআঁটুনিতে পা ধরে বসে রইল।
মৌলানা সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন- বাঁইচা আছে বুঝলা ক্যামনে? রহিমা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আমি জানি।
গ্রামের মৌলানারা অতি কঠিনহৃদয়ের হয় বলে আমাদের একটা ধারণা আছে। এই ধারণা সত্যি নয়। মৌলানা সাহেব বললেন- প্রয়োজনে কবর দ্বিতীয়বার খোঁড়া জায়েজ আছে। এই মেয়ের মনের শান্তির জন্যে এটা করা যায়। হাদিস শরীফে আছে…
কবর খোঁড়া হল।
ভয়াবহ দৃশ্য!
মন্তাজ মিয়া কবরের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে। পিটপিট করে তাকাচ্ছে। হঠাৎ চোখে প্রবল আলো পড়ায় চোখ মেলতে পারছে না। কাফনের কাপড়ের একখ- লুঙ্গির মতো পেঁচিয়ে পরা। অন্য দুটি খন্ড সুন্দর করে ভাঁজ করা।
অসংখ্য মানুষ জমা হয়ে আছে। এই অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখে কারো মুখে কোনও কথা সরল না। মৌলানা সাহেব বললেন- কীরে মন্তাজ?
মন্তাজ মৃদুস্বরে বলল, পানির পিয়াস লাগছে।
মৌলানা সাহেব হাত বাড়িয়ে তাকে কবর থেকে তুললেন।
এই হচ্ছে মন্তাজ মিয়ার গল্প। আমি আমার এই জীবনে অদ্ভুত গল্প অনেক শুনেছি, এ রকম কখনো শুনিনি।
ছোট চাচাকে বললাম, মন্তাজ তারপর কিছু বলেনি? অন্ধকার কবরে জ্ঞান ফিরবার পর কী দেখল না-দেখল এইসব?
ছোট চাচা বললেন- না। কিচ্ছু কয় না। হারামজাদা বিরাট বজ্জাত।
‘জিজ্ঞেস করেননি কিছু?’
‘কত জনে কত জিজ্ঞেস করছে। এক সাংবাদিকও আসছিল। ছবি তুলল। কত কথা জিজ্ঞেস করল-একটা শব্দ করে না। হারামজাদা বদের হাড্ডি।’
আমি বললাম, কবর থেকে ফিরে এসেছে-লোকজন তাকে ভয়-টয় পেত না?
‘প্রথম প্রথম পাইত। তারপর আর না। আল্লাহ্‌তায়ালার কুদরত। আল্লাহ্‌তায়ালার কেরামতি আমরা সামান্য মানুষ কী
বুঝব কও?’
‘তা তো বটেই। আপনারা তার বোন রহিমাকে জিজ্ঞেস করেননি সে কী করে বুঝতে পারল মনত্মাজ বেঁচে আছে?’
‘জিজ্ঞেস করার কিছু নাই। এইটাও তোমার আল্লাহ্‌র কুদরত। উনার কেরামতি।’
ধর্মকর্ম করুক বা না-করুক গ্রামের মানুষদের আল্লাতায়ালার ‘কুদরত’ এবং কেরামতির’ উপর অসীম ভক্তি। গ্রামের মানুষদের চরিত্রে চমৎকার সব দিক আছে। অতি তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে এরা প্রচুর মাতামাতি করে, আবার অনেক বড় বড় ঘটনা হজম করে। দার্শনিকের মতো গলায় বলে ‘আল্লাহ্‌র কুদরত’।
আমি ছোট চাচাকে বললাম, রহিমাকে একটু খবর দিয়ে আনানো যায় না? ছোট চাচা বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন?
‘কথা বলতাম।’
‘খবর দেওয়ার দরকার নাই। এম্নেই আসব।’
‘এম্নিতেই আসবে কেন?’
ছোট চাচা বললেন- তুমি পুলাপান নিয়া আসছ। চাইরদিকে খবর গেছে। এই গেরামের যত মেয়ের বিয়া হইছে সব অখন নাইওর আসব। এইটাই নিয়ম।
আমি অবাকই হলাম। সত্যি সত্যি এটাই নাকি নিয়ম। গ্রামের কোনো বিশিষ্ট মানুষ আসা উপলক্ষে গ্রামের সব মেয়েনাইওর আসবে। বাপের দেশের আসার এটা তাদের একটা সুযোগ। এই সুযোগ তারা নষ্ট করবে না।
আমি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেউ কি এসেছে?
