এক
খুব দ্রুত জামাটা গায় দিয়ে আমি তৈরি হয়ে নিলাম । দেয়ালে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় সাড়ে ন’টা বাজে । দেরি হয়ে গেছে । ইদানিং কোন কাজই সময় মতো করতে পারছিনা। সব কাজে কোন না কোন কারণে দেরি হয়ে যায় । বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ সব কাজগুলো । সাড়ে দশটার মধ্যে এফডিসিতে পৌছতে হবে । অনেক ধরাধরির পর বিখ্যাত পরিচালক এহতে সামস্ সময় দিয়েছেন, তাও আবার পাঁচ মিনিট । মানুষের সময়ের মূল্য যে কতো, তা এ সব বিখ্যাত মানুষগুলোকে না দেখলে বোঝা যায় না। এই পাঁচ মিনিট সময়ের মধ্যে তাকে পুরো চিত্র নাট্যটি বোঝাতে হবে । যদি তার পছন্দ হয়, তা হলে তিনি তার পরবর্তি ছবির জন্য আমার লেখাটি নেবেন ।
এটাই কোন পরিচালকের সঙ্গে আমার চিত্রনাট্য নিয়ে প্রথম সাক্ষাত নয় । এর আগেও অসংখ্য বার অসংখ্য পরিচালক আমার চিত্রনাট্য দেখেছেন । এবং প্রতিবারই আমি প্রত্যাক্ষিত হয়ে যন্ত্রনার শেষ সীমায় পৌছে পার মাতাল হয়ে মেসে ফিরেছি । বাংলা সিনামায় চাকবুম চাকবুম বিষয় না থাকলে ঠিক জমে না । অথচ আমি সেই চাকবুম চাকবুম জিনিষটাকে আমার চিত্রনাট্য থেকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে দিয়েছি । চিত্রনাট্য নেড়ে চেড়ে সিগারেটের পেছনে দম দিতে দিতে এক এক জন বলছেন, “মিয়া নাচ-গান নাই এইটা কোন সিনামা হইলো ? নাচে গানে ভরপুর কিছু নিয়া আস, পার্বলিক নায়িকার উত্তাল নাচ দেখতে চায় । নায়িকারে বৃস্টিতে ভিজাও পানিতে চুবাও , প্রয়োজনে বন জঙ্গলে নিয়া হাটুর উপড়ে সাপের কামড় খাওয়াও তা হইলেই না সিনামা হিট হইবো ”। আমি নায়িকারে বৃস্টিতেও ভিজাতে পারছিনা আবার পানিতেও চুবাতে পারছি না । না পারছি হাটুর উপড় সাপের কামড় খাওয়াইতে । তাই কোন পরিচালক আমার চিত্রনাট্য গিলছে না । কাজেই প্রত্যাক্ষিত হয়ে মাতাল হয়ে পরিচালকদের চৌদ্দগোস্টিকে গালিগালাজ করে মেসে ফেরা ছাড়া আমার কোন উপায় নাই ।
মধুমিতা মেসের মালিক সদু ভাই আমাকে বিশেষ ভালবাসেন বিধায় ঐ অবস্থায় আমি মেসে ফিরতে পারি । তা না হলে যে কি হতো কে জানে । তা ছাড়া এ জগতের মানুষের এ অভ্যাসটাকে লোকে অনেকটা মেনে নিয়েছে ।
আজও হয়তো ভাংঙ্গা মন নিয়ে মাতাল হয়ে আমাকে গভীর রাত্রিরে মেসে ফিরতে হবে । যতোটা উৎসাহ নিয়ে যাচ্ছি; হয়তো তার চাইতেই ঢের বেশি মনকষ্ট নিয়ে ফিরে আসবো । তাই বলে হাল ছেড়ে দেবার পাত্র আমি নই । একবার না পারিলে দেখ শতবার নীতিতে বিশ্বাস রেখে এগিয়ে চলেছি ।
টেবিলের উপরে রাখা ব্যাগটা আরেকবার পরীক্ষা করে নিলাম । লেখাটি ঠিক মতো আছে কিনা । গত রাতে পুরো চিত্রনাট্যটি বেশ কয়েকটি জায়গায় কাটাছেড়া করেছি। পরে ফ্রেশ করে নেওয়া যাবে । এখন সময় নেই । আলমারি খুলে এ মাসের বেতনের শেষ পাঁচশ টাকার নোটটা বের করে মানিব্যাগে নিলাম। মাসের বাকি এখন ও দশ দিন । বাকি দিনগুলো কিভাবে কাটবে কে জানে ।
দরজায় তালা দিয়ে । সিড়ি দিয়ে নীচে নামতেই কাউন্টারের সামনে দেখি সদু ভাই দাঁড়িয়ে কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলছেন । খুব সম্ভব এরা মেসের বাবুচি হবে । আমাকে সিঁড়ি দিয়ে তারাহুরো করে নামতে দেখে সদু ভাই আমার দিকে একবার তাকিয়ে-কাউন্টারের উপড় রাখা পিক দানিতে পানের পিক ফেলে বললেন, “কি রাইটার সাব , আবারও মনে হয় যাইতাছ ?” আমি একটু থেমে মাথা নেড়ে বললাম , জি সদু ভাই, দোয়া করবেন ?
“তা এইবার কারে দেখাইবা ?”
“এহতে সামস্ ।” আমি ছোট্র করে নামটা বললাম ।
ক ও কি মিঞা ? ঐ ব্যাটা তো হুনছি হিটের পর হিট । ঠিক লোকরেই ধরছো মনে হয় । তোমার দিয়া হইবোই হইবো এইডা আমি কইয়া দিলাম । সদু ভাই এগিয়ে এসে আমার কাঁধে চাপর দিলেন । সঙ্গে সঙ্গে জর্দ্দার কড়া গন্ধ নাক এসে নাকে লাগল । আমি চলে যাবার ভঙি করে, “বললাম, “দোয়া করবেন সদু ভাই ।”
দোয়া তো করমুই, এইডাই তো এখন আমাগো বাংলাদেশে একমাত্র ফ্রি জিনিষ । তা কুনহানে দেহা করবা ওনার লগে ? যাইবা কই ?
এফডিসিতে ?
কও কি ?
জ্বি, ওনার একটা সুটিং আছে. ফাঁকে আমার সঙ্গে কথা বলবেন ।
বা: বেশ ভাল । হাতে সময় থাকলে তোমার লগে যাইতাম । এফডিসির ভেতরটা দেহনের আমার খুব সখ ।
সদু ভাই, আমি তাহলে আসি, দেরি হয়ে যাচ্ছে, হাতে একদম সময় নাই । সাড়ে দশটার মধ্যে পৌছাতে হবে । আমি হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিনয়ের সঙ্গে বললাম ।
আরে তাইলে তো আসলেই সময় নাইকা । এহনতো অফিস টাইম । এখন গাড়ি ঘোড়াও পাওয়া কঠিন; চলো আমার লগে দেহি নাসিরার গ্যারেজে গাড়ি আছে কিনা । আমি চমকে উঠলাম । কেননা সদু ভাই এর সঙ্গে যাওয়া মানে আরেক যন্ত্রনা । দেখা যাবে গাড়ি পেতে পেতেই সাড়ে দশটা বেজে যাবে । আমি তারাতারি না,না করতে করতে বললাম, “আপনাকে কষ্ঠ করতে হবে না সদু ভাই, আমি খুঁজে নিবো ।”
আরে মিঞ খুঁইজা নিবা বললেই হইলো নাকি ? গাড়ি পাইতে হইবো না ? চলো আমার লগে। সদু ভাই তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, রাতের জন্য পোলাও গোস্ত করিস । আজ রাইটার সাহেবের জয় হইবোই হইবো। আমি সদু ভাইয়ের এই স্নেহের কাছে পরাস্ত হয়ে তার পিছু পিছু মেস থেকে বের হয়ে এলাম । বুক চিরে বের হয়ে এলো একটা দীর্ঘশ্বাস ।
নাসিরের গ্যারেজে অতি সহজেই গাড়ি পাওয়া গেল । গ্যারেজের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সদু ভাই বললেন; “চলো আইজকা তুমি সফল হইবা কি হইবা না তার একটা ছোট্র পরীক্ষা কইরা ফেলাই ?
”কিভাবে ? আমি দ্রুত পা ফেলে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করলাম ।
যদি নাসিরার গ্যারেজে যাইয়াই গাড়ি পাইয়া যাই তাইলেই মনে করুম তুমি আজ সফল । ঐ পরিচালক ব্যাটা তোমার বই লইবোই লইবো ।
আমি এসব বিশ্বাস করি না । তাই মুখে কিছু বললাম না । কিন্তু তবুও দেখা গেল সত্যিই গ্যারেজে গাড়ি পাওয়া যায় কিনা সেটা দেখার জন্য মনে মেনে বেশ উৎগ্রীব হয়ে উঠলাম ।
নাসিরের গ্যারেজে ঢুকতেই দেখি, দরজার সামনে একটা সিএনজি দাঁড়িয়ে আছে। সদু ভাই আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ, তুমি জিতা গেছ । যাও, আইজকা তোমারে আর কেউ আটকাইতে পরবোনা কইয়া দিলাম । প্রাথমিক বিজয়ে আমার মনটাও খুশিতে ভরে উঠল ।
গ্যারজের মালিক নাসির একটা ময়লা বিছানার উপড়ে বসে চা খাচ্ছিল, সদু ভাইকে দেখে তারাহুরো করে নেমে এসে সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কিছু লাগবো ভাই ? আমারে খবর পাঠাইলে তো আমিই যাইতাম ।”
তা,তো যাইতিই। এখন দেখ একটা গাড়িটারি আছে কিনা,আমাগো রাইটার সাব এফডিসিতে যাইবো ।
এই সিএনজিতে গেলে হয় না ভাই, নাকি গাড়িই লাগবো ? নাসির আমার দিকে তাকিয়ে দরজার সামনে দাড়িয়ে থাকা সিএনজিটা দেখিয়ে বলল ।
গাড়ি লাগবে না, সিএনজিতে হলেও চলবে । বলে আমি সদুভাইয়ের দিকে তাকালাম ।
তোর ড্রাইবার কই ?
আছে, মনে হয় মুততে গেছে । দাঁড়ান আমি ওরে লইয়া আইতাছি । বলেই নাসির দৌড়ে গ্যারেজের পেছনে চলে গেল ।
নাসিরারা কামডা দেখলা, এইসব পোলাপান হালায় ম্যানার জানে না; তোমার সামনে ক্যামনে কইলো মুততে গেছে । তুমি কিছু মনে কইরো না । আইউক দিমুনে কানের পেছনে দু’ইডা ভনচটকোনা, হালায় পুতে কইবোনা, “বার্থরুমে গেছে । যাও যাও তুমি জিএনজিতে যাইয়া বও । রাইতে তারাতারি আইয়া পইরো পোলাও গোস্ত হইবো কিন্তু ।” আমি মাথা নেড়ে সিএনজিতে উঠে বসলাম । প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সতেরো কি আঠারো বছরের একটা ছেলে এসে , সিএনজি স্ট্যাট দিল ।
সদু ভাই কাছে এসে বলল, এক্কেবারে ঝড়ের বেগে লইয়া যাবি । সময় মতো পৌছাইতে না পারলে কিন্তু ঘারে খাবি । সদু ভাই এর এই বাড়াবারি দৃস্টিকটু, অনেক সময় অসহ্য লাগে। কিন্তু প্রচুর অর্থ কড়ি , উদারতা আর সান শওকতের জন্য সবাই সদু ভাইকে বেশ সমিহ করে চলতে বাধ্য হয় ।
ছেলেটা আমায় সত্যিই ঝড়ের বেগে নিয়ে এলো । আজ সবই দেখি বেশ ভালয় ভালয় হচ্ছে। রাস্তাতে জ্যাম ছিল না বললেই চলে । এফডিসির গেটে বিশাল ভীর । নায়ক নায়িকাকে দেখার জন্য উৎসুক ভক্তদের অভাব নাই । অনেক কষ্টে ভীড় ঠেলে গেটে পৌছে গেট পাস দেখাতেই আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিল ।
১১ নম্বর ফ্লোরে এহতে সামস্ সাহেবের সূটিং চলার কথা । ১১ নম্বরটা কোথায় তা কয়েক জনকে জিজ্ঞাসা করে ১১ পৌছে দেখি বিশাল এক তালা ঝুলছে । গেটের সামনে কয়েকজন গার্ড বসে গল্প করছে । মনটা খারাপ হয়ে গেল । অনেকটা অনিচ্ছা সত্যেও গার্ডদের এহতে সামস্ কথা জিজ্ঞাসা করতেই একজন বলল, স্যার, ইউনিট নিয়ে ১৩ নম্বর গেছে । ঐ হানে যান, ১১ নম্বরের জেনারেটার খারাপ হইছে তাই এইহানে সুটিং বন্ধ । ১৩ নন্বরটা কোন দিকে তা জেনে নিয়ে আমি জোরে পা চালালাম ।
দুই
১৩ নম্বরে পৌছে আমি এহতে সামস্ সাহেবকে সালাম দিলাম । তিনি আমাকে হাতের ইশারায় বসতে বললেন । আমি পেছনে দিকে একটা চেয়ার টেনে বসে পরলাম । এটা সেটা করে পুরো সেট রেডি করতে করতে ২টা বেজে গেল । লাঞ্চের পর সূটিং শুরু হলো । সূটিং মানে এক এলাহিকান্ড । আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে সুটিং দেখতে লাগলাম । এক একটা সট তিন চারবার করে নেওয়া হচ্ছে । যে সটটা আমার কাছে ওকে মনে হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে সেটাই পরিচালক সাহেব কাট করে আবার নতুন করে টেক করছেন । টানা রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত সূটিং চলে প্যাক আপ করা হলো । আমার অবস্থা ততোখনে কাহিল । এতো দীর্ঘ সময় প্রতিক্ষা আমাকে আর কখন ও করতে হয়নি । কয়েকবার মনে হয়েছিল চলে যাবার কথা । কিন্তু নিজের স্বপ্ন , নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে চলে যেতে পারিনি । আর তাছাড়া চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম মানুষটা ব্যস্ত । নিজেকে এই বলে শান্তনা দিয়ে বেধে রেখেছি যে, “কস্ট না করলে, কেস্ট মেলে না ।”
প্রায় পৌনে ১২টার সময় আমার ডাক পরলো । পুরো সেট তখন প্রায় খালি হয়ে গেছে । কয়েকজন সেট থেকে এটা সেটা খুলে ব্যাগে ঢুকাচ্ছে । এহতে সামস সাহেব বেশ রাশ গম্ভীর মানুষ । অপরিচিত জনের সঙ্গে খুব একটা কথা বলেন না । পুরো সূটিং চলাকালীন সময় আমি তাকে একবারের জন্যও হাসতে দেখিনি । আমাকে নিয়ে তিনি বসলেন পরিচালকদের রুমে । ওনার হাতে ছোট একটা গ্লাস । আমি রুমে ঢুকে আবারও সালাম দিতে উনি , মাথা নেড়ে বসতে বললেন । তারপর গ্লাসে আলতো করে একটা চুমুক দিয়ে বললেন – কতো দিন ধরে লেখালেখি করছো ?
জ্বী,ছোটবেলা থেকেই ।
ছোটবেলা থেকে ? তিনি ঠোট উল্টে তাচ্ছিল্যের একটা ভঙ্গি করে আমার কথাটা রিপিট করলেন ।
তা দু’একটা নাটক টাটক কি টিভিতে গিয়েছে ?
জ্বি না , আমি টিভির জন্য কোন নাটক লিখিনি ।
টিভিতে না লিখে একেবারে চলচিত্রে ? ছোট থেকে না শুরু করতে হয় । বলে তিনি আবারও গ্লাসে চুমুক দিলেন ।
আমি কিছু বললাম না । আমি মনে মনে বললাম, আমি বড় থেকে ছোটর দিকে যাবো বলে ঠিক করেছি । সুযোগ পেলেই মানুষ উপদেশ ঝারতে শুরু করে । তার উপড়ে হাতে যদি রঙ্গিন পানির গ্লেলাস থাকে তা হলে তো আর কথাই নেই ।
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে তিনি গ্লাসে আরেকটা চুমুক দিয়ে বললেন ,দেখি কি এনেছো আমার জন্য ? বলে তিনি হাত বাড়ালেন । আমি ব্যাগ থেকে চিত্রনাট্যটা বের করে হাতে দিলাম ।
গ্লাসটা টেবিলে রেখে তিনি চিত্রনাট্যটার একটা একটা করে পাতা উল্টাতে লাগলেন – আমার বুক তখন ধুকধুক করছে । আমি মনে মনে আল্লাহ, আল্লাহ করছি এই জন্য যে, এবার যেন আমাকে আর প্রত্যাক্ষিত হতে না হয় । এবার যেন খুশি মনে ফিরতে পারি । এ লাইনের নিয়মই হচ্ছে একবার যদি কোন পরিচালক একটা লেখা নিয়ে কাজ শুরু করেন তা হলে আর বসে থাকতে হয় না। একেরপর এক কাজ আসতেই থাকে । যতো সময় যাচ্ছিল তোতোই উত্তেজনার আমার হাত পা কাঁপতে লাগল । আমি কোন রকম বসে রইলাম । তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে একটার পর একটা পাতা উল্টিয়ে যাচ্ছেন । আর আমার অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে । অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছি। আমি যেন আমার সাফল্যের হাতছানি দেখতে পাচ্ছি।
একসময় তিনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন – এটা তুমি লিখেছো ?
জ্বি ? আমি ছোট করে উত্তর দিলাম ।
তোমার লেখাটা এক কথায় চমৎকার প্রচুর কাজ করেছো বুঝা যাচ্ছে । কিন্তু এ লেখা নিয়ে তো আমি কাজ করতে পারবো না । তোমার এ গল্পটা হলিউডে হলে লুফে নিত । কিন্তু আমাদের দেশের পারিপাশ্বিক অবস্থার জন্য এ গল্প চলবে না । আমি দু:খিত । তুমি অন্য একটা গল্প নিয়ে আস ।
আমার মন ভেঙ্গে গেল । আমি কিছু বললাম না । উঠে দাঁড়ালাম ।
আমাকে উঠতে দেখে তিনি বললেন “তোমার হাতের টার্ন ভাল , আমি তোমাকে একটা থিম দিচ্ছি তুমি এটা নিয়ে কাজ করো ।”
সরি স্যার, আমি শুধু নিজের থিম নিয়েই স্টরি তৈরি করি । আমি ওনার হাত থেকে চিত্রনাট্যটা নিয়ে স্টুডিও থেকে বের হয়ে এলাম । সঙ্গে সঙ্গে একঝাক হতাশা আমায় ঝেকে ধরলো । মনে হলো এ জীবনের কোন মানে হয় না । এ জীবনের জন্য শুধু ব্যর্থতা পর ব্যর্থতাই অপেক্ষা করছে ।
অনেক রাত হয়ে গেছে । পথ ঘাট একেবারে জন শুন্য । কিভাবে মেসে পৌছাব আমার সে চিন্তা নেই । এফডিসি থেকে বের হয়ে হাঁটতে লাগলাম । কয়েক কদম হেঁটে মাছের আড়ৎটার সামনে আসতেই একটা লোককে দেখতে পেলাম । একটা খুটির সঙ্গে হেলাম দিয়ে একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে । পুরানো কালো একটা কোট গায়ে দিয়ে আছে । পা’দুটো খালি । মাথাটা কেমন অস্বাভিক রকমের বড় । লোকটাকে দেখে আমার পাগল বলে মনে হলো । আমি না দেখার ভান করে সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম । লোকটার সামনে যেতেই লোকটা গলা খাকারি দিল । আমি ফিরে তাকালাম – লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়াল, তারপর আমার দিকে এগিয়ে এসে কোন রকম জড়তা ছাড়াই বলল – কি কিছু হলো ?
আমি বেশ অবাক হয়ে লোকটার দিকে তাকালাম । লোকটা আবারও বলল, কিছুই হয়নি তাই না?
কি হয়নি ? আমি চরম বিরক্তি নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলাম ।
তোর চিত্রনাট্য তো ঐ বুড়ো ভামটা নেয়নি, তাই না ?
আমি বেশ অবাক হয়ে লোকটার দিকে তাকালাম । এহতে সামস্ এর সঙ্গে আমার কি কথা হয়েছে তা তো এই পথের লোকটার জানার কথা নয় । আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞিস করলাম, কে আপনি ?
আমি কে ? সেটা বড় কথা না , আমার কথা সত্য কিনা সেটা বল ।
আমি অনিচ্ছা সত্বেও মাথা নাড়লাম । যার অর্থ হলো , হ্যা , তিনি আমার লেখাটি নেননি ।
ঐ বুড়ো ভামটা যে নিবে না তা আমি আগেই জানতাম । বলে লোকটা খেক খেক করে হেসে উঠলো। হাসির শব্দে আমি কেমন জানি ভয় পেয়ে গেলাম । মাছের আশটে গন্ধ তীব্র হয়ে নাকে এসে লাগল ।
দু’পা পিছিয়ে এসে প্রশ্ন করলাম আপনি কে , কি করে এসব জানলেন ?
বললাম না , আমি কে সেটা বড় ব্যাপার না । আমি সব জানি । তোর অতীত জানি, তোর বর্তমান জানি; আবারও তোর ভবিষ্যতও জানি । লোকটা আবারও ভয়াল ভাবে হাসতে লাগল । এবার আমি সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেলাম । কোন এক অজানা ভয়ে ভেতরটা কেপে কেঁপে উঠল । আমি কোনরকম তোতলাতে তোতলাতে বললাম, কি চাই আপনার, কি চাই?
তোর সঙ্গে সওদা করতে করতে চাই ? লোকটা হাসি থামিয়ে সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল । ভয়ন্কর হলুদ দু’টো চোখের দিকে তাকিয়ে আমার পুরো শরীর কাপতে লাগল । হঠাৎ আমার মনে হলো আমার বমি পেয়েছে । বমি করতে পারলে ভাল হতো । আমি আবারও তোতলাতে তোতলাতে বললাম, কিসের সওদা ?
তোর খ্যাতি, যশ্, প্রতিস্ঠা তোর সকল স্বপ্ন পুরণের সওদা ।
মানে ?
মানে সোজা ,তুই উঠে যাবি খ্যাতির চুড়ান্তে যেখান থেকে সব কিছু অতি তুচ্ছ বলে মনে হয়। যেখান থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় না । করবি এমন সওদা ? আমি তোকে সব সব দেবো । লোকটা আমার মুখের কাছে এসে ফিসফিস করে কথাগুলো বলল । বিশ্রী মাছের আশটে গন্ধটার জন্য আমি আবারও পিছিয়ে গেলাম । টের পেলাম তীব্র ভয়ে আবার হাত পা থরথর করে কাঁপছে । ভয়ন্কর কিছুর শন্কায় আমি ছুটে পালাতে চাইলাম । লোকটা মনে হয় আমার মনোভাব বুঝতে পেরে খপকরে আমার বাম হাতের কব্জির উপড়ে চেপে ধরল । আমি তীব্র ব্যর্থায় উহু করে শব্দ করে উঠলাম । লোকটা হাসতে হাসতে বলল , রাজি আছিস ? রাজি আছিস ? তুই মনে মনে যেমনটা চেয়েছিস ঠিক তেমনটাই হবে,তরতর করে উঠে যাবি খ্যাতির চুড়ায় । এসব বুড়ো ভামরা লাইন দিয়ে পরে থাকবে তোর লেখার জন্যে , বল রাজি আছিস কিনা । বলে ফেল, বলে ফেল ।
আমি কয়কে মিনিটের মধ্যে যেন আমার ভবিষ্যত দেখে ফেললাম । সকল ভয়কে উপেক্ষা করে বললাম , তাতে আপনার কি লাভ ?
আমার কি লাভ ? বলে লোকটা হো হো করে হাসতে লাগল । তাতে আমার পুরো শরীর আবারও কাঁটা দিয়ে উঠল ।
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, দেবার মতো তো আমার কিছু নেই ।
তোর সব আছে, আমার প্রয়োজনে আমি চেয়ে নেবে । তোর প্রয়োজনে তুই চেয়ে নিবি । আছিস রাজি ? বলে ফেল , বলে ফেল ।
আমি মনে মনে চিন্তা করলাম । হারাবার মতো আমার কিছুই নেই । আবার দেবার মতোও নেই কিছু । তা হলে লোকটা কি চাচ্ছে ?
ঠিক তখনি আমার ভেতর থেকে কেউ একজন বলে উঠল রাজি; আমি রাজি । তোর তো আপন কেউ নেই, তাই হারাবারও কিছু নেই ।
তুই তাহলে রাজি ? লোকটা আমার দিকে অদ্ভূত ঘোর লাগা চোখে তাকাল ।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, রাজি । সঙ্গে সঙ্গে লোকটা আমার হাত ছেড়ে দিল আমার কাছে মনে হলো পুরো হাতটা অবশ হয়ে গেছে । আমি হাতটা ঝারতে ঝারতে লোকটার চোখের দিকে তাকালাম । মনে হলো, আমার পুরো শরীর গুলিয়ে উঠলো । সঙ্গে সঙ্গে আমি বর্মি করে ফেললাম । অনেকক্ষন বর্মি করার পর একটু আরাম হলো । আমি লোকটার দিকে তাকাতেই দেখি কেউ নেই। কালো খুঁটিটা যেন আমার দিকে তাকিয়ে হাঁসছে । আমি মাতালের মতো টলতে টলতে মেসের দিকে পা বাড়ালাম ।
তিন
মধুমিতা মেসের সামনে ভীড়টা চোখে পরার মতো । মূল রাস্তায় দু’টো পুলিশের গাড়ী দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম । অনেকক্ষন হাঁটার ফলে প্রচন্ড ক্লান্তি অনুভব করছি । মনে হচ্ছে গোসল করতে পারলে ফ্রেস লাগত । কিন্তু এতো রাতে মেসের সামনে এতো লোকজন কি করছে বুঝতে পারলাম না । কৌতুহল নিয়ে মেসের ভেতরে ঢোকার জন্য পা বাড়াতেই গেটের কাছে একজন এসআই আমার পথ রোধ করে দাঁড়াল । আমাকে আপাত মস্তক এক নজর দেখে নিয়ে প্রশ্ন করল, “কে আপনি ?”
জ্বি, আমার নাম রন্জু । এখানেই থাকি ।
এতো রাতে কোথা থেকে এলেন ?
জ্বি কাজ ছিল একটা ।
কি কাজ ?
এফডিসিতে একজনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম ।
করেন কি ?
লেখালেখি করি ? গল্প, উপন্যাস , চিত্রনাট্য লিখি ।
ও বই লিখেন ?
লোকটা কি বুঝে প্রশ্ন করল বুঝলাম না, মাথা নেড়ে বললাম, হ্যা ।
তা, কতো দিন ধরে এখানে আছেন ?
বছর তিনেক হলো ।
কাউন্টারের কাছে ম্যানেজার বদরুলকে দেখলাম, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে । এতো বড় একজন মানুষের কান্না দেখতে ভাল লাগেনা । তার উপরে বদরুলকে তো আরো না । আমাকে দেখে বদরুল রন্জু ভাই বলে ছুটে এসে জরিয়ে ধরল ।
বদরুল লোকটাকে আমার বিশেষ পছন্দ না । আমি পারত পক্ষে ওর সঙ্গে কথা বলি না । বদরুলও আমাকে সব সময় এড়িয়ে চলে । সেই বদরুলের এভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরায় আমি অবাক না হয়ে পারলাম না । মানুষের আবেক কে কখনও উপেক্ষা করতে নেই । হোক না সে যেমনই মানুষ । কিন্তু বদরুলের ব্যাপারটা ভিন্ন । আমি বদরুলকে ছাড়িয়ে দিতে দিতে নরম অথচ শক্তভাবে প্রশ্ন করলাম;“কি হয়েছে বদরুল ? ”
সদু ভাই ; বলে বদরুল আবারও কাঁদতে লাগল । আমার কাছে মনে হলো বদরুল অভিনয় করছে । আমি দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞাসা করলাম, সদু ভাই কি ?
সদু ভাই আর নেই ।
নেই মানে কি? কোথায় গেছেন ? ভনিতা না করে আসল কথা বলো । আমি আস্থির হয়ে উঠলাম ।
সদু ভাই, সদু ভাই আত্মহত্যা করেছেন । বলে বদরুল ছেলে মানুষের মতো কাঁদতে লাগলো। এবার আর ওর কান্নাটাকে অভিনয় বলে মনে হলো না ।
আমি প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলাম, “কোথায়, কেন ?”
উপড়ে বলে, বদরুল আঙুল দিয়ে দোতালাটা দেখিয়ে দিল।
দোতালার শেষ মাথায় সদু ভাইয়ের একটা রুম আছে । সদু সেটাকে অফিস হিসাবেই ব্যবহার করেন । পাশে একটা বিছানা পাতা আছে মাঝে মাঝে রাতে থেকে গেলে সেটাতে সদু ভাই ঘুমান ।
আমি এসআইয়ের দিকে উপড়ে যাবার অনুমতি পাবার দৃস্টিতে তাকালাম । এসআই আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, যান। তবে কিছু স্পর্শ করবেন না । এটা মার্ডার কেসও হতে পারে।
ঠিক আছে, বলে দ্রুত উপড়ে উঠে এলাম । বারান্দায় চেনা অচেনা অনেক মানুষ । কয়েকজন পুলিশ ও রয়েছে । আমার রুমটা মাঝামাঝি । আমার রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম তালা দেয়া ।
যারা আমাকে চেনে তারা আমাকে দেখে সরে গিয়ে ভেতরে যারার রাস্তা করে দিল । সদু ভাইয়ের রুমে ঢুকতেই আমি ভয়ন্কর রকমের ভয় পেয়ে গেলাম, ফ্যানের সঙ্গে বিশ্রী ভাবে সদু ভাইয়ের দেহটা ঝুলছে । জ্বিবটা মুখ থেকে বের হয়ে আছে । চোখ দু’টো খোলা । বিশাল দুটো হাত দুপাশে ছড়ান । পুরো শরীরে কোন কাপড় নেই । আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম । হঠাৎ টের পেলাম আমার মাথা ঘুরছে। আমি কোন রকম বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।
থানা থেকে ওসি সাহেব আসার পর সুরতহাল রিপোট তৈরি করে পোস্টমটেমের জন্য লাশ নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো । পুলিশ মেসের বোর্ডারদের থানাতে না জানিয়ে কোথাও না যাবার নির্দেশ দিয়ে চলে গেল । ঘড়িতে তখন সাড়ে তিনটা বাজে। ইতিমধ্যে আমি একটু ধাতস্ত হতে পেরেছি । সদু ভাই নেই । কথাটা ভাবতেই বুকের ভেতটা কেমন জানি করে উঠছে। বারবার সদু ভাইয়েই মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে ।
রুমে ঢুকে দেখি টেবিলের উপড় আমার খাবার ঢেকে রাখা । তারমানে হচ্ছে – সদু ভাইয়ের কাছ থেকে চাবি নিয়ে আমার খাবারটা রুমে দিয়ে গেছে । আহা: সদু ভাই, আমি হঠাৎ কান্নায় ভেঙ্গে পরলাম । বুক চেপে ধরে খাটের উপড় বসে পরলাম। হঠাৎ এফডিসির বাইরে দেখা লোকটার কথাটা কানে ভাসতে লাগল, তোর তো আপন কেউ নেই , তাই হারাবারও কিছু নেই । তুই তাহলে রাজি ? তুই তাহলে রাজি ? আমার মনে হলো সদু ভাই আমার আত্মীয় না হয়েও অনেক বেশি আপন ছিল । অনেক, অনেক বেশি ।
পরের দিন সাড়ে ১২টার সময় দরজার প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভাংলো । তারাহুরো করে উঠে দরজা খুলে দেখলাম বদরুল দাঁড়িয় আছে ওর পাশেই পরিচালক এহতে সামস্ । আমি বেশ অবাক হয়ে তাকালাম । আমার মেসে এহতে সামস্ এর মতো পরিচালক আসবে এতোটা আশা করিনি । আমি একটু ঘাবরে গিয়ে বললাম – স্যার আপনি ?
দেখ, দেখি তোমাকে না জানিয়েই চলে আসলাম; তা তুমি কি ফ্রি আছো ? তাহলে তোমার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলে নিতাম ।
জ্বি স্যার, আসুন ভেতরে আসুন । বলে আমি দরজা থেকে সড়ে দাঁড়ালাম । এই প্রথম রুমের ভেতরের অবস্থা দেখে নিজের কাছে লজ্জা লাগল । এহতে সামস্ চারিদিকে একবার নজর বুলিয়ে টেবিল থেকে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে পরলেন । আমি বললাম, স্যার যদি কিছু মনে না করেন ; আমি হাত মুখটা ধুয়ে আসি । তিনি মাথা নেড়ে বললেন, সিওর । তারপর এগিক ওগিক তাকিয়ে বললেন, তোমার এখানে এসট্টে নেই ? সিগারেট ছাড়া আমি আবার একদম চলতে পারি না। আমি খাটের নীচ থেকে একটা ভাঙা চায়ের কাপ অনিচ্ছা সত্বেও বের করে টেবিলের উপর রাখলাম । এহতে সামস্ কাপটা দেখে হেসে সিগারেট ধরালেন । আমি বদরুলকে চা বলে বার্থরুমে ঢুকে গেলাম ।
এহতে সামস্ সাহেব আমাকে দু’লাখ টাকার একটা ক্যাশ চেক দিয়ে একটা কাগজে সাইন করিয়ে নিলেন । আমার চিত্রনাট্যটি নিয়ে তিনি কাজ করবেন । সূটিং শুরু হবে মাস দু’য়েকের মধ্যেই । তখন আরো তিন লাখ পেমেন্ট করবেন । জীবনের প্রথম সাফল্যে আমি থরথর করে কাঁপতে লাগলাম । উত্তেজনায় কাগজটার মধ্যে কি লেখা আছে সেটাও ভাল করে পড়তে পারলাম না । এহতে সামস্ এর দেখানো জায়গাতে সাইন করে চেকটা হাতে নিলাম । হঠাৎ সদু ভাইয়ের জন্য আবারও মনটা কেদে উঠল । মানুষটা বেঁচে থাকলে আজ সব চাইতে বেশি খুশি হতো । এহতে সামস্ সাহেব বিদায় নেবার পর আমি ব্যাংকে ছুটলাম। সদু ভাইয়ের আত্মার শান্তির জন্য কিছু টাকা খরচ করবো ।
সদু ভাইয়ের মৃত্যুর পর পুরো মেসটা যেন অতিরিক্ত নীরব হয়ে গেছে । দোতালার বেশ কয়েকজন বোর্ডার পুলিশের অনুমতি নিয়ে মেস ছেড়ে চলে গেছে । অনেকেই বলাবলি করছে রাতের বেলা তারা নাকি সদু ভাইকে দেখেছে মেসের বারান্দা দিয়ে খুরিয়ে খুরিয়ে হাঁটতে । কথাটা এ কান ওকান হয়ে আমার কানে এসে পৌছলে আমি সেটাকে মোটেও গুরুত্ব দেলাম না । বেঁচে থাকতে যে মানুষটাকে বুক ফুলিয়ে হাঁটতে দেখেছি, মরে গিয়ে সে কিনা খুরিয়ে খুরিয়ে হাঁটবে ? সব চাইতে বেশি কথা ছড়াচ্ছে কাজের বুয়া রেহানার মা । বুয়াটা রীতিমতো গল্প ফেঁদে বসেছে । সদু ভাইকে বুয়া নাকি রান্না ঘরে দেখেছে । সকাল বেলা বুয়া থালা বাসন ধুচ্ছিল, তখন হঠাৎ রান্না ঘরে খটর মটর শব্দ শুনে বুয়া রান্না ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে, সদু ভাই খালি গায়ে চুলার কাছে কি যেন খুঁছছে । বুয়া দরজার কাছেযেতেই, সদু ভাই নাকি বলে উঠেছে, ও রেহানার মা ম্যাচটা কোথায় রেখেছো ? ম্যাচটা দাও, সিগারেট খামু ।
বুয়ার এ গল্পটাই সব চাইতে বেশি ছড়িয়ে পরেছে । আশে পাশের দশ বাড়িতেও এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলছে । আমি এসব কথাবার্তাকে মোটেও গুরুত্ব দেচ্ছি না। কারো সঙ্গে এ প্রসঙ্গে আলোচনা ও করছি না । বার দুয়েক বদরুল এসেছিল আমার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলবে । এর কথার শুরুতেই আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বলেছি, বদরুল বাজে বিষয় নিয়ে কথা বলে আমার সময় নস্ট করবে না, যাও নিজের কাজ করো গিয়ে । বদরুল আর কিছু বলেনি মাথা নীচু করে চলে গেছে । যতোসব বাকোয়াস কথাবার্তা । আমি পূর্ণ উদ্যোমে লেখা লেখি চালিয়ে যাচ্ছি । ইতিমধ্যে একটি পত্রিকায় আমার ছোটখাটো ইন্টারভিউও ছাপা হয়েছে । অন্যান্য কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে বিদ্যূতের গতিতে নতুন চিত্রনাট্য লিখে চলেছি । পরপর দু’টো ফিকুয়েন্সের কাজও শেষ করে ফেলেছি । ঝামেলা বাঁধল তৃতীয়টার সময় । সদু ভাইকে মেসে দেখার ঘটনাগুলো আমি গুরুত্ব না দিলেও আমার অজান্তেই মেসের ভেতর একটা কিছু ঘটে যাচ্ছিল তার প্রমান পেলাম আরো দু’দিন পর । আমার পাশের রুমে থাকেন ব্যাংক কর্মকতা ওমর ফারুক সাহেব । সাদাসিদে অমায়িক লোক । কারো আগে পিছে নেই । তিনি কিনা রাতের বেলায় কি দেখে ভয় পেয়ে হার্ট এ্যটাক করে হাসপাতালে ভর্তি হলেন । ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার খুব একটা কতাবার্তা না হলেও আমি তাকে হাসপাতালে দেখতে গেলাম ।
ইদানিং বাংলাদেশের প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর চেহারা বদলে গেছে । ঝকঝকে তকতকে হাসপাতাল দেখলেই মন ভাল হয়ে যায়। ওমর ফারুক সাহেব আছেন হাসপাতালের দোতালার একটি কেবিনে । আমি তার কাছে পৌছে দেখি তিনি আঙুর খাচ্ছেন । দশ কি বারো বছরের একটি মেয়ে তার মুখে একটা একটা করে আঙুর তুলে দিচ্ছে । আমাকে দেখে ওমর ফুরুক সাহেব একটু লজ্জা পেলেও হেসে বললেন, আসেন লেখক সাহেব । আমি ভেতরে ঢুকে হেসে জিজ্ঞেস করলাম, তা এখন কেমন আছেন ?
জ্বি ভাল । ওমর ফারুক সাহেবকে দেখে মনে হলো তিনি আবারও লজ্জা পেলেন ।
ও কি আপনার মেয়ে নাকি ? আমি মেয়েটার মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞাসা করলাম ।
জ্বি । দেখুনতো কতো করে বলছি হাসপাতালে ছোটদের আসার দরকার নেই, কিন্তু তবুও নাছোড়বান্দা আমাকে দেখতে নাকি আসতেই হবে । মেয়েটার গায়ের রং শ্যামলা কিন্তু অনেক মিস্টি । আমি মেয়েটাকে কাছে টেনে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার নাম কি মা ?
মেয়েটা ছোট করে বললো, মায়া ।
বাঃ সুন্দর নাম ।
তা, তুমি কোন ক্লাসে পড় ?
ক্লাস থ্রি তে ।
আমিও তো থ্রি তে পড়ি । যাক তুমি আর আমি একই ক্লাসে পড়ি । আমি হেসে বললাম ।
তুমি মিথ্যা বলছো । তুমি তো বড় । তুমি আব্বুর লেখক বন্ধু । আব্বুর সঙ্গে থাকো । আমি সব জানি ।
ওমা তাই নাকি ? তুমিতো দেখছি তোমার আব্বুর বুড়ি মা ।
আমি বুড়ি না আমার বয়স তো মাত্র এগারো বছর । এমন সময় ওমর ফারুক সাহেবের স্ত্রী আসলেন । তিনি মেয়েকে নিয়ে বাহীরে গেলে ওমর ফারুক সাহেব আমাকে বললেন, ভাই আমি আর ঐ মেসে যাবো না । একটু সুস্থ্য হলে জিনিষ পত্র সব নিয়ে আসবো ।
কিন্তু কেন ?
মেসটার দোষ হয়েছে । ওখানে খারাপ আত্মা বাসা বেঁধেছে । আমি বলতে যাচ্ছিলাম এসব বাজে কথা। কিন্তু কিছু বলার আগেই ওমর ফারুক সাহেব বলে উঠলেন, আমি জানি আপনি এসব বিশ্বাস করেন না । তবুও বলছি, সম্ভব হলে আপনিও মেসটা ছেড়ে দিন ।
আপনি ভয় পেলেন কি দেখে ? আমি সরাসরি ওমর ফারুক সাহেবের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম ।
ওমর ফারুক সাহেব একটু স র্সত নিয়ে বললেন, সদু ভাইকে দেখে ।
সদু ভাইকে ?
জ্বি ।
তা কি দেখলেন ?
বার্থরুমে যাবার জন্য দরজা খুলে বারান্দায় বের হয়েছ দেখি সদু ভাইয়ের রুমের দরজা খোলা । আলো জ্বলছে । এতোরাতে সদুভাইয়ের রুমে কে, কি করছে তা দেখার জন্য আমি এগিয়ে গেলাম । দরজার দাঁড়িয়ে ভেতরে উকি দিতেই দেখি; সদু ভাই হাতে একটা মোটা দড়ি নিয়ে ফ্যানের নিচে একটা চেয়ারে দাঁড়িয়ে আছেন । দড়িটা ফ্যানে বাঁধার চেস্টা করছেন। আমি, কে ? বলার সঙ্গে সঙ্গে সদু ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, “ও ব্যান্কার ভাই চেয়ারটা একটু শক্ত করে ধরো তো দেখি । মনে হচ্ছে পইড়া যামু ।” আমার আর কিছু মনে নেই । সঙ্গে সঙ্গে বুকে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করি । তারপর বুক চেপে ধরে পরে গেলাম। চোখ খুলে দেখি আমি হাসপাতালে ।
ওমর ফারুক সাহেবের কথা ফেলে দিতে পারলাম না । একেবারে মনের মধ্যে গেঁথে গেল । ভয় হচ্ছে সংকামক ব্যধির মতো একবার কারো ভেতর ঢুকে গেলে ডাল পালা ছড়ায় অন্যের ভেতরে ঢোকার জন্য । নানান যুক্তি দিয়েও এর কোন কূল কিনারা করতে পারলাম না । একরাশ চিন্তা নিয়ে এলোমেলো ভাবে হাঁটতে হাঁটতে মেসে ফিরলাম রাত ১১টার সময় ।
চার
মেসে ঢুকতেই কাউন্টারে বদরুলকে পেয়ে দোতালায় ডেকে নিয়ে এলাম । দোতায়ায় আমি ছাড়া এখন আর অন্য কোন বোর্ডার নেই । রুমগুলো সব তালা দেয়া । বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিজের অজান্তেই শরীরটা কেমন ছমছম করে উঠল। আমি ধীরে সুস্থে তালা খুলে ভেতরে ঢুকলাম । আমার পেছন পেছন ঢুকলো বদরুল । আমি খাটে বসে বদরুলকে চেয়ারে বসতে বললাম, ও বলল, বসতে হবে না রঞ্জু ভাই , কি বলবেন বলেন ?
তুমি কি সদু ভাইকে দেখেছো ? আমি কোন রকম ভূমিকায় না গিয়ে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলাম ।
বদরুল কিছু বলল না । মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল ।
কালকে সকালে বলি রঞ্জু ভাই ?
এখন নয় কেন ?
রাতের বেলায় তেনাদের নিয়ে কোন কথা বলতে হয় না । বদরুল দেখে মনে হলো, ও গুটি চালতে শুরু করেছে ।
তেনারা মানে কারা ? আমি তোমাকে সদু ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করছি । আমি দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করলাম ।
তেনারা মানে মৃত মানুষদের কথা বলছি ।
আমার প্রশ্নের উত্তর দাও , তুমি কি সদু ভাইকে দেখেছো ?
জ্বি ,দেখেছি ; বদরুল কিছুক্ষন নীরব থেকে আমতা আমতা করে উত্তর দিল ।
কবে ?
তিনি ফাঁসি দেবার দু’দিন পরে । সন্ধ্যার সময় দোতালায় এসেছিলাম, হঠাৎ দেখি সদু ভাইরুমের লাইট জ্বলছে । দরজা বন্ধ । কে ভেতরে দেখার জন্য দরজার ফাঁক দিয়ে উকি দিতেই দেখি সদু ভাই টেবিলে বসে কি যেন লিখছে । আমার তো জান যায় যায় অবস্থা আমি এক দৌড়ে নিচে গিয়ে বাবুচি তোতারে ডেকে এনে দেখি কেউ নাই । ভেতরের বাতিও নেবানো।
তুমি মিথ্যা বলছো না তো ?