‘আসব না মানে? গেরামের একটা নিয়ম-শৃঙ্খলা আছে না?’
আমি ছোট চাচাকে বললাম, আমাদের উপলক্ষে যেসব মেয়ে নাইওর আসবে তাদের প্রত্যেককে যেন একটা করে দামি শাড়ি উপহার হিসেবে দেওয়া হয়, একদিন খুব যত্ন করে দাওয়াত খাওয়ানো হয়।
ছোট চাচা এটা পছন্দ করলেন না। তবে তাঁর রাজি না হয়েও কোনও উপায় ছিল না। আমাদের জমিজমা তিনি দীর্ঘদিন ধরে ভোগদখল করছেন।
গ্রামের নিয়মমতো একসময় রহিমাও এল। সঙ্গে চারটি ছোট ছেলেমেয়ে। হতদরিদ্র অবস্থা। স্বামীর বাড়ি থেকে সে আমার জন্যে দুটা ডালিম নিয়ে এসেছে।
আমার স্ত্রী তাকে খুব যত্ন করে খাওয়াল। খাওয়ার শেষে তাকে শাড়িটি দেওয়া হলো। মেয়েটি অভিভূত হয়ে গেল। এ রকম একটা উপহার বোধহয় তার কল্পনাতেও ছিল না। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। আমি তাকে আমার ঘরে ডেকে নিলাম। কোমল গলায় বললাম, কেমন আছ রহিমা?
রহিমা ফিসফিস করে বলল, ভালো আছি ভাইজান।
‘শাড়ি পছন্দ হয়েছে?’
‘পছন্দ হইব না! কী কন ভাইজান! অত দামি জিনিস কি আমরা কোনোদিন চউক্ষে দেখছি!’
‘তোমার ভাইয়ের ব্যাপারটা জানতে চাচ্ছিলাম। তুমি কী করে বুঝলে ভাই বেঁচে আছে?’
রহিমা অনেকটা সময় চুপ করে থেকে বলল, কী কইরা বুঝলাম আমি নিজেও জানি না ভাইজান। মৃত্যুর খবর শুইন্যা দৌড়াইতে দৌড়াইতে আসছি। বাড়ির উঠানে পাও দিতেই মনে হইল মন্তাজ বাঁইচ্যা আছে।
‘কীজন্যে মনে হল?’
‘জানি না ভাইজান। মনে হইল।’
‘এইরকম কি তোমার আগেও হয়েছে? মানে কোনও ঘটনা আগে থেকেই কি তুমি বলতে পার?’
‘জ্বি না।’
‘মন্তাজ তোমাকে কিছু বলেনি? জ্ঞান ফিরলে সে কী দেখল বা তার কী মনে হল?’
‘জ্বি না।’
‘জিজ্ঞেস করনি?’
‘করছি। হারামজাদা কথা কয় না।’
রহিমা আরও খানিকক্ষণ বসে পানটান খেয়ে চলে গেল।
আমার টানা লেখালেখিতে ছেদ পড়ল। কিছুতেই আর লিখতে পারি না। সবসময় মনে হয় বাচ্চা একটি ছেলে কবরের বিকট অন্ধকারে জেগে উঠে কী ভাবল? কী সে দেখল? তখন তার মনের অনুভূতি কেমন ছিল? মন্তাজ মিয়াকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে, আমার মনে হয় জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হবে না। সবসময় মনে হয় বাচ্চা একটি ছেলেকে ভয়স্মৃতি মনে করিয়ে দেওয়াটা অন্যায় কাজ। এই ছেলে নিশ্চয়ই প্রাণপণে এটা ভুলতে চেষ্টা করছে। ভুলতে চেষ্টা করছে বলেই কাউকে কিছু বলতে চায়
না। তবু একদিন কৌতূহলের হাতে পরাজিত হলাম।

দুপুরবেলা।
গল্পের বই নিয়ে বসেছি। পাড়াগাঁর ঝিম-ধরা দুপুর। একটু যেন ঘুম-ঘুম আসছে। জানালার বাইরে খুট করে শব্দ হল। তাকিয়ে দেখি মন্তাজ। আমি বললাম- কী খবররে মন্তাজ?
‘ভালো।’
‘বোন আছে না চলে গেছে?’