আল্লাহর কিরা, মিথ্যা বলুম ক্যান ।
তোমার কাছে সদু ভাইয়ের রুমের চাবি আছে তাই না ? আমি সরাসরি বদরুলের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম । বদরুল সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে ফেলল । মানুষ সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যা বলতে পারে না । তার বিবেক বাঁধা দেয় । বদরুলের কথা আমার এমনিতেই বিশ্বাস হয় না ।
না, বদরুল মাটির দিকে তাকিয় বলল ।
এবার কিন্তু মিথ্যা বলছ । আমার সঙ্গে ওসির সাহেবের কথা হয়েছে কোন রকম উল্টা পাল্টা দেখলেই সরাসরি ফোন করতে বলেছেন । তুমি কি চাও আমি তোমার কথাটা ওসি সাহেবকে বলি । ওসি সাহেবের কথাটা আমি বানিয়ে বললাম । আমার সন্দেহ হচ্ছে বদরুল এমন কিছু জানে যা আমাকে বলতে চাচ্ছে না ।
ওসির কথা শুনে, বদরুল হঠাৎ খুব ঘাবরে গেল ।
কাচুমাচু হয়ে বলল, রঞ্জু ভাই আমি কিন্তু কিছু করি নাই ।
তুমি কিছু করেছো তা আমি বলিনি । শুধু এইটুকু বলেছি আমার সঙ্গে মিথ্যা বললে ফেসে যাবে । তোমার কাছে সদু ভাইয়ের রুমের চাবি আছে তাই না ?
বদরুল মাথা নাড়ল, আছে ।
তুমি সদু ভাইয়ের রুমে ঢুকার ও চেষ্টা করেছো তাই না ।
বদরুল না বলতে গিয়েও কি মনে করে থেমে গেল ।
দেখো মিথ্যা বলোনা, একদম ফেসে যাবে ।
পুরো ঘটনাটা আমাকে খুলে বলো ।
কি ঘটনা ?
তুমি সদু ভাইয়ের রুমে ঢুকেছিলে তাই না ? কোন জিনিষপত্র কি সরিয়েছো ?
আল্লাহর কিরা রঞ্জু ভাই আমি কিছু সড়াইনি ।
তারমানে তুমি সদু ভাইয়ের রুমে ঢুকছিলে ?
জ্বি ?
কেন ?
ঝারপোছ করতে ।
ঝারপোছ করেছো ?
না, ।
না কেন ?
ভয়ে চলে এসেছি ?
ভয় ? কিসের ভয়ে ?
সদু ভাইয়ের ।
সদু ভাইয়ের মানে ?
আমি সকাল বেলা সদু ভাইয়ের রুমে ঢুকে জানালাগুলো খুলছিলাম হঠাৎ পেছন থেকে সদু ভাইয়ের গলা শুনে চমকে পেছন ফিরে দেখি সদু ভাই টেবিলের উপড়ে বসে আছে , আমি তাকাতেই আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, বদরুল দরজা খুলিস না রে রোদ আসে । আমি দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে আসি । পরে তোতার ডেকে এনে দরজা বন্ধ করেছি । বিশ্বাস করেন রঞ্জু ভাই এর মধ্যে এক বিন্দু মিথ্যা নাই ।
চাবিটা তোমার সঙ্গে আছে ?
জ্বি , বলে বদরুল এক গোছা চাবি বের করে তার মধ্যে থেকে পিতলের একটা চাবি দেখাল।
চাবিটা আমারে খুলে দাও ।
বদরুল চাবিটা খুলে আমাকে দিয়ে বলল, রঞ্জু ভাই একটু সাবধানে থাকবেন । দোতালায় কিন্তু এখন আপনি ছাড়া আর কেউ নেই ।
ঠিক আছে , তুমি এখন যাও ।
খাবেন না ? খাবার দেবো ?
না, খাবো না । তুমি পারলে এক ফ্লাক্স চা পাঠাও । রাতে লেখালেখি করতে হবে ।
কোন কিছুর দরকার হলে আমারে আওয়াজ দিয়েন । আমি জেগে থাকবো ।
ঠিক আছে,দরকার হলো ডাকবো । তুমি এখন যাও ।
বদরুল দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়িয়ে ডাক দিল , রঞ্জু ভাই ?
কি ?
আজ আপনার খোঁজে একটা মেয়ে এসেছিল ।
মেয়ে ? আমি বেশ অবাক হলাম । কেননা ঢাকা শহরে আমার পরিচিত কোন মেয়ে নেই । কখন ?
দুপুরের দিকে ?
কিছু বলেছে ?
না , বলেছে আবার আসবে ?
ঠিক আছে তুমি যাও ।
বদরুল চলে যেতে জামাকাপড় পাল্টে চা খেয়ে লিখতে বসলাম । একটানা অনেকক্ষন লেখার পর হঠাৎ লেখার খেই হারিয়ে ফেললাম । কিছুতেই যেন মাথা থেকে কিছু বের হচ্ছিল না । একজন লেখকের জন্য এটা বুঝি সবচাইতে বেশি কস্টের বিষয় । খুব গরম লাগছে । টেবিলের পাশের জানলাটা খুলে দিয়ে আমি আবারও লিখতে চেস্টা করে ব্যর্থ হলাম । না, আজ আর হবে না। লেখা বন্ধ করে যতোটুকু লেখা হয়েছে । তা নিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে পড়তে লাগলাম । ঘড়িতে তখন কাটায় কাটায় রাত ৩টা বেজে ২ মিনিট । হঠাৎ বাইরে দুপ করে কোথাও শব্দ হলো । সঙ্গে সঙ্গে আমার ষস্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠলো । আমি দ্বিতীয় বার শব্দটা শুনার জন্য কান খাড়া করে ফেললাম । আবারও হলো শব্দটা । এবার বেশ স্পর্স্ট ভাবেই শুনা গেল। আমার ডান পাশ থেকে আসছে শব্দটা অথাৎ সদু ভাইয়ের রুমের দিক থেকে । টের পাচ্ছি মাথার চুলগুলো একটা একটা করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে । আমি শোয়া থেকে উঠে দাড়ালাম । আমার কাছে মনে হলো,কেউ যেন দরজা খুলে বাহীরে আসলো। বারান্দায় হাঁটার শব্দ শুনা যাচ্ছে । আমার একটা রুমের পরেই সদু ভাইয়ের রুম । দরজা খুললে শব্দটা শোনা যাবার কথা । আমি আস্তে আস্তে আমার দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম । পায়ের শব্দটা আমার দরজার কাছে এসে আবার সদু ভাইয়ের রুমের দিকে ফিরে গিয়ে আবার ফিরে আসছে । পায়ের শব্দটা আমার দরজার কাছাকাছি আসতেই আমি একটানে দরজাটা খুলে ফেললাম । পুরো বারান্দা অন্ধকার । কোন আলো নেই । অন্ধাকারে কাউকে দেখতে পেলাম না । আন্ধকারটা চোখে সয়ে আসতে দেখলাম শুন্য বারান্দা খাঁ খাঁ করছে । আমি ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম । কাউকে না দেখে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম । কেননা বুকের ভেতর কম্পন বেড়ে গেছে । টেবিলের উপড় রাখা বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি খেলাম । বিছানায় বসতেই দরজায় পরপর তিনটা টোকার শব্দ হলো । আমি চমকে উঠলাম । আমি দাঁড়িয়ে গেছি । ভয়ে ঘামতে শুরু করেছি । মাথার চুলগুলো আবারও একটা একটা করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে । আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কে ? কে ?
কেউ উত্তর দিল না । আমি দরজার কাছে গিয়ে কান পেতে দাঁড়িয়ে রইলাম ।
না, আর কোন শব্দ নেই । হয়তো মনের ভুল , অতিরিক্ত উত্তেজনায় এলোমেলো শুনছি । বেশ কিছুক্ষন দরজায় দাঁড়িয়ে থাকার পর আবারও বিছানায় এসে বসলাম । নিজেকে শান্তনা দিচ্ছি ভয় পাবার কিছু নেই । সব মনের ভুল হবে । মৃত মানুষ কখনও ফিরে আসতে পারে না । বিছানায় শুয়ে আবারও যেই লেখাটা পড়তে শুরু করেছি । ওমনি দরজায় শব্দ হলো। সঙ্গে সঙ্গে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম । ছুটে গেলাম দরজার কাছে । একটানে খুলে ফেললাম দরজা । তারপর যা দেখলাম তাতে আমার পুরো শরীর কেপে উঠল । আমি হিস্টিরিয়ার রুগির মতো চিৎকার করে উঠলাম কে ? কে ? দরজায় দাঁড়িয়ে আছে; সদু ভাই । মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে । চোখ দুটো গর্তের ভেতরে ঢুকে আছে । আমি বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলাম । সদু ভাই বললেন, রাইটার সাব, একটা কাঁথা দিবা ? আমার খুব শীত করতাছে । এখানে এখানে খুব খুব শীত । দাওনা একটা কাঁথা । আমি দরাম করে দরজা বন্ধ করে দিলাম । প্রচন্ড ভয়ে পিপাষায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। মনে হলো আমি মরে যাচ্ছি । কানের ভেতরে ভো ভো শব্দ শুনছি । চোখে কিছু দেখছি বলে মনে হলো না । হঠাৎ ওমর ফারুক সাহেবর কথা মনে হলো, বুঝতে পারলাম কি দেখে ভদ্রলোক ভয় পেয়েছেন । আমি বড় করে হা করে শ্বাস নিয়ে ছাড়তে লাগলাম । বাকি রাতটুকু দরজায় হেলান দিয়ে কাটিয়ে দিলাম ।
পাঁচ
ফজরের আযানের পর বিছানায় শুতেই ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে এলো । কতোক্ষন ঘুমিয়েছি জানিনা হঠাৎ প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভাংলো । প্রথমে চোখ খুলে বুঝলাম না শব্দটা কোথা থেকে আসছে । দ্বিতীয় বার শব্দ হতেই বুঝলাম প্রচন্ড জোড়ে কেউ দরজায় আঘাত করছে । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি পৌনে ছয়’টা বাজে । এক ঘন্টাও ঘুমাতে পারিনি । এলোমেলো পা ফেলে দরজা খুলতেই দেখি পুলিশের সেই এসআই দাঁড়িয়ে আছে । পুলিশ দেখে আমি চমকে উঠলাম । কি ব্যাপার ? কোন রকম নিজেকে সামলে প্রশ্ন করলাম । কেননা আমি ভাল করে তাকাতে পারছিনা । মনে হচ্ছে চোখের ভেতর অসংখ্যা সূঁচ ফুটছে । দু হাত দিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে এসআইয়ের দিকে তাকালাম ।
আপনিই তো রঞ্জু সাহেব ?
জ্বি বলেন ।
দূঃখিত আপনাকে বিরক্ত করতে হলো । একটু নীচে চলুন ।
কেন কি হয়েছে ?
আসুন না, গেলেই তো দেখতে পাবেন । কোথায় যেন পড়েছিলাম রিকশা চালক আর পুলিশের সঙ্গে তর্ক করতে নেই ,তাতে সন্মানহানির আশংন্কা থাকে । সেই বাক্যটা মনে করে একটা সার্ট টেনে গায়ে দিয়ে এসআইয়ের পিছু পিছু হাটতে শুরু করলাম । সিঁড়ির কাছে অনেক লোকের ভীড় চোখে পরল। কয়েকজন পুলিশও দাঁড়িয়ে আছে । ভীড়ের মধ্যে এফডিসির সামনে দেখা লোকটাকে দেখে আমি চমকে উঠলাম । সেই হলুদ চোখ, বিশাল মাথাওয়ালা লোকটাকে খুব সহজেই চিনতে পারলাম । কেমন হাসি হাসি মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । আমার পুরো শরীর যেন কেঁপে উঠল । আমি সিড়ির রেলিংটা ধরে দাঁড়িয়ে গেলাম । এসআই বললেন, কি হলো ? আমি কয়েক মুহুর্ত কোন কথা বলতে পারলাম না । নিজেকে কোন রকম সামলে নিয়ে আবারও নিচে তাকাতে কাউকে দেখতে পেলাম না । মনে মনে বললাম, আমি বোধ হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি ।
সিঁড়ির নীচে মেঝেতে কেউ একজন উপুর হয়ে পরে আছে । ঘারটা বিশ্রী ভাবে ডানপাশে মোচড়ানো । রক্তের দু’টো ধারা গড়িয়ে মেঝেতে নেমে গেছে । উপড় থেকে এক নজর দেখেই বুঝলাম বেঁচে নেই। ওটা কে ? কে ওখানে পরে আছে ? কথাটা বলে আমি দ্রুত পা ফেলে নীচের নেমে গেলাম । কাছে গিয়ে বদরুলকে চিনতে মোটেই বেগ পেতে হলো না । বদরুলকে এভাবে অপঘাতে মরতে দেখে আমি খুব ঘাবরে গেলাম। পরপর দু’টো মৃত্যু আমাকে হতবিহম্বল করে দিলো । আমার মুখ দিয়ে উহু একটা শব্দ বের হয়ে এলো । এসআই আমাকে ধরে কাউন্টারের সামনে নিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলেন । আমি এসআইয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, কিভাবে ?
সেটাইতো আমরা জানতে চেস্টা করছি । তবে প্রার্থমিক ভাবে মনে হচ্ছে পেছন থেকে কেউ খুব জোড়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে । তারপর কি একটা চিন্তা করে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনিও তো দোতালাতেই থাকেন , তাই না ?”
আমি মাথা নাড়ালাম , হা ।
বদরুল সাহেবের সঙ্গে আপনার কখন শেষ দেখা হয়েছে ?
গতকাল রাতে ।
কখন ?
রাত ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে । আমি এসআইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম ।
কি নিয়ে কথা হয়েছে ?
আমার কিছু বিষয় জানার ছিল তাই বদরুলের কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলাম ।
কি জানতে চেয়েছিলেন, তা কি আমি জানতে পারি ?
আমার গতরাতে দেখা সদুভাই এর মুখটা মনে পরে গেল । আমি কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললাম, পারেন ।
তা হলে বলে ফেলুন । দয়া করে মিথ্যা কিছু বলবেন না ।
অনেকেই নাকি সদু ভাইকে মেসের এখানে সেখানে ঘুরে বড়োতে দেখেছে । আমার কাছে মনে হচ্ছিল ব্যাপারটা বানোয়াট । তাই বদরুলকে ডেকে নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম আসলে ব্যাপারটা কি ?
তা, কি জানতে পারলেন ?
বদরুলও বলল ও নিজেও নাকি সদু ভাইকে দেখেছে ।
কবে , কোথায় দেখেছে ? এসআই অত্যান্ত শান্তু সুরে জিজ্ঞাসা করলেন ।
সদু ভাইয়ের মৃর্ত্যুর দু’দিন পরে । তার রুমে ।
এসব মিথ্যে কথা । যতোসব গাল গপ্প । একজন মৃর্ত মানুষ কি করে দেখা দেয় ?
আমিও প্রথমে তাই ই মনে করেছিলাম কিন্তু ব্যাপারটা আসলেই সত্য ……আমি গতরাতে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা বলতে গিয়েও থেমে গেলাম ।
কি সত্যি ? সদু সাহেবকে দেখার ব্যাপারটা ?
জ্বি ।
আপনার মতো একজন শিক্ষিত মানুষ বলছেন এ কথা ?
জ্বি, কেননা কেননা আমিও গতরাতে সদু ভাইকে দেখেছি । আমি এসআইকে সদু ভাইকে দেখার পুরো ঘটনাটা খুলে বললাম ।
সব শুনে এসআই সাহেব বললেন, এ্যস্ট্রেন্জ । এতো দেখছি সত্যিই ভৌতিক ব্যাপার । আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকলাম ।
মেসে পরপর দু’টো মৃর্ত্য ঘটায় পুরো শহরে হৈ চৈ পরে গেছে । প্রতিদিন অনেক লোক আসছে মেসটাকে দেখতে । পরের দিন সবকটি জাতীয় পত্রিকায় লাল কালিতে বড় বড় করে ছবি সহ হেডলাইন ছাপা হলো, “মেস মালিকের আত্মহত্যার পর এবার কর্মচারীর রহস্যজনক মৃর্ত্যু । এলাকা বাসি বলছে, ভৌতিক ঘটনা ”।
অন্য একটা পত্রিকায় ছাপা হয়েছ, “পুলিশের নাকের ডোগায় ঘটে চলেছ একের পর এক ভৌতিক হত্যাকান্ড, তবুও পুলিশ রহস্যের কোন কূল কিনারা করতে পারছে না । মেসের লোকজন বলছে, ভূতুরে কান্ড।”
মেসের উঠানের মাঝখানে বিশাল একটা আম আছে । যার গোরাটা গোল করে বাঁধানো । দু’জন পুলিশ পালা করে সেখানে বসতে শুরু করেছে । আমি মনে মনে ঠিক করে ফেলেছি মেস ছেড়ে দেবো । এহতে সামস্ সাহেবের সঙ্গে এর মধ্যে দু’দিন ফোনে কথা হয়েছে । তিনি স্বাভাবিক খোজ খবর নিয়ে আরেক জন পরিচালকের খোঁজ দিয়ে বলেছেন, তিনি নাকি একটা ভাল চিত্রনাট্য খুঁজছেন । তিনি ঐ পরিচালকে আমার কথা বলে ঠিকানা দিয়ে দিয়েছেন , ভদ্রলোক যে কোন দিন আসবেন আমার সঙ্গে দেখা করতে । নিজের ভাগ্যের এ পরিবর্তনে আমি আনন্দিত হবার পরিবর্তে ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছি । বারংবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে, সেই হলুদ দুটো চোখ, আর বিশ্রী মুখের হাসি ।
সদু ভাইকে দেখার পর থেকে আমার চারপাশে অদ্ভূত সব ব্যাপার ঘটছে । প্রায় রাতেই বারান্দায় কারো পায়ের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে । মাঝে মাঝে ঘরের মধ্যেও কার যেন উপস্থিতি টের পাচ্ছি । লেখালেখি নিয়েও চলছে তুগলগি কারবার । কোন একটি কাহিনী চিন্তা করে লেখা শুরু করলেই প্রচন্ড ঘুম পেয়ে যায়, আর তখন লিখতে লিখতেই ঘুমিয়ে পরি । সকালে উঠে নিজেকে হয় বিছানায় নয়তো মেঝেতে আবিস্কার করি । সব চেয়ে আশ্চর্য্যের বিষয় হচ্ছে, যে লেখাটা লিখতে শুরু করে ছিলাম সেটা পুরোপুরি শেষ করা অবস্থায় পাই । একরাতে একটা কাহিনী শেষ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় । কিন্তু হাতের লেখা হুবুহু আমার। আমার লেখাতে এমনিতে অনেক কাটাছেড়া হয় । কিন্তু এ লেখাগুলো একেবারে নিক্ষুত । এ রকম অদ্ভুত ঘটনায় আমি বেশ বিচলিত হয়ে উঠেছি ।
গভীর রাতের দিকে মাঝে মাঝে মনে হয় সদু ভাইয়ের রুম থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসে। খুবই করুন সে কান্নার শব্দ। আমি ভয়ে আর দরজা খুলি না । তার উপড় আবার ক্ষুধা মন্দা দেখা দিয়েছে । স্বাস্থ্য দ্রুত খারাপ হয়ে যাচ্ছে । আয়নার সামনে দাঁড়ালে বেশ বুঝতে পারি চোখ মুখ ভেতরে বসে যাচ্ছে । কোন কিছু খেতে ভাল লাগে না । ক্যামন জানি সব সময় একটা অস্থির ভাব কাজ করে। কোন কাজই মন দিয়ে করতে পারছি না। একটার পর একটা সিগারেট টেনে চলি । কোন কোন রাতে দেখা যায় জ্বলন্ত সিগারেট হাতে নিয়েই ঘুমিয়ে পরছি ।
ছয়
ইতি নামের একটা মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে । এহতে সামস্ সাহেব আমার যে কাহিনীটা নিয়ে ছবি বানাবে সেটার নায়িকা । আমার কাছে পাঠিয়েছেন ওর চরিত্রটি ভাল ভাবে বুঝিয়ে দেবার জন্য । আনার্স পড়ছে । মেয়েটা একবার এলে আর সহজে উঠতে চায় না । ঘরদোর নিজের মতো করে গুজগাছ করে ফেলে । ছোটবেলা থেকেই আমি নারী সঙ্গ বঞ্চিত । এখনও বুঝতে পারিনা মেয়েদের সঙ্গে ঠিক কিভাবে কথা বলতে হয়,মিশতে হয় । মেয়েটাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেও কোন লাভ হয়নি । একেবারে নাছোড়বান্দা । প্রথম প্রথম ভেবেছিলাম ওর চরিত্রটা বুঝিয়ে দিলেই কেটে পরবে । কিন্তু সেটা নিয়ে ওর সঙ্গে একদিনও বসতে পারিনি । আমি যখনই বলেছি চলো তোমার চরিত্রটি বুঝিয়ে দেই, তখনি ও বলেছে, রাখেন তো , আপনি তো আর উড়ে যাচ্ছেন না, পরেও এ নিয়ে বসা যাবে । চরিত্রটি বুঝে নেবার কোন আগ্রহ মেয়েটার মধ্যে আছে বলেও মনে হয় না । ওর ভাষায় কাহেনীকারকে বুঝতে পারলে নাকি অতি সহজেই তার রচিত যে,কোন চরিত্রের মধ্যে প্রবেশ করা যায়। তাই ও এখন আমাকে বোঝার চেস্টা করছে ।
আমার বর্তমান অসস্থা দেখে ইতি একদিন এসআইকে ফরহাদকে ডেকে নিয়ে আসল । আমি তাকে এক এক করে সব খুলে বললাম । এফডিসির সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোও বাদ গেল না । এসআই ফরহাদ আমার সদ্য সমাপ্ত চিত্রনাট্যটি যেটার শুরুটা করেছি আমি আর বাকিটা করেছে অন্য কেউ, নেড়েচেড়ে দেখে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন । তারপর একদিন বিকেল বেলা এসে বললেন, রন্জু সাহেব এটা আমি পরপর তিনজন হ্যান্ড রাইটিং এক্সাপাট কে দিয়ে পরীক্ষা করিয়েছি, এবং তারা সবাই মোটামুটি একই কথা বলেছে, যে এটা একই হাতের লেখা । সুতারাং আপনার এ কথাটা ঠিক নয় যে এ পুরোটা আপনি লিখেননি । আমি কিছুতেই আর তাকে বিশ্বাস করাতে পারলাম না যে, লেখাটি আমি শেষ করিনি । উল্টো এসআই আমাকে উপদেশ দিয়ে বললেন, কোথাও থেকে সপ্তাহ খানেক ঘুরে আসুন, দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে । সত্যি বলতে কি, আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আপনার উপড়ে বেশ চাপ ফেলেছে । কোথাও থেকে ঘুরে আসলে মাথাটা ক্লিয়ার হয়ে যাবে তখন দেখবেন আর এমন মনে হবে না ।
আমি ইতির অনুরোধে এসআইয়ের কথা মতো কক্সবাজার থেকে ঘুরে এলাম । কিন্তু তাতে সমস্যার কোন হেরফের হলো না। বরং নতুন এক উপদ্রোপের উপস্থিতি টের পেলাম । তা হলো, সারাক্ষন মাথার ভেতর ক্যামন সমুদ্রের গর্জন শুনতে পাই। চোখ বন্ধ করলেই মনে হয়, আমি সমুদ্রের মধ্যে পরে গেছি আর চারিদিক থেকে রাশি রাশি জল এসে আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ।
দিনের পর দিন আমার সমস্যা আরো বাড়তে থাকায় ইতি একদিন আমাকে পরানো ঢাকায় ওর এক স্যারের বাসায় নিয়ে গেল । ভদ্রলোক একজন সাইকিয়াটিস্ট । নাম মোস্তফা মল্লিক। শরীরের গরন হালকা পাতলা। ঠোটের উপর মস্ত একজোড়া গোফ। দু’গালে কয়েক দিনের না কাটা দাঁড়িতে ভদ্রলোককে দেখলে মনে হয় না তিনি একজন সাইকিয়াটিস্ট বা মনোবিজ্ঞানি । মধ্যবয়স্ক শরীরটা ধনুকের মতো সোজা, মাথার চুল সব এলোমেলো। দেখলে যাযাবর বলে মনে হয় । আমরা রিকশায় থাকতেই প্রচন্ড ঝড় হলো । পরিস্কার আকাশ বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ আকাশ কালো করে ঝড় শুরু হলো। আমরা যখন পৌছালাম তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে । পুরো এলাকায় বিদ্যূত নেই । অনেকক্ষন দরজায় কড়া নাড়ার পর কালো রঙের লুঙ্গি পরা উদম শরীরে মোস্তফা মল্লিক সাহেব দরজা খুলে দিয়ে ইতিকে দেখে বলে উঠলেন, ও তুমি । রান্না ঘরে ছিলাম তো তাই দেরি হয়ে গেছে । তারপর আমার দিকে তাকিয়েই যেন থমকে গেলেন । যেন আমি মস্ত কোন অপকর্ম করে এসেছি এমন করে পলকহীন ভাবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি প্রচন্ড রকমের অসুস্থিতে পরে গেলাম । একজন মানুষের দৃস্টি অন্য একজন মানুষের কাছে যে কি পরিমানে অসুস্থিকর হতে পারে তা হারে হারে টের পেলাম । একসময় মনে হলো, ভদ্রলোকের দৃস্টি আমার অস্থি মজ্জা ভেদ করে শরীরের রন্দে রন্দে পৌছে যাচ্ছে । হঠাৎ করে আমার ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করলো । মনে হলো, এ লোকের কাছ থেকে যতো দ্রুত পালিয়ে যাবো ততোই মঙ্গল । আমি ইতির দিকে তাকিয়ে চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়ে কোন রকম বললাম; ইতি চলো ।
ঠিক তখনি ভদ্রলোক খুব দ্রুত ছোবল মারার মতো খপ করে থাবা দিয়ে আমার ডান হাতটা ধরে ফেললেন, তারপর অত্যান্ত শান্ত কণ্ঠে বললেন, “ ভেতরে আসো, এখানে তোমার কোন ভয় নেই । তুমি ঠিক জায়গাতেই এসেছো ”।
মল্লিক সাহেব আমার হাত ধরে ভেতরের নিয়ে গেলেন । দরজা বন্ধ করা একটা ঘরের সামনে নিয়ে এসে তার অন্য হাতটা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলে ফেললেন । দ্রুত ঘরের ভেতর ঢুকে আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে বিছানাটা দেখিয়ে বললেন, ওখানে বস। আমি পুরো ঘরটার দিকে একবার তাকালাম , ঘরটা বলতে গেলে একেবারে আসবারপত্র শুন্য । এক কর্নারে মাটিতে জাজিম আর তোশক দিয়ে একটা বিছানা পাতা । তাতে কালো রং একটা চাদর আর দুটো বালিশ দেওয়া । তারপাশেই বড় একটা কাঠের আলমিরা দাঁড় করানো । ঘরের ঠিক মাঝখানে সাদা রং দিয়ে বড় একটা বৃত্ত আঁকা । বৃত্তের ভেতর হিজিবিজি করে আরো অনেক কিছুর ছবি আঁকা । ঘরের জানালাগুলো সব ভেতর থেকে বন্ধ । তবুও ঘরটার ভেতরে ভেতর পা দিতেই আমার মনে হলো, আমি যেন ফ্রিজের ভেতর প্রবেশ করেছি । হঠাৎ তীব্র শীতে আমার পুরো শরীর কেঁপে কেঁপে উঠল । আমি উহু করে কুঁকড়ে যাবার ভঙ্গি করলাম । লোকটা তখন দরজার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা ইতির দিকে তাকিয়ে বললেন, যা তো মা, বেডরুম থেকে একটা চাঁদর এনে ওকে দে। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভদ্রলোক আমার দু’হাত ধরে বিছানায় নিয়ে গিয়ে বলল, এখানে বসো । আমার নাম মোস্তফা মল্লিক । আমি ইতির কলেজে মনোবিজ্ঞান পড়াই । আমার কাছে তোমার কোন ভয় নেই । তুমি এখানে নিশ্চিন্তে থাকো । সব ঠিক হয়ে যাবে ।
ইতি একটা চাঁদর এনে আমার শরীরে পেচিয়ে দিল । ততোক্ষনে ঠকঠক করে আমার দাঁতের সঙ্গে দাঁতে বারি খাচ্ছে । মৌল্লিক সাহেব ইতির দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর কাকি গ্রামের বাড়িতে গেছে । আমি রান্না বসিয়েছি । তুই রান্নাটা দেখ। আমি ওকে নিয়ে বসছি । ওর অবস্থা ভাল না । এতোটা খারাপ আশা করিনি । আরো আগে নিয়ে আসা উচিত ছিল । হঠাৎ ইতির পেছনে আমার চোখ যেতেই আমি চমকে উঠলাম । কেননা ইতির পেছনে দাঁড়িয়ে আছে এফডিসির সামনে দাঁড়ানো সেই লোকটা । চোখ দুটো থেকে যেন আগুন বের হচ্ছে । লোকটা তীব্র ভয়ন্কর দৃস্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । মনে হচ্ছে, এখানে আসার জন্য সে আমার উপড় চরম অসুন্তস্ট । সুযোগে পেলেই আমাকে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। আমি লোকটার থেকে চোখ সরিয়ে নিতে পারলাম না । বড় বড় দৃস্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে মুখ দিয়ে গোৎ গোৎ শব্দ করতে করতে কাঁপতে লাগলাম । ইতি আমার এমন আচড়নে ভয় পেয়ে গেল । দৌড়ে এসে আমার দু’কাধ ধরে ঝাকাতে ঝাকাতে বলল, রন্জু ভাই, এ্যই রঞ্জু ভাই, কি হয়েছে ? কি হয়েছে আপনার ? আমি একটা আঙুল তুলে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে দেখালাম । কুৎসিত লোকটার দৃস্টির কোন পরিবর্তন হয়নি । সেই একই দৃস্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । মল্লিক সাহেব আমার আঙুল বরাবর তাকিয়ে কি দেখলেন বুঝলাম না । সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছুটে গেলের আলমিরার কাছে, একটানে আলমিরাটার খুলে তার ভেতর থেকে একটা শিশি বের করে ভেতরে থাকা একটা তরল পদার্থ ছুরে দিলেন দরজার বাইরে । সঙ্গে সঙ্গে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার শরীর মুচড়ে উঠল । এবং সাথে সাথে মিলিয়ে গেল । মৌল্লিক সাহেব আমার শরীরে শিশিটা থেকে কয়েক ফোঁটা তরল পদার্থ ছুড়ে মারলেন । আতরের সুগন্ধিতে পুরো ঘর যেন মৌ মৌ করে উঠল । হঠাৎ শীতটা চলে গেল আমি আরাম বোধ করায় বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে পরলাম ।
মল্লিক সাহেব ইতির দিকে তাকিয়ে বললেন, ও এখন ঘুমাবে । আমার কিছু জরুরী কাজ এর মধ্যে সেরে নিতে হবে । তুমি রান্না ঘরে গিয়ে গরম পানি বসাও ।
সাত
স্বপ্নে কুচকুচে কালো বিষাক্ত একটা সাপ দেখে প্রচন্ড ভয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেল । দেখলাম; দীর্ঘ একটা সাপ আমার ঘরের মেঝেতে কুন্ডুলি পাকিয়ে ফর্ণা তুলে বসে আছে ছোবল মারার জন্য। আমি হাত পা গুটিয়ে বিছানায় বসে চিৎকার করছি । সাপটা আমার দিকে তাকিয়ে তার লম্বা কালো কুচকুচে জ্বিবটা বারংবার বের করছে আর ভেতরে নিচ্ছে । সাপটা আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমাকে নড়াচড়া করতে না দেখে যেন অস্থির হয়ে উঠল । তারপর খুব ধীরেধীরে বিছানা বেয়ে উঠতে উঠতে আমার মুখে বিষ ছুড়ে মারল । প্রচন্ড আতন্কে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল । আমি লাফ দিয়ে উঠে বসলাম ।
চোখ খুলে বুঝতে বেশ কস্ট হলো আমি কোথায় আছি । ঘরে অল্প আলোর একটা বাতি জ্বলছে । দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ । হঠাৎ মনে পরে গেল সব । আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে ইতিকে খুঁজতে লাগলাম । ঘরের মেঝেতে আঁকা বৃত্তটার মধ্যে গোল হয়ে তিনজন লোক আসন ঘেরে অনেকটা ধ্যানের ভঙ্গিতে বসে আছে । সবার হাটুর উপর দু’হাত রাখা ।
একজন বিরবির করে কিছু একটা মন্ত্র পড়ছে আর পাশে রাখা একটা বোতল থেকে পানি জাতীয় কিছু একটা একটু পর পর ছিটিয়ে দিচ্ছে । ভাল করে তাকাতেই মল্লিক সাহেবকে চিনতে পারলাম । আমাকে উঠে বসতে দেখে মল্লিক সাহেব আমার দিকে একটা হাত বারিয়ে দিয়ে বললেন, এসো, আমার কাছে এসো । আমি কি করবো বুঝতে পারলাম না । হঠাৎ মনে হলো, মাথার ভেতটা ক্যামন শূণ্য হয়ে গেছে । আমি আমার অতীত,বর্তমান কিছুই মনে করতে পারছি না। মাথার ভেতরে ভোতা একটা যন্ত্রনা হচ্ছে । আমি আবারও ইতিকে দেখার জন্য এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম । মল্লিক সাহেব আবার ডাকতেই আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, পানি খাব। তিনি তার সামনে বসা একজনের দিকে তাকাতেই লোকটা উঠে এক গ্লাস পানি এনে দিল । আমি পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে চমকে উঠে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগলাম । আমার কাছে মনে হলো লোকটা এক গ্লাস তাজা রক্ত আমার হাতে দিল । এবার মল্লিক সাহেব উঠে এসে আমার হাত ধরে আমাকে বৃত্তের মাঝে নিয়ে বসিয়ে দিয়ে বললেন, তোমার কোন ভয় নেই । তোমার ভালর জন্যই আমরা এসব করছি। তারপর একটু থেমে আমাকে ভালকরে দেখে নিয়ে বললেন, রন্জু তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছো ? মল্লিক সাহেব কয়েকবার জিজ্ঞেস করার পর আমার মনে হলো আমি মাথা নাড়ালাম যে, হ্যা আমি ওনার কথা বুঝতে পারছি ।
গুড, এখন আমি তোমাকে কয়েটা কথা বলবো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবে । আমি আবারও মাথা নাড়ালাম । মল্লিক সাহেব কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে লাগলেন, আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত পার্থিব অপার্থিব অনেক আত্মা ঘুরে বেড়ায় । তাদের মধ্যে কোনটা ভাল আবার কোনটা খারাপ । আমাদের জীবনে তাদের কোন ভূমিকা না থাকলেও কখনও সখনও আমাদের উপড় কিছু খারাপ আত্মাদের দৃস্টি পরে । তখন তারা আমাদের ক্ষতি করার চেস্টা করে । তোমার উপরেও ঠিক তেমনি একটি আত্মার দৃস্টি পরেছে । সে এখন তোমার চারপাশের সবকিছু বিনিস্ট করে চলেছে । মাঝে মাঝে তুমি তাকে দেখতে পাও । ভয়ন্কর সে আত্মা তোমাকে এখন মৃর্ত্যুর খুব কাছা কাছি নিয়ে এসেছে ।
রন্জু, তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছো ?
আমি ঘন ঘন মাথা নাড়লাম হ্যা, আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি । সঙ্গে সঙ্গে সেই ভয়াল চোখ দু’টোর কথা আমার মনে পরে গেল । আমি ভয়ার্ত চোখে বন্ধ দরজাটার দিকে তাকালাম । আমাকে কেপে উঠতে দেখে মল্লিক সাহেব আমার কাধে একটা হাত রেখে আবারও বলতে লাগলেন, আমরা এখানে উপস্থিত হয়েছি তোমার জন্য । তোমার কাছ থেকে সে অশুভ আত্মাকে তাড়িয়ে দিতে । তোমার সাহায়্য দরকার । তুমি কি আমাদের সহায়তা করবে ? আমি আবারও মাথা নাড়লাম, হ্যা আমি সহায়তা করবো ।
তোমার সঙ্গে অশুভ আত্মাটা আছে সে তৈরি হচ্ছে তোমার উপড় চুড়ান্ত আঘাত হানার জন্য । যে কোন সময় সে তোমার উপড় আঘাত হানবে । তবে তোমার ভয় নেই । আমরা আছি । তোমার হয়ে এখন আমরা তার মোকাবেলা করবো । আর এর জন্য চাই তোমার সাহস এবং সহযোগীতা ।
আমি রাজি কি করতে হবে বলুন, আমি অনেকটা ধাতস্ত হয়ে মল্লিক সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললাম ।
আমি যা বলব তা হুবুহু পালন করে যাবে । কিছুতেই এ বৃত্ত থেকে আমার নির্দেশ ছাড়া বের হবে না । মনে রাখবে বৃত্ত থেকে বের হওয়া মনেই হচ্ছে তোমার মৃত্যু । মনে থাকবে আমার কথা ?
জ্বি মনে থাকবে ,বলে আমি মাথা নাড়ালাম ।
আত্মাটা তোমাকে অনেক প্রলভন দেখাবে, আকুতি মিনতি করবে ভয় দেখাবে,তোমাকে এ বৃত্ত থেকে বের করে নিতে চাইবে কিন্তু তুমি ভয় পাবে না । বৃত্ত থেকে কিছুতেই বের হবেনা । বুঝতে পেরেছো ? হঠাৎ আমার মনে পরলো ইতির কথা, আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইতি কোথায় ? মল্লিক সাহেবকে মনে হলো একটু হাসলেন । তারপর আস্তে করে বললেন, ও বাসায় চলে গেছে । ওকে নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না । ও ভাল আছে । আমি খুব শান্ত ভাবে মাথা নাড়লাম । তারপর কি মনে করে মল্লিক সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললাম, ঐ আত্মাটা যদি ওকেও মেরে ফেলে ?
না, সে ভয় নেই । ইতি জানে কি ভাবে নিজেকে রক্ষা করতে হয় । তুমি এ পানিটুকু খেয়ে চোখ বন্ধ করে থাকো । মল্লিক সাহেব ছোট একটা বোতল আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলেন । আমি বোতলটা হাতে নিয়ে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে বোতলটা ফেরত দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। মল্লিক সাহেব আবার ও মন্ত্র পড়তে শুরু করলেন । এভাবে অনেকক্ষন কেটে গেল । আমার কাছে মনে হলো আমি অনাধী অনন্ত কাল এভাবে বসে আছি । একসময় হঠাৎ মনে হলো,এসব আমি কি করছি ? কাদের পাল্লায় পরলাম । আমি উঠে যাবার জন্য ছটফট করতে লাগলাম । ঠিক সে সময়ই তীব্র শীতে আমার শরীর আবারও কেঁপে উঠল । আমি চোখ খুলে দেখি বৃত্তটার মাঝখানে মাত্র একটা মোম বাতি জ্বলছে । দরজাটা হাট করে খোলা । দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সেই ভয়াল লোকটা । চোখ দু,টো থেকে আগের মতো আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে । আমি তাকাতেই আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, তুই এখানে ? উঠে আয় উঠে আয় বলছি । মল্লিক সাহেব আমার একটা হাত চেপে ধরে বললেন, ভয় পেয়ো না । ও এ বৃত্তর মধ্যে আসতে পারবে না । আমি লোকটার উপড় থেকে চোখ সরাতে পারলাম না । লোকটা মুখ বিকৃত করে বলল, ভুলে গেছিস সওদার কথা ? আয়, চলে আয় বলছি । হঠাৎ মল্লিক সাহেব বলে উঠলেন, যা ভাগ,ভাগ এখান থেকে । দূর হয়ে যা শয়তান ।
তুই, শয়তান, তুই দূর হয়ে যা । তুই মর । আমি তোর মাথা চিবিয়ে খাবো । দরজার কাছে দাঁড়ানো লোকটা ভয়ন্কর ভাবে বলে উঠল । মল্লিক সাহেব কিছু না বলে আরো জোড়ে জোড়ে মন্ত্র পড়তে লাগলেন । লোকট চলে যাবার পরিবর্তে বাতাসে ভেসে ঘরের ভেতর চলে এলো । তারপর বৃত্তটাকে এক নজর দেখে বিকট ভাবে হেসে উঠে বলল, ভেবেছিস এটা তোদের রক্ষা করবে ? আয় আমার দলে যোগ দে , আমি তোদের তামাম পৃথিবী দিয়ে দেবো। আয় আমার কাছে আয় । আমার কাছে সব আছে নিয়ে নে । নিয়ে নে । বলে লোকটা আবারও হাসতে লাগল । আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম । মনে হলো, উঠে এক দৌড়ৈ ঘর থেকে বের হয়ে যাই । মল্লিক সাহেব আমার মনোভাব বুঝতে পেরে আবারও আমার হাত চেপে ধরে বললেন, ভয় নেই , ওকে ভয় পাবার কিছু নেই । ও আমাদের একটা চুলও বাঁকা করতে পারবেনা ।
তাহলে দেখ, আমি কি পারি । বলেই লোকটা বৃত্তের ভেতর ঢুকার জন্য এগিয়ে এলো এবং বৃত্তের উপড় পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে পেছনে পরে গেল । এবার মল্লিক সাহেব হেসে উঠে বললেন, দেখলি দেখলি তোর দৌড় কতোখানি দেখলি ?
লোকটা কয়েক মূহুর্ত মাটিতে থম মেরে বসে রইল, তারপর হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বা: বেশ জাল পেতেছিস তো ? বলার সঙ্গে সঙ্গে লোকটার আকৃতি পরিবর্তন হয়ে গেলো, লোকটা মুর্হুত্যের মধ্যে সদু ভাইয়ের রুপ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে পরিস্কার শুদ্ব ভায়ায় বলে উঠল, কি রাইটার সাব, আমার সঙ্গে আসবা না । আস; উঠে আস বলছি । এরা তোমাকে মেরে ফেলবে আসো চলে আস । বলে সদু ভাই দু’হাত বাড়ালেন । আমি মল্লিক সাহেবের দিকে তাকালাম। তিনি বোতল থেকে পানি ছুড়ে মারলেন । সঙ্গে সঙ্গে সদু ভাই গুমরে কেদে উঠলেন । তারপর কান্না থামিয়ে গালাগালি করতে লাগলেন । আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম । হঠাৎ ইতির কন্ঠ শুনে চোখ খুললাম । দরজাটা বাহীর থেকে ইতি ভেতরে ঢোকার জন্য দরজাটা প্রচন্ড জোরে ধাক্কাচ্চে আর বলছে, রঞ্জু ভাই দরজা খুলুন, এ্যই রঞ্জু ভাই দরজাটা খুলুন না । কোথাও সদু ভাই কিংবা লোকটাকে দেখতে পেলাম না । আমি দরজা খোলার জন্য উঠতে যাচ্ছিলাম, মল্লিক সাহেব আমার হাত চেপে ধরে বললেন, ওটা ইতি না । তুমি এখানেই বসে থাকো । আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম , মল্লিক সাহেব আমার কানরে কাছে মুখ এনে বললেন , ওটা ইতি না । ইতি ভাল আছে ।
না , ওটা ইতির গলা দয়া করে ওকে ভেতরে আসতে দিন । শয়তানটা ওকে মেরে ফেলবে । আমি হাত ঝাড়া দিয়ে মল্লিক সাহেবের হাতটা ছাড়িয়ে দরজার কাছে ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। দরজায় ইতি দাড়িয়ে আছে । আমাকে দরজা খুলতে দেখেই হেসে বলল, আমার প্রিয়, আমি জানতাম তুমি আমার ডাকে সারা দেবে । এসো আমার সঙ্গে । বলে, ইতি আমার একটা হাত ধরল । আমার কাছে মনে হলো, আমার হাতে কেউ আগুনের ছেকা দিয়েছে আমি আঁতকে উঠে পিছিয়ে গেলাম । ইতি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কি হলো ? ভয় পেয়েছো ? এসো এসো আমার সঙ্গে । আমি দু’পা পিছিয়ে এলাম । হঠাৎ আমার মনে হলো, এটা ইতি না । সেই লোকটা । আমি মল্লিক সাহেবের কাছে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই আমার গলাটা প্রচন্ড জোড়ে চেপে ধরল ইতি । আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল । আমি দু’চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম । এমন সময় পেছেন থেকে মল্লিক সাহেব পানি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে এসে বললেন, ছাড় ছাড় বলছি । ছেড়ে দে শয়তান । ছেড়ে দে ।
মুহুর্তে ইতির রুপ পরিবর্তন হয়ে গেল । আবার সেই আগের রুপ ধরে লোকটা আমাকে ছেড়ে দিয়ে মল্লিক সাহেবের দিকে ছুটে গেল । বৃত্তের ভেতরে থাকা লোক দুটো আমাকে টেনে বৃত্তের ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিয়ে । লোকটা মল্লিক সাহেবকে মাটিতে ফেলে তার বুকের উপড় চেপে বসেছে । আমাকে বৃত্তের ভেতর বসিয়ে দিয়েই লোক দু’জন হাতে দুটো লম্বা শাবল জাতীয় কিছু নিয়ে পেছন থেকে মল্লিক সাহেবর উপড় বসে থাকা লোকটা পিঠে ঢুকিয়ে দিল । তারপর টান দিয়ে মাটিতে ফেলে শাবল দিয়ে মাটির সঙ্গে চেপে রাখল । মল্লিক সাহেব চোখের পলক উঠে বসে হাতের বোতলের পুরো পানিটা লোকটার শরীরের উড়র ছিটিয়ে দিতে দিতে মন্ত্র পড়তে লাগলেন । আমি নিজের অজান্তেই আল্লাহু আকবর , আল্লাহু আকবর; বলে চিৎকার করতে করতে উঠে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরলাম ।
—- মুহম্মদ সাখাওয়াত হোসেন
খুব দ্রুত জামাটা গায় দিয়ে আমি তৈরি হয়ে নিলাম । দেয়ালে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় সাড়ে ন’টা বাজে । দেরি হয়ে গেছে । ইদানিং কোন কাজই সময় মতো করতে পারছিনা। সব কাজে কোন না কোন কারণে দেরি হয়ে যায় । বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ সব কাজগুলো । সাড়ে দশটার মধ্যে এফডিসিতে পৌছতে হবে । অনেক ধরাধরির পর বিখ্যাত পরিচালক এহতে সামস্ সময় দিয়েছেন, তাও আবার পাঁচ মিনিট । মানুষের সময়ের মূল্য যে কতো, তা এ সব বিখ্যাত মানুষগুলোকে না দেখলে বোঝা যায় না। এই পাঁচ মিনিট সময়ের মধ্যে তাকে পুরো চিত্র নাট্যটি বোঝাতে হবে । যদি তার পছন্দ হয়, তা হলে তিনি তার পরবর্তি ছবির জন্য আমার লেখাটি নেবেন ।
এটাই কোন পরিচালকের সঙ্গে আমার চিত্রনাট্য নিয়ে প্রথম সাক্ষাত নয় । এর আগেও অসংখ্য বার অসংখ্য পরিচালক আমার চিত্রনাট্য দেখেছেন । এবং প্রতিবারই আমি প্রত্যাক্ষিত হয়ে যন্ত্রনার শেষ সীমায় পৌছে পার মাতাল হয়ে মেসে ফিরেছি । বাংলা সিনামায় চাকবুম চাকবুম বিষয় না থাকলে ঠিক জমে না । অথচ আমি সেই চাকবুম চাকবুম জিনিষটাকে আমার চিত্রনাট্য থেকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে দিয়েছি । চিত্রনাট্য নেড়ে চেড়ে সিগারেটের পেছনে দম দিতে দিতে এক এক জন বলছেন, “মিয়া নাচ-গান নাই এইটা কোন সিনামা হইলো ? নাচে গানে ভরপুর কিছু নিয়া আস, পার্বলিক নায়িকার উত্তাল নাচ দেখতে চায় । নায়িকারে বৃস্টিতে ভিজাও পানিতে চুবাও , প্রয়োজনে বন জঙ্গলে নিয়া হাটুর উপড়ে সাপের কামড় খাওয়াও তা হইলেই না সিনামা হিট হইবো ”। আমি নায়িকারে বৃস্টিতেও ভিজাতে পারছিনা আবার পানিতেও চুবাতে পারছি না । না পারছি হাটুর উপড় সাপের কামড় খাওয়াইতে । তাই কোন পরিচালক আমার চিত্রনাট্য গিলছে না । কাজেই প্রত্যাক্ষিত হয়ে মাতাল হয়ে পরিচালকদের চৌদ্দগোস্টিকে গালিগালাজ করে মেসে ফেরা ছাড়া আমার কোন উপায় নাই ।
মধুমিতা মেসের মালিক সদু ভাই আমাকে বিশেষ ভালবাসেন বিধায় ঐ অবস্থায় আমি মেসে ফিরতে পারি । তা না হলে যে কি হতো কে জানে । তা ছাড়া এ জগতের মানুষের এ অভ্যাসটাকে লোকে অনেকটা মেনে নিয়েছে ।
আজও হয়তো ভাংঙ্গা মন নিয়ে মাতাল হয়ে আমাকে গভীর রাত্রিরে মেসে ফিরতে হবে । যতোটা উৎসাহ নিয়ে যাচ্ছি; হয়তো তার চাইতেই ঢের বেশি মনকষ্ট নিয়ে ফিরে আসবো । তাই বলে হাল ছেড়ে দেবার পাত্র আমি নই । একবার না পারিলে দেখ শতবার নীতিতে বিশ্বাস রেখে এগিয়ে চলেছি ।
টেবিলের উপরে রাখা ব্যাগটা আরেকবার পরীক্ষা করে নিলাম । লেখাটি ঠিক মতো আছে কিনা । গত রাতে পুরো চিত্রনাট্যটি বেশ কয়েকটি জায়গায় কাটাছেড়া করেছি। পরে ফ্রেশ করে নেওয়া যাবে । এখন সময় নেই । আলমারি খুলে এ মাসের বেতনের শেষ পাঁচশ টাকার নোটটা বের করে মানিব্যাগে নিলাম। মাসের বাকি এখন ও দশ দিন । বাকি দিনগুলো কিভাবে কাটবে কে জানে ।
দরজায় তালা দিয়ে । সিড়ি দিয়ে নীচে নামতেই কাউন্টারের সামনে দেখি সদু ভাই দাঁড়িয়ে কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলছেন । খুব সম্ভব এরা মেসের বাবুচি হবে । আমাকে সিঁড়ি দিয়ে তারাহুরো করে নামতে দেখে সদু ভাই আমার দিকে একবার তাকিয়ে-কাউন্টারের উপড় রাখা পিক দানিতে পানের পিক ফেলে বললেন, “কি রাইটার সাব , আবারও মনে হয় যাইতাছ ?” আমি একটু থেমে মাথা নেড়ে বললাম , জি সদু ভাই, দোয়া করবেন ?
“তা এইবার কারে দেখাইবা ?”
“এহতে সামস্ ।” আমি ছোট্র করে নামটা বললাম ।
ক ও কি মিঞা ? ঐ ব্যাটা তো হুনছি হিটের পর হিট । ঠিক লোকরেই ধরছো মনে হয় । তোমার দিয়া হইবোই হইবো এইডা আমি কইয়া দিলাম । সদু ভাই এগিয়ে এসে আমার কাঁধে চাপর দিলেন । সঙ্গে সঙ্গে জর্দ্দার কড়া গন্ধ নাক এসে নাকে লাগল । আমি চলে যাবার ভঙি করে, “বললাম, “দোয়া করবেন সদু ভাই ।”
দোয়া তো করমুই, এইডাই তো এখন আমাগো বাংলাদেশে একমাত্র ফ্রি জিনিষ । তা কুনহানে দেহা করবা ওনার লগে ? যাইবা কই ?
এফডিসিতে ?
কও কি ?
জ্বি, ওনার একটা সুটিং আছে. ফাঁকে আমার সঙ্গে কথা বলবেন ।
বা: বেশ ভাল । হাতে সময় থাকলে তোমার লগে যাইতাম । এফডিসির ভেতরটা দেহনের আমার খুব সখ ।
সদু ভাই, আমি তাহলে আসি, দেরি হয়ে যাচ্ছে, হাতে একদম সময় নাই । সাড়ে দশটার মধ্যে পৌছাতে হবে । আমি হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিনয়ের সঙ্গে বললাম ।
আরে তাইলে তো আসলেই সময় নাইকা । এহনতো অফিস টাইম । এখন গাড়ি ঘোড়াও পাওয়া কঠিন; চলো আমার লগে দেহি নাসিরার গ্যারেজে গাড়ি আছে কিনা । আমি চমকে উঠলাম । কেননা সদু ভাই এর সঙ্গে যাওয়া মানে আরেক যন্ত্রনা । দেখা যাবে গাড়ি পেতে পেতেই সাড়ে দশটা বেজে যাবে । আমি তারাতারি না,না করতে করতে বললাম, “আপনাকে কষ্ঠ করতে হবে না সদু ভাই, আমি খুঁজে নিবো ।”
আরে মিঞ খুঁইজা নিবা বললেই হইলো নাকি ? গাড়ি পাইতে হইবো না ? চলো আমার লগে। সদু ভাই তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, রাতের জন্য পোলাও গোস্ত করিস । আজ রাইটার সাহেবের জয় হইবোই হইবো। আমি সদু ভাইয়ের এই স্নেহের কাছে পরাস্ত হয়ে তার পিছু পিছু মেস থেকে বের হয়ে এলাম । বুক চিরে বের হয়ে এলো একটা দীর্ঘশ্বাস ।
নাসিরের গ্যারেজে অতি সহজেই গাড়ি পাওয়া গেল । গ্যারেজের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সদু ভাই বললেন; “চলো আইজকা তুমি সফল হইবা কি হইবা না তার একটা ছোট্র পরীক্ষা কইরা ফেলাই ?
”কিভাবে ? আমি দ্রুত পা ফেলে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করলাম ।
যদি নাসিরার গ্যারেজে যাইয়াই গাড়ি পাইয়া যাই তাইলেই মনে করুম তুমি আজ সফল । ঐ পরিচালক ব্যাটা তোমার বই লইবোই লইবো ।
আমি এসব বিশ্বাস করি না । তাই মুখে কিছু বললাম না । কিন্তু তবুও দেখা গেল সত্যিই গ্যারেজে গাড়ি পাওয়া যায় কিনা সেটা দেখার জন্য মনে মেনে বেশ উৎগ্রীব হয়ে উঠলাম ।
নাসিরের গ্যারেজে ঢুকতেই দেখি, দরজার সামনে একটা সিএনজি দাঁড়িয়ে আছে। সদু ভাই আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ, তুমি জিতা গেছ । যাও, আইজকা তোমারে আর কেউ আটকাইতে পরবোনা কইয়া দিলাম । প্রাথমিক বিজয়ে আমার মনটাও খুশিতে ভরে উঠল ।
গ্যারজের মালিক নাসির একটা ময়লা বিছানার উপড়ে বসে চা খাচ্ছিল, সদু ভাইকে দেখে তারাহুরো করে নেমে এসে সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কিছু লাগবো ভাই ? আমারে খবর পাঠাইলে তো আমিই যাইতাম ।”
তা,তো যাইতিই। এখন দেখ একটা গাড়িটারি আছে কিনা,আমাগো রাইটার সাব এফডিসিতে যাইবো ।
এই সিএনজিতে গেলে হয় না ভাই, নাকি গাড়িই লাগবো ? নাসির আমার দিকে তাকিয়ে দরজার সামনে দাড়িয়ে থাকা সিএনজিটা দেখিয়ে বলল ।
গাড়ি লাগবে না, সিএনজিতে হলেও চলবে । বলে আমি সদুভাইয়ের দিকে তাকালাম ।
তোর ড্রাইবার কই ?
আছে, মনে হয় মুততে গেছে । দাঁড়ান আমি ওরে লইয়া আইতাছি । বলেই নাসির দৌড়ে গ্যারেজের পেছনে চলে গেল ।
নাসিরারা কামডা দেখলা, এইসব পোলাপান হালায় ম্যানার জানে না; তোমার সামনে ক্যামনে কইলো মুততে গেছে । তুমি কিছু মনে কইরো না । আইউক দিমুনে কানের পেছনে দু’ইডা ভনচটকোনা, হালায় পুতে কইবোনা, “বার্থরুমে গেছে । যাও যাও তুমি জিএনজিতে যাইয়া বও । রাইতে তারাতারি আইয়া পইরো পোলাও গোস্ত হইবো কিন্তু ।” আমি মাথা নেড়ে সিএনজিতে উঠে বসলাম । প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সতেরো কি আঠারো বছরের একটা ছেলে এসে , সিএনজি স্ট্যাট দিল ।
সদু ভাই কাছে এসে বলল, এক্কেবারে ঝড়ের বেগে লইয়া যাবি । সময় মতো পৌছাইতে না পারলে কিন্তু ঘারে খাবি । সদু ভাই এর এই বাড়াবারি দৃস্টিকটু, অনেক সময় অসহ্য লাগে। কিন্তু প্রচুর অর্থ কড়ি , উদারতা আর সান শওকতের জন্য সবাই সদু ভাইকে বেশ সমিহ করে চলতে বাধ্য হয় ।
ছেলেটা আমায় সত্যিই ঝড়ের বেগে নিয়ে এলো । আজ সবই দেখি বেশ ভালয় ভালয় হচ্ছে। রাস্তাতে জ্যাম ছিল না বললেই চলে । এফডিসির গেটে বিশাল ভীর । নায়ক নায়িকাকে দেখার জন্য উৎসুক ভক্তদের অভাব নাই । অনেক কষ্টে ভীড় ঠেলে গেটে পৌছে গেট পাস দেখাতেই আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিল ।
১১ নম্বর ফ্লোরে এহতে সামস্ সাহেবের সূটিং চলার কথা । ১১ নম্বরটা কোথায় তা কয়েক জনকে জিজ্ঞাসা করে ১১ পৌছে দেখি বিশাল এক তালা ঝুলছে । গেটের সামনে কয়েকজন গার্ড বসে গল্প করছে । মনটা খারাপ হয়ে গেল । অনেকটা অনিচ্ছা সত্যেও গার্ডদের এহতে সামস্ কথা জিজ্ঞাসা করতেই একজন বলল, স্যার, ইউনিট নিয়ে ১৩ নম্বর গেছে । ঐ হানে যান, ১১ নম্বরের জেনারেটার খারাপ হইছে তাই এইহানে সুটিং বন্ধ । ১৩ নন্বরটা কোন দিকে তা জেনে নিয়ে আমি জোরে পা চালালাম ।
দুই
১৩ নম্বরে পৌছে আমি এহতে সামস্ সাহেবকে সালাম দিলাম । তিনি আমাকে হাতের ইশারায় বসতে বললেন । আমি পেছনে দিকে একটা চেয়ার টেনে বসে পরলাম । এটা সেটা করে পুরো সেট রেডি করতে করতে ২টা বেজে গেল । লাঞ্চের পর সূটিং শুরু হলো । সূটিং মানে এক এলাহিকান্ড । আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে সুটিং দেখতে লাগলাম । এক একটা সট তিন চারবার করে নেওয়া হচ্ছে । যে সটটা আমার কাছে ওকে মনে হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে সেটাই পরিচালক সাহেব কাট করে আবার নতুন করে টেক করছেন । টানা রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত সূটিং চলে প্যাক আপ করা হলো । আমার অবস্থা ততোখনে কাহিল । এতো দীর্ঘ সময় প্রতিক্ষা আমাকে আর কখন ও করতে হয়নি । কয়েকবার মনে হয়েছিল চলে যাবার কথা । কিন্তু নিজের স্বপ্ন , নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে চলে যেতে পারিনি । আর তাছাড়া চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম মানুষটা ব্যস্ত । নিজেকে এই বলে শান্তনা দিয়ে বেধে রেখেছি যে, “কস্ট না করলে, কেস্ট মেলে না ।”
প্রায় পৌনে ১২টার সময় আমার ডাক পরলো । পুরো সেট তখন প্রায় খালি হয়ে গেছে । কয়েকজন সেট থেকে এটা সেটা খুলে ব্যাগে ঢুকাচ্ছে । এহতে সামস সাহেব বেশ রাশ গম্ভীর মানুষ । অপরিচিত জনের সঙ্গে খুব একটা কথা বলেন না । পুরো সূটিং চলাকালীন সময় আমি তাকে একবারের জন্যও হাসতে দেখিনি । আমাকে নিয়ে তিনি বসলেন পরিচালকদের রুমে । ওনার হাতে ছোট একটা গ্লাস । আমি রুমে ঢুকে আবারও সালাম দিতে উনি , মাথা নেড়ে বসতে বললেন । তারপর গ্লাসে আলতো করে একটা চুমুক দিয়ে বললেন – কতো দিন ধরে লেখালেখি করছো ?
জ্বী,ছোটবেলা থেকেই ।
ছোটবেলা থেকে ? তিনি ঠোট উল্টে তাচ্ছিল্যের একটা ভঙ্গি করে আমার কথাটা রিপিট করলেন ।
তা দু’একটা নাটক টাটক কি টিভিতে গিয়েছে ?
জ্বি না , আমি টিভির জন্য কোন নাটক লিখিনি ।
টিভিতে না লিখে একেবারে চলচিত্রে ? ছোট থেকে না শুরু করতে হয় । বলে তিনি আবারও গ্লাসে চুমুক দিলেন ।
আমি কিছু বললাম না । আমি মনে মনে বললাম, আমি বড় থেকে ছোটর দিকে যাবো বলে ঠিক করেছি । সুযোগ পেলেই মানুষ উপদেশ ঝারতে শুরু করে । তার উপড়ে হাতে যদি রঙ্গিন পানির গ্লেলাস থাকে তা হলে তো আর কথাই নেই ।
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে তিনি গ্লাসে আরেকটা চুমুক দিয়ে বললেন ,দেখি কি এনেছো আমার জন্য ? বলে তিনি হাত বাড়ালেন । আমি ব্যাগ থেকে চিত্রনাট্যটা বের করে হাতে দিলাম ।
গ্লাসটা টেবিলে রেখে তিনি চিত্রনাট্যটার একটা একটা করে পাতা উল্টাতে লাগলেন – আমার বুক তখন ধুকধুক করছে । আমি মনে মনে আল্লাহ, আল্লাহ করছি এই জন্য যে, এবার যেন আমাকে আর প্রত্যাক্ষিত হতে না হয় । এবার যেন খুশি মনে ফিরতে পারি । এ লাইনের নিয়মই হচ্ছে একবার যদি কোন পরিচালক একটা লেখা নিয়ে কাজ শুরু করেন তা হলে আর বসে থাকতে হয় না। একেরপর এক কাজ আসতেই থাকে । যতো সময় যাচ্ছিল তোতোই উত্তেজনার আমার হাত পা কাঁপতে লাগল । আমি কোন রকম বসে রইলাম । তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে একটার পর একটা পাতা উল্টিয়ে যাচ্ছেন । আর আমার অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে । অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছি। আমি যেন আমার সাফল্যের হাতছানি দেখতে পাচ্ছি।
একসময় তিনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন – এটা তুমি লিখেছো ?
জ্বি ? আমি ছোট করে উত্তর দিলাম ।
তোমার লেখাটা এক কথায় চমৎকার প্রচুর কাজ করেছো বুঝা যাচ্ছে । কিন্তু এ লেখা নিয়ে তো আমি কাজ করতে পারবো না । তোমার এ গল্পটা হলিউডে হলে লুফে নিত । কিন্তু আমাদের দেশের পারিপাশ্বিক অবস্থার জন্য এ গল্প চলবে না । আমি দু:খিত । তুমি অন্য একটা গল্প নিয়ে আস ।
আমার মন ভেঙ্গে গেল । আমি কিছু বললাম না । উঠে দাঁড়ালাম ।
আমাকে উঠতে দেখে তিনি বললেন “তোমার হাতের টার্ন ভাল , আমি তোমাকে একটা থিম দিচ্ছি তুমি এটা নিয়ে কাজ করো ।”
সরি স্যার, আমি শুধু নিজের থিম নিয়েই স্টরি তৈরি করি । আমি ওনার হাত থেকে চিত্রনাট্যটা নিয়ে স্টুডিও থেকে বের হয়ে এলাম । সঙ্গে সঙ্গে একঝাক হতাশা আমায় ঝেকে ধরলো । মনে হলো এ জীবনের কোন মানে হয় না । এ জীবনের জন্য শুধু ব্যর্থতা পর ব্যর্থতাই অপেক্ষা করছে ।
অনেক রাত হয়ে গেছে । পথ ঘাট একেবারে জন শুন্য । কিভাবে মেসে পৌছাব আমার সে চিন্তা নেই । এফডিসি থেকে বের হয়ে হাঁটতে লাগলাম । কয়েক কদম হেঁটে মাছের আড়ৎটার সামনে আসতেই একটা লোককে দেখতে পেলাম । একটা খুটির সঙ্গে হেলাম দিয়ে একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে । পুরানো কালো একটা কোট গায়ে দিয়ে আছে । পা’দুটো খালি । মাথাটা কেমন অস্বাভিক রকমের বড় । লোকটাকে দেখে আমার পাগল বলে মনে হলো । আমি না দেখার ভান করে সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম । লোকটার সামনে যেতেই লোকটা গলা খাকারি দিল । আমি ফিরে তাকালাম – লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়াল, তারপর আমার দিকে এগিয়ে এসে কোন রকম জড়তা ছাড়াই বলল – কি কিছু হলো ?
আমি বেশ অবাক হয়ে লোকটার দিকে তাকালাম । লোকটা আবারও বলল, কিছুই হয়নি তাই না?
কি হয়নি ? আমি চরম বিরক্তি নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলাম ।
তোর চিত্রনাট্য তো ঐ বুড়ো ভামটা নেয়নি, তাই না ?
আমি বেশ অবাক হয়ে লোকটার দিকে তাকালাম । এহতে সামস্ এর সঙ্গে আমার কি কথা হয়েছে তা তো এই পথের লোকটার জানার কথা নয় । আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞিস করলাম, কে আপনি ?
আমি কে ? সেটা বড় কথা না , আমার কথা সত্য কিনা সেটা বল ।
আমি অনিচ্ছা সত্বেও মাথা নাড়লাম । যার অর্থ হলো , হ্যা , তিনি আমার লেখাটি নেননি ।
ঐ বুড়ো ভামটা যে নিবে না তা আমি আগেই জানতাম । বলে লোকটা খেক খেক করে হেসে উঠলো। হাসির শব্দে আমি কেমন জানি ভয় পেয়ে গেলাম । মাছের আশটে গন্ধ তীব্র হয়ে নাকে এসে লাগল ।
দু’পা পিছিয়ে এসে প্রশ্ন করলাম আপনি কে , কি করে এসব জানলেন ?
বললাম না , আমি কে সেটা বড় ব্যাপার না । আমি সব জানি । তোর অতীত জানি, তোর বর্তমান জানি; আবারও তোর ভবিষ্যতও জানি । লোকটা আবারও ভয়াল ভাবে হাসতে লাগল । এবার আমি সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেলাম । কোন এক অজানা ভয়ে ভেতরটা কেপে কেঁপে উঠল । আমি কোনরকম তোতলাতে তোতলাতে বললাম, কি চাই আপনার, কি চাই?
তোর সঙ্গে সওদা করতে করতে চাই ? লোকটা হাসি থামিয়ে সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল । ভয়ন্কর হলুদ দু’টো চোখের দিকে তাকিয়ে আমার পুরো শরীর কাপতে লাগল । হঠাৎ আমার মনে হলো আমার বমি পেয়েছে । বমি করতে পারলে ভাল হতো । আমি আবারও তোতলাতে তোতলাতে বললাম, কিসের সওদা ?
তোর খ্যাতি, যশ্, প্রতিস্ঠা তোর সকল স্বপ্ন পুরণের সওদা ।
মানে ?
মানে সোজা ,তুই উঠে যাবি খ্যাতির চুড়ান্তে যেখান থেকে সব কিছু অতি তুচ্ছ বলে মনে হয়। যেখান থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় না । করবি এমন সওদা ? আমি তোকে সব সব দেবো । লোকটা আমার মুখের কাছে এসে ফিসফিস করে কথাগুলো বলল । বিশ্রী মাছের আশটে গন্ধটার জন্য আমি আবারও পিছিয়ে গেলাম । টের পেলাম তীব্র ভয়ে আবার হাত পা থরথর করে কাঁপছে । ভয়ন্কর কিছুর শন্কায় আমি ছুটে পালাতে চাইলাম । লোকটা মনে হয় আমার মনোভাব বুঝতে পেরে খপকরে আমার বাম হাতের কব্জির উপড়ে চেপে ধরল । আমি তীব্র ব্যর্থায় উহু করে শব্দ করে উঠলাম । লোকটা হাসতে হাসতে বলল , রাজি আছিস ? রাজি আছিস ? তুই মনে মনে যেমনটা চেয়েছিস ঠিক তেমনটাই হবে,তরতর করে উঠে যাবি খ্যাতির চুড়ায় । এসব বুড়ো ভামরা লাইন দিয়ে পরে থাকবে তোর লেখার জন্যে , বল রাজি আছিস কিনা । বলে ফেল, বলে ফেল ।
আমি কয়কে মিনিটের মধ্যে যেন আমার ভবিষ্যত দেখে ফেললাম । সকল ভয়কে উপেক্ষা করে বললাম , তাতে আপনার কি লাভ ?
আমার কি লাভ ? বলে লোকটা হো হো করে হাসতে লাগল । তাতে আমার পুরো শরীর আবারও কাঁটা দিয়ে উঠল ।
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, দেবার মতো তো আমার কিছু নেই ।
তোর সব আছে, আমার প্রয়োজনে আমি চেয়ে নেবে । তোর প্রয়োজনে তুই চেয়ে নিবি । আছিস রাজি ? বলে ফেল , বলে ফেল ।
আমি মনে মনে চিন্তা করলাম । হারাবার মতো আমার কিছুই নেই । আবার দেবার মতোও নেই কিছু । তা হলে লোকটা কি চাচ্ছে ?
ঠিক তখনি আমার ভেতর থেকে কেউ একজন বলে উঠল রাজি; আমি রাজি । তোর তো আপন কেউ নেই, তাই হারাবারও কিছু নেই ।
তুই তাহলে রাজি ? লোকটা আমার দিকে অদ্ভূত ঘোর লাগা চোখে তাকাল ।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, রাজি । সঙ্গে সঙ্গে লোকটা আমার হাত ছেড়ে দিল আমার কাছে মনে হলো পুরো হাতটা অবশ হয়ে গেছে । আমি হাতটা ঝারতে ঝারতে লোকটার চোখের দিকে তাকালাম । মনে হলো, আমার পুরো শরীর গুলিয়ে উঠলো । সঙ্গে সঙ্গে আমি বর্মি করে ফেললাম । অনেকক্ষন বর্মি করার পর একটু আরাম হলো । আমি লোকটার দিকে তাকাতেই দেখি কেউ নেই। কালো খুঁটিটা যেন আমার দিকে তাকিয়ে হাঁসছে । আমি মাতালের মতো টলতে টলতে মেসের দিকে পা বাড়ালাম ।
তিন
মধুমিতা মেসের সামনে ভীড়টা চোখে পরার মতো । মূল রাস্তায় দু’টো পুলিশের গাড়ী দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম । অনেকক্ষন হাঁটার ফলে প্রচন্ড ক্লান্তি অনুভব করছি । মনে হচ্ছে গোসল করতে পারলে ফ্রেস লাগত । কিন্তু এতো রাতে মেসের সামনে এতো লোকজন কি করছে বুঝতে পারলাম না । কৌতুহল নিয়ে মেসের ভেতরে ঢোকার জন্য পা বাড়াতেই গেটের কাছে একজন এসআই আমার পথ রোধ করে দাঁড়াল । আমাকে আপাত মস্তক এক নজর দেখে নিয়ে প্রশ্ন করল, “কে আপনি ?”
জ্বি, আমার নাম রন্জু । এখানেই থাকি ।
এতো রাতে কোথা থেকে এলেন ?
জ্বি কাজ ছিল একটা ।
কি কাজ ?
এফডিসিতে একজনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম ।
করেন কি ?
লেখালেখি করি ? গল্প, উপন্যাস , চিত্রনাট্য লিখি ।
ও বই লিখেন ?
লোকটা কি বুঝে প্রশ্ন করল বুঝলাম না, মাথা নেড়ে বললাম, হ্যা ।
তা, কতো দিন ধরে এখানে আছেন ?
বছর তিনেক হলো ।
কাউন্টারের কাছে ম্যানেজার বদরুলকে দেখলাম, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে । এতো বড় একজন মানুষের কান্না দেখতে ভাল লাগেনা । তার উপরে বদরুলকে তো আরো না । আমাকে দেখে বদরুল রন্জু ভাই বলে ছুটে এসে জরিয়ে ধরল ।
বদরুল লোকটাকে আমার বিশেষ পছন্দ না । আমি পারত পক্ষে ওর সঙ্গে কথা বলি না । বদরুলও আমাকে সব সময় এড়িয়ে চলে । সেই বদরুলের এভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরায় আমি অবাক না হয়ে পারলাম না । মানুষের আবেক কে কখনও উপেক্ষা করতে নেই । হোক না সে যেমনই মানুষ । কিন্তু বদরুলের ব্যাপারটা ভিন্ন । আমি বদরুলকে ছাড়িয়ে দিতে দিতে নরম অথচ শক্তভাবে প্রশ্ন করলাম;“কি হয়েছে বদরুল ? ”
সদু ভাই ; বলে বদরুল আবারও কাঁদতে লাগল । আমার কাছে মনে হলো বদরুল অভিনয় করছে । আমি দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞাসা করলাম, সদু ভাই কি ?
সদু ভাই আর নেই ।
নেই মানে কি? কোথায় গেছেন ? ভনিতা না করে আসল কথা বলো । আমি আস্থির হয়ে উঠলাম ।
সদু ভাই, সদু ভাই আত্মহত্যা করেছেন । বলে বদরুল ছেলে মানুষের মতো কাঁদতে লাগলো। এবার আর ওর কান্নাটাকে অভিনয় বলে মনে হলো না ।
আমি প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলাম, “কোথায়, কেন ?”
উপড়ে বলে, বদরুল আঙুল দিয়ে দোতালাটা দেখিয়ে দিল।
দোতালার শেষ মাথায় সদু ভাইয়ের একটা রুম আছে । সদু সেটাকে অফিস হিসাবেই ব্যবহার করেন । পাশে একটা বিছানা পাতা আছে মাঝে মাঝে রাতে থেকে গেলে সেটাতে সদু ভাই ঘুমান ।
আমি এসআইয়ের দিকে উপড়ে যাবার অনুমতি পাবার দৃস্টিতে তাকালাম । এসআই আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, যান। তবে কিছু স্পর্শ করবেন না । এটা মার্ডার কেসও হতে পারে।
ঠিক আছে, বলে দ্রুত উপড়ে উঠে এলাম । বারান্দায় চেনা অচেনা অনেক মানুষ । কয়েকজন পুলিশ ও রয়েছে । আমার রুমটা মাঝামাঝি । আমার রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম তালা দেয়া ।
যারা আমাকে চেনে তারা আমাকে দেখে সরে গিয়ে ভেতরে যারার রাস্তা করে দিল । সদু ভাইয়ের রুমে ঢুকতেই আমি ভয়ন্কর রকমের ভয় পেয়ে গেলাম, ফ্যানের সঙ্গে বিশ্রী ভাবে সদু ভাইয়ের দেহটা ঝুলছে । জ্বিবটা মুখ থেকে বের হয়ে আছে । চোখ দু’টো খোলা । বিশাল দুটো হাত দুপাশে ছড়ান । পুরো শরীরে কোন কাপড় নেই । আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম । হঠাৎ টের পেলাম আমার মাথা ঘুরছে। আমি কোন রকম বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।
থানা থেকে ওসি সাহেব আসার পর সুরতহাল রিপোট তৈরি করে পোস্টমটেমের জন্য লাশ নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো । পুলিশ মেসের বোর্ডারদের থানাতে না জানিয়ে কোথাও না যাবার নির্দেশ দিয়ে চলে গেল । ঘড়িতে তখন সাড়ে তিনটা বাজে। ইতিমধ্যে আমি একটু ধাতস্ত হতে পেরেছি । সদু ভাই নেই । কথাটা ভাবতেই বুকের ভেতটা কেমন জানি করে উঠছে। বারবার সদু ভাইয়েই মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে ।
রুমে ঢুকে দেখি টেবিলের উপড় আমার খাবার ঢেকে রাখা । তারমানে হচ্ছে – সদু ভাইয়ের কাছ থেকে চাবি নিয়ে আমার খাবারটা রুমে দিয়ে গেছে । আহা: সদু ভাই, আমি হঠাৎ কান্নায় ভেঙ্গে পরলাম । বুক চেপে ধরে খাটের উপড় বসে পরলাম। হঠাৎ এফডিসির বাইরে দেখা লোকটার কথাটা কানে ভাসতে লাগল, তোর তো আপন কেউ নেই , তাই হারাবারও কিছু নেই । তুই তাহলে রাজি ? তুই তাহলে রাজি ? আমার মনে হলো সদু ভাই আমার আত্মীয় না হয়েও অনেক বেশি আপন ছিল । অনেক, অনেক বেশি ।
পরের দিন সাড়ে ১২টার সময় দরজার প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভাংলো । তারাহুরো করে উঠে দরজা খুলে দেখলাম বদরুল দাঁড়িয় আছে ওর পাশেই পরিচালক এহতে সামস্ । আমি বেশ অবাক হয়ে তাকালাম । আমার মেসে এহতে সামস্ এর মতো পরিচালক আসবে এতোটা আশা করিনি । আমি একটু ঘাবরে গিয়ে বললাম – স্যার আপনি ?
দেখ, দেখি তোমাকে না জানিয়েই চলে আসলাম; তা তুমি কি ফ্রি আছো ? তাহলে তোমার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলে নিতাম ।
জ্বি স্যার, আসুন ভেতরে আসুন । বলে আমি দরজা থেকে সড়ে দাঁড়ালাম । এই প্রথম রুমের ভেতরের অবস্থা দেখে নিজের কাছে লজ্জা লাগল । এহতে সামস্ চারিদিকে একবার নজর বুলিয়ে টেবিল থেকে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে পরলেন । আমি বললাম, স্যার যদি কিছু মনে না করেন ; আমি হাত মুখটা ধুয়ে আসি । তিনি মাথা নেড়ে বললেন, সিওর । তারপর এগিক ওগিক তাকিয়ে বললেন, তোমার এখানে এসট্টে নেই ? সিগারেট ছাড়া আমি আবার একদম চলতে পারি না। আমি খাটের নীচ থেকে একটা ভাঙা চায়ের কাপ অনিচ্ছা সত্বেও বের করে টেবিলের উপর রাখলাম । এহতে সামস্ কাপটা দেখে হেসে সিগারেট ধরালেন । আমি বদরুলকে চা বলে বার্থরুমে ঢুকে গেলাম ।
এহতে সামস্ সাহেব আমাকে দু’লাখ টাকার একটা ক্যাশ চেক দিয়ে একটা কাগজে সাইন করিয়ে নিলেন । আমার চিত্রনাট্যটি নিয়ে তিনি কাজ করবেন । সূটিং শুরু হবে মাস দু’য়েকের মধ্যেই । তখন আরো তিন লাখ পেমেন্ট করবেন । জীবনের প্রথম সাফল্যে আমি থরথর করে কাঁপতে লাগলাম । উত্তেজনায় কাগজটার মধ্যে কি লেখা আছে সেটাও ভাল করে পড়তে পারলাম না । এহতে সামস্ এর দেখানো জায়গাতে সাইন করে চেকটা হাতে নিলাম । হঠাৎ সদু ভাইয়ের জন্য আবারও মনটা কেদে উঠল । মানুষটা বেঁচে থাকলে আজ সব চাইতে বেশি খুশি হতো । এহতে সামস্ সাহেব বিদায় নেবার পর আমি ব্যাংকে ছুটলাম। সদু ভাইয়ের আত্মার শান্তির জন্য কিছু টাকা খরচ করবো ।
সদু ভাইয়ের মৃত্যুর পর পুরো মেসটা যেন অতিরিক্ত নীরব হয়ে গেছে । দোতালার বেশ কয়েকজন বোর্ডার পুলিশের অনুমতি নিয়ে মেস ছেড়ে চলে গেছে । অনেকেই বলাবলি করছে রাতের বেলা তারা নাকি সদু ভাইকে দেখেছে মেসের বারান্দা দিয়ে খুরিয়ে খুরিয়ে হাঁটতে । কথাটা এ কান ওকান হয়ে আমার কানে এসে পৌছলে আমি সেটাকে মোটেও গুরুত্ব দেলাম না । বেঁচে থাকতে যে মানুষটাকে বুক ফুলিয়ে হাঁটতে দেখেছি, মরে গিয়ে সে কিনা খুরিয়ে খুরিয়ে হাঁটবে ? সব চাইতে বেশি কথা ছড়াচ্ছে কাজের বুয়া রেহানার মা । বুয়াটা রীতিমতো গল্প ফেঁদে বসেছে । সদু ভাইকে বুয়া নাকি রান্না ঘরে দেখেছে । সকাল বেলা বুয়া থালা বাসন ধুচ্ছিল, তখন হঠাৎ রান্না ঘরে খটর মটর শব্দ শুনে বুয়া রান্না ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে, সদু ভাই খালি গায়ে চুলার কাছে কি যেন খুঁছছে । বুয়া দরজার কাছেযেতেই, সদু ভাই নাকি বলে উঠেছে, ও রেহানার মা ম্যাচটা কোথায় রেখেছো ? ম্যাচটা দাও, সিগারেট খামু ।
বুয়ার এ গল্পটাই সব চাইতে বেশি ছড়িয়ে পরেছে । আশে পাশের দশ বাড়িতেও এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলছে । আমি এসব কথাবার্তাকে মোটেও গুরুত্ব দেচ্ছি না। কারো সঙ্গে এ প্রসঙ্গে আলোচনা ও করছি না । বার দুয়েক বদরুল এসেছিল আমার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলবে । এর কথার শুরুতেই আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বলেছি, বদরুল বাজে বিষয় নিয়ে কথা বলে আমার সময় নস্ট করবে না, যাও নিজের কাজ করো গিয়ে । বদরুল আর কিছু বলেনি মাথা নীচু করে চলে গেছে । যতোসব বাকোয়াস কথাবার্তা । আমি পূর্ণ উদ্যোমে লেখা লেখি চালিয়ে যাচ্ছি । ইতিমধ্যে একটি পত্রিকায় আমার ছোটখাটো ইন্টারভিউও ছাপা হয়েছে । অন্যান্য কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে বিদ্যূতের গতিতে নতুন চিত্রনাট্য লিখে চলেছি । পরপর দু’টো ফিকুয়েন্সের কাজও শেষ করে ফেলেছি । ঝামেলা বাঁধল তৃতীয়টার সময় । সদু ভাইকে মেসে দেখার ঘটনাগুলো আমি গুরুত্ব না দিলেও আমার অজান্তেই মেসের ভেতর একটা কিছু ঘটে যাচ্ছিল তার প্রমান পেলাম আরো দু’দিন পর । আমার পাশের রুমে থাকেন ব্যাংক কর্মকতা ওমর ফারুক সাহেব । সাদাসিদে অমায়িক লোক । কারো আগে পিছে নেই । তিনি কিনা রাতের বেলায় কি দেখে ভয় পেয়ে হার্ট এ্যটাক করে হাসপাতালে ভর্তি হলেন । ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার খুব একটা কতাবার্তা না হলেও আমি তাকে হাসপাতালে দেখতে গেলাম ।
ইদানিং বাংলাদেশের প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর চেহারা বদলে গেছে । ঝকঝকে তকতকে হাসপাতাল দেখলেই মন ভাল হয়ে যায়। ওমর ফারুক সাহেব আছেন হাসপাতালের দোতালার একটি কেবিনে । আমি তার কাছে পৌছে দেখি তিনি আঙুর খাচ্ছেন । দশ কি বারো বছরের একটি মেয়ে তার মুখে একটা একটা করে আঙুর তুলে দিচ্ছে । আমাকে দেখে ওমর ফুরুক সাহেব একটু লজ্জা পেলেও হেসে বললেন, আসেন লেখক সাহেব । আমি ভেতরে ঢুকে হেসে জিজ্ঞেস করলাম, তা এখন কেমন আছেন ?
জ্বি ভাল । ওমর ফারুক সাহেবকে দেখে মনে হলো তিনি আবারও লজ্জা পেলেন ।
ও কি আপনার মেয়ে নাকি ? আমি মেয়েটার মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞাসা করলাম ।
জ্বি । দেখুনতো কতো করে বলছি হাসপাতালে ছোটদের আসার দরকার নেই, কিন্তু তবুও নাছোড়বান্দা আমাকে দেখতে নাকি আসতেই হবে । মেয়েটার গায়ের রং শ্যামলা কিন্তু অনেক মিস্টি । আমি মেয়েটাকে কাছে টেনে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার নাম কি মা ?
মেয়েটা ছোট করে বললো, মায়া ।
বাঃ সুন্দর নাম ।
তা, তুমি কোন ক্লাসে পড় ?
ক্লাস থ্রি তে ।
আমিও তো থ্রি তে পড়ি । যাক তুমি আর আমি একই ক্লাসে পড়ি । আমি হেসে বললাম ।
তুমি মিথ্যা বলছো । তুমি তো বড় । তুমি আব্বুর লেখক বন্ধু । আব্বুর সঙ্গে থাকো । আমি সব জানি ।
ওমা তাই নাকি ? তুমিতো দেখছি তোমার আব্বুর বুড়ি মা ।
আমি বুড়ি না আমার বয়স তো মাত্র এগারো বছর । এমন সময় ওমর ফারুক সাহেবের স্ত্রী আসলেন । তিনি মেয়েকে নিয়ে বাহীরে গেলে ওমর ফারুক সাহেব আমাকে বললেন, ভাই আমি আর ঐ মেসে যাবো না । একটু সুস্থ্য হলে জিনিষ পত্র সব নিয়ে আসবো ।
কিন্তু কেন ?
মেসটার দোষ হয়েছে । ওখানে খারাপ আত্মা বাসা বেঁধেছে । আমি বলতে যাচ্ছিলাম এসব বাজে কথা। কিন্তু কিছু বলার আগেই ওমর ফারুক সাহেব বলে উঠলেন, আমি জানি আপনি এসব বিশ্বাস করেন না । তবুও বলছি, সম্ভব হলে আপনিও মেসটা ছেড়ে দিন ।
আপনি ভয় পেলেন কি দেখে ? আমি সরাসরি ওমর ফারুক সাহেবের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম ।
ওমর ফারুক সাহেব একটু স র্সত নিয়ে বললেন, সদু ভাইকে দেখে ।
সদু ভাইকে ?
জ্বি ।
তা কি দেখলেন ?
বার্থরুমে যাবার জন্য দরজা খুলে বারান্দায় বের হয়েছ দেখি সদু ভাইয়ের রুমের দরজা খোলা । আলো জ্বলছে । এতোরাতে সদুভাইয়ের রুমে কে, কি করছে তা দেখার জন্য আমি এগিয়ে গেলাম । দরজার দাঁড়িয়ে ভেতরে উকি দিতেই দেখি; সদু ভাই হাতে একটা মোটা দড়ি নিয়ে ফ্যানের নিচে একটা চেয়ারে দাঁড়িয়ে আছেন । দড়িটা ফ্যানে বাঁধার চেস্টা করছেন। আমি, কে ? বলার সঙ্গে সঙ্গে সদু ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, “ও ব্যান্কার ভাই চেয়ারটা একটু শক্ত করে ধরো তো দেখি । মনে হচ্ছে পইড়া যামু ।” আমার আর কিছু মনে নেই । সঙ্গে সঙ্গে বুকে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করি । তারপর বুক চেপে ধরে পরে গেলাম। চোখ খুলে দেখি আমি হাসপাতালে ।
ওমর ফারুক সাহেবের কথা ফেলে দিতে পারলাম না । একেবারে মনের মধ্যে গেঁথে গেল । ভয় হচ্ছে সংকামক ব্যধির মতো একবার কারো ভেতর ঢুকে গেলে ডাল পালা ছড়ায় অন্যের ভেতরে ঢোকার জন্য । নানান যুক্তি দিয়েও এর কোন কূল কিনারা করতে পারলাম না । একরাশ চিন্তা নিয়ে এলোমেলো ভাবে হাঁটতে হাঁটতে মেসে ফিরলাম রাত ১১টার সময় ।
চার
মেসে ঢুকতেই কাউন্টারে বদরুলকে পেয়ে দোতালায় ডেকে নিয়ে এলাম । দোতায়ায় আমি ছাড়া এখন আর অন্য কোন বোর্ডার নেই । রুমগুলো সব তালা দেয়া । বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিজের অজান্তেই শরীরটা কেমন ছমছম করে উঠল। আমি ধীরে সুস্থে তালা খুলে ভেতরে ঢুকলাম । আমার পেছন পেছন ঢুকলো বদরুল । আমি খাটে বসে বদরুলকে চেয়ারে বসতে বললাম, ও বলল, বসতে হবে না রঞ্জু ভাই , কি বলবেন বলেন ?
তুমি কি সদু ভাইকে দেখেছো ? আমি কোন রকম ভূমিকায় না গিয়ে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলাম ।
বদরুল কিছু বলল না । মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল ।
কালকে সকালে বলি রঞ্জু ভাই ?
এখন নয় কেন ?
রাতের বেলায় তেনাদের নিয়ে কোন কথা বলতে হয় না । বদরুল দেখে মনে হলো, ও গুটি চালতে শুরু করেছে ।
তেনারা মানে কারা ? আমি তোমাকে সদু ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করছি । আমি দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করলাম ।
তেনারা মানে মৃত মানুষদের কথা বলছি ।
আমার প্রশ্নের উত্তর দাও , তুমি কি সদু ভাইকে দেখেছো ?
জ্বি ,দেখেছি ; বদরুল কিছুক্ষন নীরব থেকে আমতা আমতা করে উত্তর দিল ।
কবে ?
তিনি ফাঁসি দেবার দু’দিন পরে । সন্ধ্যার সময় দোতালায় এসেছিলাম, হঠাৎ দেখি সদু ভাইরুমের লাইট জ্বলছে । দরজা বন্ধ । কে ভেতরে দেখার জন্য দরজার ফাঁক দিয়ে উকি দিতেই দেখি সদু ভাই টেবিলে বসে কি যেন লিখছে । আমার তো জান যায় যায় অবস্থা আমি এক দৌড়ে নিচে গিয়ে বাবুচি তোতারে ডেকে এনে দেখি কেউ নাই । ভেতরের বাতিও নেবানো।
তুমি মিথ্যা বলছো না তো ?
আল্লাহর কিরা, মিথ্যা বলুম ক্যান ।
তোমার কাছে সদু ভাইয়ের রুমের চাবি আছে তাই না ? আমি সরাসরি বদরুলের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম । বদরুল সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে ফেলল । মানুষ সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যা বলতে পারে না । তার বিবেক বাঁধা দেয় । বদরুলের কথা আমার এমনিতেই বিশ্বাস হয় না ।
না, বদরুল মাটির দিকে তাকিয় বলল ।
এবার কিন্তু মিথ্যা বলছ । আমার সঙ্গে ওসির সাহেবের কথা হয়েছে কোন রকম উল্টা পাল্টা দেখলেই সরাসরি ফোন করতে বলেছেন । তুমি কি চাও আমি তোমার কথাটা ওসি সাহেবকে বলি । ওসি সাহেবের কথাটা আমি বানিয়ে বললাম । আমার সন্দেহ হচ্ছে বদরুল এমন কিছু জানে যা আমাকে বলতে চাচ্ছে না ।
ওসির কথা শুনে, বদরুল হঠাৎ খুব ঘাবরে গেল ।
কাচুমাচু হয়ে বলল, রঞ্জু ভাই আমি কিন্তু কিছু করি নাই ।
তুমি কিছু করেছো তা আমি বলিনি । শুধু এইটুকু বলেছি আমার সঙ্গে মিথ্যা বললে ফেসে যাবে । তোমার কাছে সদু ভাইয়ের রুমের চাবি আছে তাই না ?
বদরুল মাথা নাড়ল, আছে ।
তুমি সদু ভাইয়ের রুমে ঢুকার ও চেষ্টা করেছো তাই না ।
বদরুল না বলতে গিয়েও কি মনে করে থেমে গেল ।
দেখো মিথ্যা বলোনা, একদম ফেসে যাবে ।
পুরো ঘটনাটা আমাকে খুলে বলো ।
কি ঘটনা ?
তুমি সদু ভাইয়ের রুমে ঢুকেছিলে তাই না ? কোন জিনিষপত্র কি সরিয়েছো ?
আল্লাহর কিরা রঞ্জু ভাই আমি কিছু সড়াইনি ।
তারমানে তুমি সদু ভাইয়ের রুমে ঢুকছিলে ?
জ্বি ?
কেন ?
ঝারপোছ করতে ।
ঝারপোছ করেছো ?
না, ।
না কেন ?
ভয়ে চলে এসেছি ?
ভয় ? কিসের ভয়ে ?
সদু ভাইয়ের ।
সদু ভাইয়ের মানে ?
আমি সকাল বেলা সদু ভাইয়ের রুমে ঢুকে জানালাগুলো খুলছিলাম হঠাৎ পেছন থেকে সদু ভাইয়ের গলা শুনে চমকে পেছন ফিরে দেখি সদু ভাই টেবিলের উপড়ে বসে আছে , আমি তাকাতেই আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, বদরুল দরজা খুলিস না রে রোদ আসে । আমি দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে আসি । পরে তোতার ডেকে এনে দরজা বন্ধ করেছি । বিশ্বাস করেন রঞ্জু ভাই এর মধ্যে এক বিন্দু মিথ্যা নাই ।
চাবিটা তোমার সঙ্গে আছে ?
জ্বি , বলে বদরুল এক গোছা চাবি বের করে তার মধ্যে থেকে পিতলের একটা চাবি দেখাল।
চাবিটা আমারে খুলে দাও ।
বদরুল চাবিটা খুলে আমাকে দিয়ে বলল, রঞ্জু ভাই একটু সাবধানে থাকবেন । দোতালায় কিন্তু এখন আপনি ছাড়া আর কেউ নেই ।
ঠিক আছে , তুমি এখন যাও ।
খাবেন না ? খাবার দেবো ?
না, খাবো না । তুমি পারলে এক ফ্লাক্স চা পাঠাও । রাতে লেখালেখি করতে হবে ।
কোন কিছুর দরকার হলে আমারে আওয়াজ দিয়েন । আমি জেগে থাকবো ।
ঠিক আছে,দরকার হলো ডাকবো । তুমি এখন যাও ।
বদরুল দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়িয়ে ডাক দিল , রঞ্জু ভাই ?
কি ?
আজ আপনার খোঁজে একটা মেয়ে এসেছিল ।
মেয়ে ? আমি বেশ অবাক হলাম । কেননা ঢাকা শহরে আমার পরিচিত কোন মেয়ে নেই । কখন ?
দুপুরের দিকে ?
কিছু বলেছে ?
না , বলেছে আবার আসবে ?
ঠিক আছে তুমি যাও ।
বদরুল চলে যেতে জামাকাপড় পাল্টে চা খেয়ে লিখতে বসলাম । একটানা অনেকক্ষন লেখার পর হঠাৎ লেখার খেই হারিয়ে ফেললাম । কিছুতেই যেন মাথা থেকে কিছু বের হচ্ছিল না । একজন লেখকের জন্য এটা বুঝি সবচাইতে বেশি কস্টের বিষয় । খুব গরম লাগছে । টেবিলের পাশের জানলাটা খুলে দিয়ে আমি আবারও লিখতে চেস্টা করে ব্যর্থ হলাম । না, আজ আর হবে না। লেখা বন্ধ করে যতোটুকু লেখা হয়েছে । তা নিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে পড়তে লাগলাম । ঘড়িতে তখন কাটায় কাটায় রাত ৩টা বেজে ২ মিনিট । হঠাৎ বাইরে দুপ করে কোথাও শব্দ হলো । সঙ্গে সঙ্গে আমার ষস্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠলো । আমি দ্বিতীয় বার শব্দটা শুনার জন্য কান খাড়া করে ফেললাম । আবারও হলো শব্দটা । এবার বেশ স্পর্স্ট ভাবেই শুনা গেল। আমার ডান পাশ থেকে আসছে শব্দটা অথাৎ সদু ভাইয়ের রুমের দিক থেকে । টের পাচ্ছি মাথার চুলগুলো একটা একটা করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে । আমি শোয়া থেকে উঠে দাড়ালাম । আমার কাছে মনে হলো,কেউ যেন দরজা খুলে বাহীরে আসলো। বারান্দায় হাঁটার শব্দ শুনা যাচ্ছে । আমার একটা রুমের পরেই সদু ভাইয়ের রুম । দরজা খুললে শব্দটা শোনা যাবার কথা । আমি আস্তে আস্তে আমার দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম । পায়ের শব্দটা আমার দরজার কাছে এসে আবার সদু ভাইয়ের রুমের দিকে ফিরে গিয়ে আবার ফিরে আসছে । পায়ের শব্দটা আমার দরজার কাছাকাছি আসতেই আমি একটানে দরজাটা খুলে ফেললাম । পুরো বারান্দা অন্ধকার । কোন আলো নেই । অন্ধাকারে কাউকে দেখতে পেলাম না । আন্ধকারটা চোখে সয়ে আসতে দেখলাম শুন্য বারান্দা খাঁ খাঁ করছে । আমি ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম । কাউকে না দেখে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম । কেননা বুকের ভেতর কম্পন বেড়ে গেছে । টেবিলের উপড় রাখা বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি খেলাম । বিছানায় বসতেই দরজায় পরপর তিনটা টোকার শব্দ হলো । আমি চমকে উঠলাম । আমি দাঁড়িয়ে গেছি । ভয়ে ঘামতে শুরু করেছি । মাথার চুলগুলো আবারও একটা একটা করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে । আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কে ? কে ?
কেউ উত্তর দিল না । আমি দরজার কাছে গিয়ে কান পেতে দাঁড়িয়ে রইলাম ।
না, আর কোন শব্দ নেই । হয়তো মনের ভুল , অতিরিক্ত উত্তেজনায় এলোমেলো শুনছি । বেশ কিছুক্ষন দরজায় দাঁড়িয়ে থাকার পর আবারও বিছানায় এসে বসলাম । নিজেকে শান্তনা দিচ্ছি ভয় পাবার কিছু নেই । সব মনের ভুল হবে । মৃত মানুষ কখনও ফিরে আসতে পারে না । বিছানায় শুয়ে আবারও যেই লেখাটা পড়তে শুরু করেছি । ওমনি দরজায় শব্দ হলো। সঙ্গে সঙ্গে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম । ছুটে গেলাম দরজার কাছে । একটানে খুলে ফেললাম দরজা । তারপর যা দেখলাম তাতে আমার পুরো শরীর কেপে উঠল । আমি হিস্টিরিয়ার রুগির মতো চিৎকার করে উঠলাম কে ? কে ? দরজায় দাঁড়িয়ে আছে; সদু ভাই । মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে । চোখ দুটো গর্তের ভেতরে ঢুকে আছে । আমি বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলাম । সদু ভাই বললেন, রাইটার সাব, একটা কাঁথা দিবা ? আমার খুব শীত করতাছে । এখানে এখানে খুব খুব শীত । দাওনা একটা কাঁথা । আমি দরাম করে দরজা বন্ধ করে দিলাম । প্রচন্ড ভয়ে পিপাষায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। মনে হলো আমি মরে যাচ্ছি । কানের ভেতরে ভো ভো শব্দ শুনছি । চোখে কিছু দেখছি বলে মনে হলো না । হঠাৎ ওমর ফারুক সাহেবর কথা মনে হলো, বুঝতে পারলাম কি দেখে ভদ্রলোক ভয় পেয়েছেন । আমি বড় করে হা করে শ্বাস নিয়ে ছাড়তে লাগলাম । বাকি রাতটুকু দরজায় হেলান দিয়ে কাটিয়ে দিলাম ।
পাঁচ
ফজরের আযানের পর বিছানায় শুতেই ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে এলো । কতোক্ষন ঘুমিয়েছি জানিনা হঠাৎ প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভাংলো । প্রথমে চোখ খুলে বুঝলাম না শব্দটা কোথা থেকে আসছে । দ্বিতীয় বার শব্দ হতেই বুঝলাম প্রচন্ড জোড়ে কেউ দরজায় আঘাত করছে । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি পৌনে ছয়’টা বাজে । এক ঘন্টাও ঘুমাতে পারিনি । এলোমেলো পা ফেলে দরজা খুলতেই দেখি পুলিশের সেই এসআই দাঁড়িয়ে আছে । পুলিশ দেখে আমি চমকে উঠলাম । কি ব্যাপার ? কোন রকম নিজেকে সামলে প্রশ্ন করলাম । কেননা আমি ভাল করে তাকাতে পারছিনা । মনে হচ্ছে চোখের ভেতর অসংখ্যা সূঁচ ফুটছে । দু হাত দিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে এসআইয়ের দিকে তাকালাম ।
আপনিই তো রঞ্জু সাহেব ?
জ্বি বলেন ।
দূঃখিত আপনাকে বিরক্ত করতে হলো । একটু নীচে চলুন ।
কেন কি হয়েছে ?
আসুন না, গেলেই তো দেখতে পাবেন । কোথায় যেন পড়েছিলাম রিকশা চালক আর পুলিশের সঙ্গে তর্ক করতে নেই ,তাতে সন্মানহানির আশংন্কা থাকে । সেই বাক্যটা মনে করে একটা সার্ট টেনে গায়ে দিয়ে এসআইয়ের পিছু পিছু হাটতে শুরু করলাম । সিঁড়ির কাছে অনেক লোকের ভীড় চোখে পরল। কয়েকজন পুলিশও দাঁড়িয়ে আছে । ভীড়ের মধ্যে এফডিসির সামনে দেখা লোকটাকে দেখে আমি চমকে উঠলাম । সেই হলুদ চোখ, বিশাল মাথাওয়ালা লোকটাকে খুব সহজেই চিনতে পারলাম । কেমন হাসি হাসি মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । আমার পুরো শরীর যেন কেঁপে উঠল । আমি সিড়ির রেলিংটা ধরে দাঁড়িয়ে গেলাম । এসআই বললেন, কি হলো ? আমি কয়েক মুহুর্ত কোন কথা বলতে পারলাম না । নিজেকে কোন রকম সামলে নিয়ে আবারও নিচে তাকাতে কাউকে দেখতে পেলাম না । মনে মনে বললাম, আমি বোধ হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি ।
সিঁড়ির নীচে মেঝেতে কেউ একজন উপুর হয়ে পরে আছে । ঘারটা বিশ্রী ভাবে ডানপাশে মোচড়ানো । রক্তের দু’টো ধারা গড়িয়ে মেঝেতে নেমে গেছে । উপড় থেকে এক নজর দেখেই বুঝলাম বেঁচে নেই। ওটা কে ? কে ওখানে পরে আছে ? কথাটা বলে আমি দ্রুত পা ফেলে নীচের নেমে গেলাম । কাছে গিয়ে বদরুলকে চিনতে মোটেই বেগ পেতে হলো না । বদরুলকে এভাবে অপঘাতে মরতে দেখে আমি খুব ঘাবরে গেলাম। পরপর দু’টো মৃত্যু আমাকে হতবিহম্বল করে দিলো । আমার মুখ দিয়ে উহু একটা শব্দ বের হয়ে এলো । এসআই আমাকে ধরে কাউন্টারের সামনে নিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলেন । আমি এসআইয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, কিভাবে ?
সেটাইতো আমরা জানতে চেস্টা করছি । তবে প্রার্থমিক ভাবে মনে হচ্ছে পেছন থেকে কেউ খুব জোড়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে । তারপর কি একটা চিন্তা করে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনিও তো দোতালাতেই থাকেন , তাই না ?”
আমি মাথা নাড়ালাম , হা ।
বদরুল সাহেবের সঙ্গে আপনার কখন শেষ দেখা হয়েছে ?
গতকাল রাতে ।
কখন ?
রাত ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে । আমি এসআইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম ।
কি নিয়ে কথা হয়েছে ?
আমার কিছু বিষয় জানার ছিল তাই বদরুলের কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলাম ।
কি জানতে চেয়েছিলেন, তা কি আমি জানতে পারি ?
আমার গতরাতে দেখা সদুভাই এর মুখটা মনে পরে গেল । আমি কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললাম, পারেন ।
তা হলে বলে ফেলুন । দয়া করে মিথ্যা কিছু বলবেন না ।
অনেকেই নাকি সদু ভাইকে মেসের এখানে সেখানে ঘুরে বড়োতে দেখেছে । আমার কাছে মনে হচ্ছিল ব্যাপারটা বানোয়াট । তাই বদরুলকে ডেকে নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম আসলে ব্যাপারটা কি ?
তা, কি জানতে পারলেন ?
বদরুলও বলল ও নিজেও নাকি সদু ভাইকে দেখেছে ।
কবে , কোথায় দেখেছে ? এসআই অত্যান্ত শান্তু সুরে জিজ্ঞাসা করলেন ।
সদু ভাইয়ের মৃর্ত্যুর দু’দিন পরে । তার রুমে ।
এসব মিথ্যে কথা । যতোসব গাল গপ্প । একজন মৃর্ত মানুষ কি করে দেখা দেয় ?
আমিও প্রথমে তাই ই মনে করেছিলাম কিন্তু ব্যাপারটা আসলেই সত্য ……আমি গতরাতে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা বলতে গিয়েও থেমে গেলাম ।
কি সত্যি ? সদু সাহেবকে দেখার ব্যাপারটা ?
জ্বি ।
আপনার মতো একজন শিক্ষিত মানুষ বলছেন এ কথা ?
জ্বি, কেননা কেননা আমিও গতরাতে সদু ভাইকে দেখেছি । আমি এসআইকে সদু ভাইকে দেখার পুরো ঘটনাটা খুলে বললাম ।
সব শুনে এসআই সাহেব বললেন, এ্যস্ট্রেন্জ । এতো দেখছি সত্যিই ভৌতিক ব্যাপার । আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকলাম ।
মেসে পরপর দু’টো মৃর্ত্য ঘটায় পুরো শহরে হৈ চৈ পরে গেছে । প্রতিদিন অনেক লোক আসছে মেসটাকে দেখতে । পরের দিন সবকটি জাতীয় পত্রিকায় লাল কালিতে বড় বড় করে ছবি সহ হেডলাইন ছাপা হলো, “মেস মালিকের আত্মহত্যার পর এবার কর্মচারীর রহস্যজনক মৃর্ত্যু । এলাকা বাসি বলছে, ভৌতিক ঘটনা ”।
অন্য একটা পত্রিকায় ছাপা হয়েছ, “পুলিশের নাকের ডোগায় ঘটে চলেছ একের পর এক ভৌতিক হত্যাকান্ড, তবুও পুলিশ রহস্যের কোন কূল কিনারা করতে পারছে না । মেসের লোকজন বলছে, ভূতুরে কান্ড।”
মেসের উঠানের মাঝখানে বিশাল একটা আম আছে । যার গোরাটা গোল করে বাঁধানো । দু’জন পুলিশ পালা করে সেখানে বসতে শুরু করেছে । আমি মনে মনে ঠিক করে ফেলেছি মেস ছেড়ে দেবো । এহতে সামস্ সাহেবের সঙ্গে এর মধ্যে দু’দিন ফোনে কথা হয়েছে । তিনি স্বাভাবিক খোজ খবর নিয়ে আরেক জন পরিচালকের খোঁজ দিয়ে বলেছেন, তিনি নাকি একটা ভাল চিত্রনাট্য খুঁজছেন । তিনি ঐ পরিচালকে আমার কথা বলে ঠিকানা দিয়ে দিয়েছেন , ভদ্রলোক যে কোন দিন আসবেন আমার সঙ্গে দেখা করতে । নিজের ভাগ্যের এ পরিবর্তনে আমি আনন্দিত হবার পরিবর্তে ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছি । বারংবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে, সেই হলুদ দুটো চোখ, আর বিশ্রী মুখের হাসি ।
সদু ভাইকে দেখার পর থেকে আমার চারপাশে অদ্ভূত সব ব্যাপার ঘটছে । প্রায় রাতেই বারান্দায় কারো পায়ের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে । মাঝে মাঝে ঘরের মধ্যেও কার যেন উপস্থিতি টের পাচ্ছি । লেখালেখি নিয়েও চলছে তুগলগি কারবার । কোন একটি কাহিনী চিন্তা করে লেখা শুরু করলেই প্রচন্ড ঘুম পেয়ে যায়, আর তখন লিখতে লিখতেই ঘুমিয়ে পরি । সকালে উঠে নিজেকে হয় বিছানায় নয়তো মেঝেতে আবিস্কার করি । সব চেয়ে আশ্চর্য্যের বিষয় হচ্ছে, যে লেখাটা লিখতে শুরু করে ছিলাম সেটা পুরোপুরি শেষ করা অবস্থায় পাই । একরাতে একটা কাহিনী শেষ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় । কিন্তু হাতের লেখা হুবুহু আমার। আমার লেখাতে এমনিতে অনেক কাটাছেড়া হয় । কিন্তু এ লেখাগুলো একেবারে নিক্ষুত । এ রকম অদ্ভুত ঘটনায় আমি বেশ বিচলিত হয়ে উঠেছি ।
গভীর রাতের দিকে মাঝে মাঝে মনে হয় সদু ভাইয়ের রুম থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসে। খুবই করুন সে কান্নার শব্দ। আমি ভয়ে আর দরজা খুলি না । তার উপড় আবার ক্ষুধা মন্দা দেখা দিয়েছে । স্বাস্থ্য দ্রুত খারাপ হয়ে যাচ্ছে । আয়নার সামনে দাঁড়ালে বেশ বুঝতে পারি চোখ মুখ ভেতরে বসে যাচ্ছে । কোন কিছু খেতে ভাল লাগে না । ক্যামন জানি সব সময় একটা অস্থির ভাব কাজ করে। কোন কাজই মন দিয়ে করতে পারছি না। একটার পর একটা সিগারেট টেনে চলি । কোন কোন রাতে দেখা যায় জ্বলন্ত সিগারেট হাতে নিয়েই ঘুমিয়ে পরছি ।
ছয়
ইতি নামের একটা মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে । এহতে সামস্ সাহেব আমার যে কাহিনীটা নিয়ে ছবি বানাবে সেটার নায়িকা । আমার কাছে পাঠিয়েছেন ওর চরিত্রটি ভাল ভাবে বুঝিয়ে দেবার জন্য । আনার্স পড়ছে । মেয়েটা একবার এলে আর সহজে উঠতে চায় না । ঘরদোর নিজের মতো করে গুজগাছ করে ফেলে । ছোটবেলা থেকেই আমি নারী সঙ্গ বঞ্চিত । এখনও বুঝতে পারিনা মেয়েদের সঙ্গে ঠিক কিভাবে কথা বলতে হয়,মিশতে হয় । মেয়েটাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেও কোন লাভ হয়নি । একেবারে নাছোড়বান্দা । প্রথম প্রথম ভেবেছিলাম ওর চরিত্রটা বুঝিয়ে দিলেই কেটে পরবে । কিন্তু সেটা নিয়ে ওর সঙ্গে একদিনও বসতে পারিনি । আমি যখনই বলেছি চলো তোমার চরিত্রটি বুঝিয়ে দেই, তখনি ও বলেছে, রাখেন তো , আপনি তো আর উড়ে যাচ্ছেন না, পরেও এ নিয়ে বসা যাবে । চরিত্রটি বুঝে নেবার কোন আগ্রহ মেয়েটার মধ্যে আছে বলেও মনে হয় না । ওর ভাষায় কাহেনীকারকে বুঝতে পারলে নাকি অতি সহজেই তার রচিত যে,কোন চরিত্রের মধ্যে প্রবেশ করা যায়। তাই ও এখন আমাকে বোঝার চেস্টা করছে ।
আমার বর্তমান অসস্থা দেখে ইতি একদিন এসআইকে ফরহাদকে ডেকে নিয়ে আসল । আমি তাকে এক এক করে সব খুলে বললাম । এফডিসির সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোও বাদ গেল না । এসআই ফরহাদ আমার সদ্য সমাপ্ত চিত্রনাট্যটি যেটার শুরুটা করেছি আমি আর বাকিটা করেছে অন্য কেউ, নেড়েচেড়ে দেখে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন । তারপর একদিন বিকেল বেলা এসে বললেন, রন্জু সাহেব এটা আমি পরপর তিনজন হ্যান্ড রাইটিং এক্সাপাট কে দিয়ে পরীক্ষা করিয়েছি, এবং তারা সবাই মোটামুটি একই কথা বলেছে, যে এটা একই হাতের লেখা । সুতারাং আপনার এ কথাটা ঠিক নয় যে এ পুরোটা আপনি লিখেননি । আমি কিছুতেই আর তাকে বিশ্বাস করাতে পারলাম না যে, লেখাটি আমি শেষ করিনি । উল্টো এসআই আমাকে উপদেশ দিয়ে বললেন, কোথাও থেকে সপ্তাহ খানেক ঘুরে আসুন, দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে । সত্যি বলতে কি, আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আপনার উপড়ে বেশ চাপ ফেলেছে । কোথাও থেকে ঘুরে আসলে মাথাটা ক্লিয়ার হয়ে যাবে তখন দেখবেন আর এমন মনে হবে না ।
আমি ইতির অনুরোধে এসআইয়ের কথা মতো কক্সবাজার থেকে ঘুরে এলাম । কিন্তু তাতে সমস্যার কোন হেরফের হলো না। বরং নতুন এক উপদ্রোপের উপস্থিতি টের পেলাম । তা হলো, সারাক্ষন মাথার ভেতর ক্যামন সমুদ্রের গর্জন শুনতে পাই। চোখ বন্ধ করলেই মনে হয়, আমি সমুদ্রের মধ্যে পরে গেছি আর চারিদিক থেকে রাশি রাশি জল এসে আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ।
দিনের পর দিন আমার সমস্যা আরো বাড়তে থাকায় ইতি একদিন আমাকে পরানো ঢাকায় ওর এক স্যারের বাসায় নিয়ে গেল । ভদ্রলোক একজন সাইকিয়াটিস্ট । নাম মোস্তফা মল্লিক। শরীরের গরন হালকা পাতলা। ঠোটের উপর মস্ত একজোড়া গোফ। দু’গালে কয়েক দিনের না কাটা দাঁড়িতে ভদ্রলোককে দেখলে মনে হয় না তিনি একজন সাইকিয়াটিস্ট বা মনোবিজ্ঞানি । মধ্যবয়স্ক শরীরটা ধনুকের মতো সোজা, মাথার চুল সব এলোমেলো। দেখলে যাযাবর বলে মনে হয় । আমরা রিকশায় থাকতেই প্রচন্ড ঝড় হলো । পরিস্কার আকাশ বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ আকাশ কালো করে ঝড় শুরু হলো। আমরা যখন পৌছালাম তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে । পুরো এলাকায় বিদ্যূত নেই । অনেকক্ষন দরজায় কড়া নাড়ার পর কালো রঙের লুঙ্গি পরা উদম শরীরে মোস্তফা মল্লিক সাহেব দরজা খুলে দিয়ে ইতিকে দেখে বলে উঠলেন, ও তুমি । রান্না ঘরে ছিলাম তো তাই দেরি হয়ে গেছে । তারপর আমার দিকে তাকিয়েই যেন থমকে গেলেন । যেন আমি মস্ত কোন অপকর্ম করে এসেছি এমন করে পলকহীন ভাবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি প্রচন্ড রকমের অসুস্থিতে পরে গেলাম । একজন মানুষের দৃস্টি অন্য একজন মানুষের কাছে যে কি পরিমানে অসুস্থিকর হতে পারে তা হারে হারে টের পেলাম । একসময় মনে হলো, ভদ্রলোকের দৃস্টি আমার অস্থি মজ্জা ভেদ করে শরীরের রন্দে রন্দে পৌছে যাচ্ছে । হঠাৎ করে আমার ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করলো । মনে হলো, এ লোকের কাছ থেকে যতো দ্রুত পালিয়ে যাবো ততোই মঙ্গল । আমি ইতির দিকে তাকিয়ে চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়ে কোন রকম বললাম; ইতি চলো ।
ঠিক তখনি ভদ্রলোক খুব দ্রুত ছোবল মারার মতো খপ করে থাবা দিয়ে আমার ডান হাতটা ধরে ফেললেন, তারপর অত্যান্ত শান্ত কণ্ঠে বললেন, “ ভেতরে আসো, এখানে তোমার কোন ভয় নেই । তুমি ঠিক জায়গাতেই এসেছো ”।
মল্লিক সাহেব আমার হাত ধরে ভেতরের নিয়ে গেলেন । দরজা বন্ধ করা একটা ঘরের সামনে নিয়ে এসে তার অন্য হাতটা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলে ফেললেন । দ্রুত ঘরের ভেতর ঢুকে আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে বিছানাটা দেখিয়ে বললেন, ওখানে বস। আমি পুরো ঘরটার দিকে একবার তাকালাম , ঘরটা বলতে গেলে একেবারে আসবারপত্র শুন্য । এক কর্নারে মাটিতে জাজিম আর তোশক দিয়ে একটা বিছানা পাতা । তাতে কালো রং একটা চাদর আর দুটো বালিশ দেওয়া । তারপাশেই বড় একটা কাঠের আলমিরা দাঁড় করানো । ঘরের ঠিক মাঝখানে সাদা রং দিয়ে বড় একটা বৃত্ত আঁকা । বৃত্তের ভেতর হিজিবিজি করে আরো অনেক কিছুর ছবি আঁকা । ঘরের জানালাগুলো সব ভেতর থেকে বন্ধ । তবুও ঘরটার ভেতরে ভেতর পা দিতেই আমার মনে হলো, আমি যেন ফ্রিজের ভেতর প্রবেশ করেছি । হঠাৎ তীব্র শীতে আমার পুরো শরীর কেঁপে কেঁপে উঠল । আমি উহু করে কুঁকড়ে যাবার ভঙ্গি করলাম । লোকটা তখন দরজার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা ইতির দিকে তাকিয়ে বললেন, যা তো মা, বেডরুম থেকে একটা চাঁদর এনে ওকে দে। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভদ্রলোক আমার দু’হাত ধরে বিছানায় নিয়ে গিয়ে বলল, এখানে বসো । আমার নাম মোস্তফা মল্লিক । আমি ইতির কলেজে মনোবিজ্ঞান পড়াই । আমার কাছে তোমার কোন ভয় নেই । তুমি এখানে নিশ্চিন্তে থাকো । সব ঠিক হয়ে যাবে ।
ইতি একটা চাঁদর এনে আমার শরীরে পেচিয়ে দিল । ততোক্ষনে ঠকঠক করে আমার দাঁতের সঙ্গে দাঁতে বারি খাচ্ছে । মৌল্লিক সাহেব ইতির দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর কাকি গ্রামের বাড়িতে গেছে । আমি রান্না বসিয়েছি । তুই রান্নাটা দেখ। আমি ওকে নিয়ে বসছি । ওর অবস্থা ভাল না । এতোটা খারাপ আশা করিনি । আরো আগে নিয়ে আসা উচিত ছিল । হঠাৎ ইতির পেছনে আমার চোখ যেতেই আমি চমকে উঠলাম । কেননা ইতির পেছনে দাঁড়িয়ে আছে এফডিসির সামনে দাঁড়ানো সেই লোকটা । চোখ দুটো থেকে যেন আগুন বের হচ্ছে । লোকটা তীব্র ভয়ন্কর দৃস্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । মনে হচ্ছে, এখানে আসার জন্য সে আমার উপড় চরম অসুন্তস্ট । সুযোগে পেলেই আমাকে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। আমি লোকটার থেকে চোখ সরিয়ে নিতে পারলাম না । বড় বড় দৃস্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে মুখ দিয়ে গোৎ গোৎ শব্দ করতে করতে কাঁপতে লাগলাম । ইতি আমার এমন আচড়নে ভয় পেয়ে গেল । দৌড়ে এসে আমার দু’কাধ ধরে ঝাকাতে ঝাকাতে বলল, রন্জু ভাই, এ্যই রঞ্জু ভাই, কি হয়েছে ? কি হয়েছে আপনার ? আমি একটা আঙুল তুলে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে দেখালাম । কুৎসিত লোকটার দৃস্টির কোন পরিবর্তন হয়নি । সেই একই দৃস্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । মল্লিক সাহেব আমার আঙুল বরাবর তাকিয়ে কি দেখলেন বুঝলাম না । সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছুটে গেলের আলমিরার কাছে, একটানে আলমিরাটার খুলে তার ভেতর থেকে একটা শিশি বের করে ভেতরে থাকা একটা তরল পদার্থ ছুরে দিলেন দরজার বাইরে । সঙ্গে সঙ্গে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার শরীর মুচড়ে উঠল । এবং সাথে সাথে মিলিয়ে গেল । মৌল্লিক সাহেব আমার শরীরে শিশিটা থেকে কয়েক ফোঁটা তরল পদার্থ ছুড়ে মারলেন । আতরের সুগন্ধিতে পুরো ঘর যেন মৌ মৌ করে উঠল । হঠাৎ শীতটা চলে গেল আমি আরাম বোধ করায় বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে পরলাম ।
মল্লিক সাহেব ইতির দিকে তাকিয়ে বললেন, ও এখন ঘুমাবে । আমার কিছু জরুরী কাজ এর মধ্যে সেরে নিতে হবে । তুমি রান্না ঘরে গিয়ে গরম পানি বসাও ।
সাত
স্বপ্নে কুচকুচে কালো বিষাক্ত একটা সাপ দেখে প্রচন্ড ভয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেল । দেখলাম; দীর্ঘ একটা সাপ আমার ঘরের মেঝেতে কুন্ডুলি পাকিয়ে ফর্ণা তুলে বসে আছে ছোবল মারার জন্য। আমি হাত পা গুটিয়ে বিছানায় বসে চিৎকার করছি । সাপটা আমার দিকে তাকিয়ে তার লম্বা কালো কুচকুচে জ্বিবটা বারংবার বের করছে আর ভেতরে নিচ্ছে । সাপটা আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমাকে নড়াচড়া করতে না দেখে যেন অস্থির হয়ে উঠল । তারপর খুব ধীরেধীরে বিছানা বেয়ে উঠতে উঠতে আমার মুখে বিষ ছুড়ে মারল । প্রচন্ড আতন্কে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল । আমি লাফ দিয়ে উঠে বসলাম ।
চোখ খুলে বুঝতে বেশ কস্ট হলো আমি কোথায় আছি । ঘরে অল্প আলোর একটা বাতি জ্বলছে । দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ । হঠাৎ মনে পরে গেল সব । আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে ইতিকে খুঁজতে লাগলাম । ঘরের মেঝেতে আঁকা বৃত্তটার মধ্যে গোল হয়ে তিনজন লোক আসন ঘেরে অনেকটা ধ্যানের ভঙ্গিতে বসে আছে । সবার হাটুর উপর দু’হাত রাখা ।
একজন বিরবির করে কিছু একটা মন্ত্র পড়ছে আর পাশে রাখা একটা বোতল থেকে পানি জাতীয় কিছু একটা একটু পর পর ছিটিয়ে দিচ্ছে । ভাল করে তাকাতেই মল্লিক সাহেবকে চিনতে পারলাম । আমাকে উঠে বসতে দেখে মল্লিক সাহেব আমার দিকে একটা হাত বারিয়ে দিয়ে বললেন, এসো, আমার কাছে এসো । আমি কি করবো বুঝতে পারলাম না । হঠাৎ মনে হলো, মাথার ভেতটা ক্যামন শূণ্য হয়ে গেছে । আমি আমার অতীত,বর্তমান কিছুই মনে করতে পারছি না। মাথার ভেতরে ভোতা একটা যন্ত্রনা হচ্ছে । আমি আবারও ইতিকে দেখার জন্য এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম । মল্লিক সাহেব আবার ডাকতেই আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, পানি খাব। তিনি তার সামনে বসা একজনের দিকে তাকাতেই লোকটা উঠে এক গ্লাস পানি এনে দিল । আমি পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে চমকে উঠে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগলাম । আমার কাছে মনে হলো লোকটা এক গ্লাস তাজা রক্ত আমার হাতে দিল । এবার মল্লিক সাহেব উঠে এসে আমার হাত ধরে আমাকে বৃত্তের মাঝে নিয়ে বসিয়ে দিয়ে বললেন, তোমার কোন ভয় নেই । তোমার ভালর জন্যই আমরা এসব করছি। তারপর একটু থেমে আমাকে ভালকরে দেখে নিয়ে বললেন, রন্জু তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছো ? মল্লিক সাহেব কয়েকবার জিজ্ঞেস করার পর আমার মনে হলো আমি মাথা নাড়ালাম যে, হ্যা আমি ওনার কথা বুঝতে পারছি ।
গুড, এখন আমি তোমাকে কয়েটা কথা বলবো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবে । আমি আবারও মাথা নাড়ালাম । মল্লিক সাহেব কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে লাগলেন, আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত পার্থিব অপার্থিব অনেক আত্মা ঘুরে বেড়ায় । তাদের মধ্যে কোনটা ভাল আবার কোনটা খারাপ । আমাদের জীবনে তাদের কোন ভূমিকা না থাকলেও কখনও সখনও আমাদের উপড় কিছু খারাপ আত্মাদের দৃস্টি পরে । তখন তারা আমাদের ক্ষতি করার চেস্টা করে । তোমার উপরেও ঠিক তেমনি একটি আত্মার দৃস্টি পরেছে । সে এখন তোমার চারপাশের সবকিছু বিনিস্ট করে চলেছে । মাঝে মাঝে তুমি তাকে দেখতে পাও । ভয়ন্কর সে আত্মা তোমাকে এখন মৃর্ত্যুর খুব কাছা কাছি নিয়ে এসেছে ।
রন্জু, তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছো ?
আমি ঘন ঘন মাথা নাড়লাম হ্যা, আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি । সঙ্গে সঙ্গে সেই ভয়াল চোখ দু’টোর কথা আমার মনে পরে গেল । আমি ভয়ার্ত চোখে বন্ধ দরজাটার দিকে তাকালাম । আমাকে কেপে উঠতে দেখে মল্লিক সাহেব আমার কাধে একটা হাত রেখে আবারও বলতে লাগলেন, আমরা এখানে উপস্থিত হয়েছি তোমার জন্য । তোমার কাছ থেকে সে অশুভ আত্মাকে তাড়িয়ে দিতে । তোমার সাহায়্য দরকার । তুমি কি আমাদের সহায়তা করবে ? আমি আবারও মাথা নাড়লাম, হ্যা আমি সহায়তা করবো ।
তোমার সঙ্গে অশুভ আত্মাটা আছে সে তৈরি হচ্ছে তোমার উপড় চুড়ান্ত আঘাত হানার জন্য । যে কোন সময় সে তোমার উপড় আঘাত হানবে । তবে তোমার ভয় নেই । আমরা আছি । তোমার হয়ে এখন আমরা তার মোকাবেলা করবো । আর এর জন্য চাই তোমার সাহস এবং সহযোগীতা ।
আমি রাজি কি করতে হবে বলুন, আমি অনেকটা ধাতস্ত হয়ে মল্লিক সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললাম ।
আমি যা বলব তা হুবুহু পালন করে যাবে । কিছুতেই এ বৃত্ত থেকে আমার নির্দেশ ছাড়া বের হবে না । মনে রাখবে বৃত্ত থেকে বের হওয়া মনেই হচ্ছে তোমার মৃত্যু । মনে থাকবে আমার কথা ?
জ্বি মনে থাকবে ,বলে আমি মাথা নাড়ালাম ।
আত্মাটা তোমাকে অনেক প্রলভন দেখাবে, আকুতি মিনতি করবে ভয় দেখাবে,তোমাকে এ বৃত্ত থেকে বের করে নিতে চাইবে কিন্তু তুমি ভয় পাবে না । বৃত্ত থেকে কিছুতেই বের হবেনা । বুঝতে পেরেছো ? হঠাৎ আমার মনে পরলো ইতির কথা, আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইতি কোথায় ? মল্লিক সাহেবকে মনে হলো একটু হাসলেন । তারপর আস্তে করে বললেন, ও বাসায় চলে গেছে । ওকে নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না । ও ভাল আছে । আমি খুব শান্ত ভাবে মাথা নাড়লাম । তারপর কি মনে করে মল্লিক সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললাম, ঐ আত্মাটা যদি ওকেও মেরে ফেলে ?
না, সে ভয় নেই । ইতি জানে কি ভাবে নিজেকে রক্ষা করতে হয় । তুমি এ পানিটুকু খেয়ে চোখ বন্ধ করে থাকো । মল্লিক সাহেব ছোট একটা বোতল আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলেন । আমি বোতলটা হাতে নিয়ে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে বোতলটা ফেরত দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। মল্লিক সাহেব আবার ও মন্ত্র পড়তে শুরু করলেন । এভাবে অনেকক্ষন কেটে গেল । আমার কাছে মনে হলো আমি অনাধী অনন্ত কাল এভাবে বসে আছি । একসময় হঠাৎ মনে হলো,এসব আমি কি করছি ? কাদের পাল্লায় পরলাম । আমি উঠে যাবার জন্য ছটফট করতে লাগলাম । ঠিক সে সময়ই তীব্র শীতে আমার শরীর আবারও কেঁপে উঠল । আমি চোখ খুলে দেখি বৃত্তটার মাঝখানে মাত্র একটা মোম বাতি জ্বলছে । দরজাটা হাট করে খোলা । দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সেই ভয়াল লোকটা । চোখ দু,টো থেকে আগের মতো আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে । আমি তাকাতেই আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, তুই এখানে ? উঠে আয় উঠে আয় বলছি । মল্লিক সাহেব আমার একটা হাত চেপে ধরে বললেন, ভয় পেয়ো না । ও এ বৃত্তর মধ্যে আসতে পারবে না । আমি লোকটার উপড় থেকে চোখ সরাতে পারলাম না । লোকটা মুখ বিকৃত করে বলল, ভুলে গেছিস সওদার কথা ? আয়, চলে আয় বলছি । হঠাৎ মল্লিক সাহেব বলে উঠলেন, যা ভাগ,ভাগ এখান থেকে । দূর হয়ে যা শয়তান ।
তুই, শয়তান, তুই দূর হয়ে যা । তুই মর । আমি তোর মাথা চিবিয়ে খাবো । দরজার কাছে দাঁড়ানো লোকটা ভয়ন্কর ভাবে বলে উঠল । মল্লিক সাহেব কিছু না বলে আরো জোড়ে জোড়ে মন্ত্র পড়তে লাগলেন । লোকট চলে যাবার পরিবর্তে বাতাসে ভেসে ঘরের ভেতর চলে এলো । তারপর বৃত্তটাকে এক নজর দেখে বিকট ভাবে হেসে উঠে বলল, ভেবেছিস এটা তোদের রক্ষা করবে ? আয় আমার দলে যোগ দে , আমি তোদের তামাম পৃথিবী দিয়ে দেবো। আয় আমার কাছে আয় । আমার কাছে সব আছে নিয়ে নে । নিয়ে নে । বলে লোকটা আবারও হাসতে লাগল । আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম । মনে হলো, উঠে এক দৌড়ৈ ঘর থেকে বের হয়ে যাই । মল্লিক সাহেব আমার মনোভাব বুঝতে পেরে আবারও আমার হাত চেপে ধরে বললেন, ভয় নেই , ওকে ভয় পাবার কিছু নেই । ও আমাদের একটা চুলও বাঁকা করতে পারবেনা ।
তাহলে দেখ, আমি কি পারি । বলেই লোকটা বৃত্তের ভেতর ঢুকার জন্য এগিয়ে এলো এবং বৃত্তের উপড় পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে পেছনে পরে গেল । এবার মল্লিক সাহেব হেসে উঠে বললেন, দেখলি দেখলি তোর দৌড় কতোখানি দেখলি ?
লোকটা কয়েক মূহুর্ত মাটিতে থম মেরে বসে রইল, তারপর হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বা: বেশ জাল পেতেছিস তো ? বলার সঙ্গে সঙ্গে লোকটার আকৃতি পরিবর্তন হয়ে গেলো, লোকটা মুর্হুত্যের মধ্যে সদু ভাইয়ের রুপ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে পরিস্কার শুদ্ব ভায়ায় বলে উঠল, কি রাইটার সাব, আমার সঙ্গে আসবা না । আস; উঠে আস বলছি । এরা তোমাকে মেরে ফেলবে আসো চলে আস । বলে সদু ভাই দু’হাত বাড়ালেন । আমি মল্লিক সাহেবের দিকে তাকালাম। তিনি বোতল থেকে পানি ছুড়ে মারলেন । সঙ্গে সঙ্গে সদু ভাই গুমরে কেদে উঠলেন । তারপর কান্না থামিয়ে গালাগালি করতে লাগলেন । আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম । হঠাৎ ইতির কন্ঠ শুনে চোখ খুললাম । দরজাটা বাহীর থেকে ইতি ভেতরে ঢোকার জন্য দরজাটা প্রচন্ড জোরে ধাক্কাচ্চে আর বলছে, রঞ্জু ভাই দরজা খুলুন, এ্যই রঞ্জু ভাই দরজাটা খুলুন না । কোথাও সদু ভাই কিংবা লোকটাকে দেখতে পেলাম না । আমি দরজা খোলার জন্য উঠতে যাচ্ছিলাম, মল্লিক সাহেব আমার হাত চেপে ধরে বললেন, ওটা ইতি না । তুমি এখানেই বসে থাকো । আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম , মল্লিক সাহেব আমার কানরে কাছে মুখ এনে বললেন , ওটা ইতি না । ইতি ভাল আছে ।
না , ওটা ইতির গলা দয়া করে ওকে ভেতরে আসতে দিন । শয়তানটা ওকে মেরে ফেলবে । আমি হাত ঝাড়া দিয়ে মল্লিক সাহেবের হাতটা ছাড়িয়ে দরজার কাছে ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। দরজায় ইতি দাড়িয়ে আছে । আমাকে দরজা খুলতে দেখেই হেসে বলল, আমার প্রিয়, আমি জানতাম তুমি আমার ডাকে সারা দেবে । এসো আমার সঙ্গে । বলে, ইতি আমার একটা হাত ধরল । আমার কাছে মনে হলো, আমার হাতে কেউ আগুনের ছেকা দিয়েছে আমি আঁতকে উঠে পিছিয়ে গেলাম । ইতি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কি হলো ? ভয় পেয়েছো ? এসো এসো আমার সঙ্গে । আমি দু’পা পিছিয়ে এলাম । হঠাৎ আমার মনে হলো, এটা ইতি না । সেই লোকটা । আমি মল্লিক সাহেবের কাছে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই আমার গলাটা প্রচন্ড জোড়ে চেপে ধরল ইতি । আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল । আমি দু’চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম । এমন সময় পেছেন থেকে মল্লিক সাহেব পানি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে এসে বললেন, ছাড় ছাড় বলছি । ছেড়ে দে শয়তান । ছেড়ে দে ।
মুহুর্তে ইতির রুপ পরিবর্তন হয়ে গেল । আবার সেই আগের রুপ ধরে লোকটা আমাকে ছেড়ে দিয়ে মল্লিক সাহেবের দিকে ছুটে গেল । বৃত্তের ভেতরে থাকা লোক দুটো আমাকে টেনে বৃত্তের ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিয়ে । লোকটা মল্লিক সাহেবকে মাটিতে ফেলে তার বুকের উপড় চেপে বসেছে । আমাকে বৃত্তের ভেতর বসিয়ে দিয়েই লোক দু’জন হাতে দুটো লম্বা শাবল জাতীয় কিছু নিয়ে পেছন থেকে মল্লিক সাহেবর উপড় বসে থাকা লোকটা পিঠে ঢুকিয়ে দিল । তারপর টান দিয়ে মাটিতে ফেলে শাবল দিয়ে মাটির সঙ্গে চেপে রাখল । মল্লিক সাহেব চোখের পলক উঠে বসে হাতের বোতলের পুরো পানিটা লোকটার শরীরের উড়র ছিটিয়ে দিতে দিতে মন্ত্র পড়তে লাগলেন । আমি নিজের অজান্তেই আল্লাহু আকবর , আল্লাহু আকবর; বলে চিৎকার করতে করতে উঠে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরলাম ।
—- মুহম্মদ সাখাওয়াত হোসেন