‘গেছেগা।’
‘আয় ভেতরে আয়।’
মন্তাজ ভেতরে চলে এল। আমার সঙ্গে তার ব্যবহার এখন বেশ স্বাভাবিক। প্রায়ই খানিকটা গল্পগুজব হয়। মনে হয় আমাকে সে খানিকটা পছন্দও করে। এইসব ছেলে ভালোবাসার খুব কাঙাল হয়। অল্পকিছু মিষ্টি কথা, সামান্য একটু আদর এতেই তারা অভভূত হয়ে যায়। এই ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে বলে আমার ধারণা।
মন্তাজ এসে খাটের এক প্রান্তে বসল। আড়ে আড়ে তোমাকে দেখতে লাগল। আমি বললাম, তোর সঙ্গে কয়েকটা কথা
বলি, কেমন?
‘আইচ্ছা।’
‘ঠিকমতো জবাব দিবি তো?’
‘হুঁ।’
‘আচ্ছা মন্তাজ, কবরে তুই জেগে উঠেছিলি, মনে আছে?’
‘আছে।’
‘যখন জেগে উঠলি তখন ভয় পেয়েছিলি?’
‘না।’
‘না কেন?’
মন্তাজ চুপ করে রইল। আমার দিক থেকে অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নিল। আমি বললাম, কী দেখলি- চারদিক অন্ধকার?
‘হ।’
‘কেমন অন্ধকার?’
মন্তাজ এবারও জবাব দিল না। মনে হচ্ছে সে বিরক্ত হচ্ছে।
আমি বলালম, কবর তো খুব অন্ধকার তবু ভয় লাগল না?
মন্তাজ নিচুস্বরে বলল, আরেকজন আমার সাথে আছিল সেইজন্য ভয় লাগে নাই।
আমি চমকে উঠে বললাম, আরেকজন ছিল মানে? আরেকজন কে ছিল?
‘চিনি না। আন্ধাইরে কিচ্ছু দেখা যায় না।’
‘ছেলে না মেয়ে?’
‘জানি না।’
‘সে কী করল?
‘আমারে আদর করল। আর কইল, কোনও ভয় নাই।’
‘কীভাবে আদর করল?’
‘মনে নাই।’
‘কী কী কথা সে বলল?’
‘মজার মজার কথা-খালি হাসি আসে।’
বলতে বলতে মন্তাজ মিয়া ফিক করে হেসে ফেলল।
আমি বললাম, কীরকম মজার কথা? দুএকটা বল তো শুনি?
‘মনে নাই।’
‘কিছুই মনে নাই? সে কে এটা কি বলেছে?’
‘জ্বি না।’
‘ভালো করে ভেবেটেবে বল তো-কোনোকিছু কি মনে পড়ে?’
‘উনার গায়ে শ্যাওলার মতো গন্ধ ছিল।’
‘আর কিছু?’
মন্তাজ মিয়া চুপ করে রইল।
আমি বললাম, ভালো করে ভেবেটেবে বল তো! কিছুই মনে নেই?
মন্তাজ মিয়া অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, একটা কথা মনে আসছে।
‘সেটা কী?’
‘বলতাম না। কথাডা গোপন।’
‘বলবি না কেন?’
মন্তাজ জবাব দিল না।
আমি আবার বললাম, বল মন্তাজ, আমার খুব শুনতে ইচ্ছা করছে।
মন্তাজ উঠে চলে গেল।
এই তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা।বাকি যে-ক’দিন গ্রামে ছিলাম, সে কোনোদিন আমার কাছে আসেনি। লোক পাঠিয়ে খবর দিয়েছি তবু আসেনি। কয়েকবার নিজেই গেলাম। দূর থেকে দেখতে পেয়ে সে পালিয়ে গেল। আমি আর চেষ্টা করলাম না।
কিছু রহস্য সে তার নিজের কাছে রাখতে চায়। রাখুক। এটা তার অধিকার। এই অধিকার অনেক কষ্টে সে অর্জন করেছে। শ্যাওলাগন্ধী সেই ছায়াসঙ্গীর কথা আমরা যদি কিছু নাও জানি তাতেও কিছু যাবে আসবে না।
READ MORE - প্রতি বছর শীতের ছুটির সময় ভাবি কিছুদিন গ্রামে কাটিয়ে আসব।


Must Comment: